প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
পর্ব-২
বিশ্ববিদ্যালয় মডেল নিয়ে প্রথম পর্বে কথা বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান বিতরণ নয় শুধু, জ্ঞান তৈরির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং সেই জন্যে রিসার্চ ইনস্টিটিউট তৈরি করতে হবে এবং সেখানে বিশ্বমানের গবেষক নিয়োগ দিতে হবে। এই পর্বে থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা এবং ফান্ডিংয়ের মডেল কী হওয়া উচিত সেটা নিয়ে আলোচনা।
১. আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার প্রতি বেশি উদ্যোগী হতে হবে।
আমাদের দেশে সবার মধ্যেই বিশেষ করে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ধারণা হলো গবেষণা হলো টাকা পানিতে ঢালা যেখান থেকে কোন ধরনের অর্থনৈতিক ফলাফল পাওয়া যায় না। এই কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা বিশেষ করে ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার ক্ষেত্রে। আমেরিকা যে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ হয়েছে সেটা এই ব্যবসাভিত্তিক গবেষণা দিয়েই। আর এখন চায়নার দিকে তাকালে সেটা আরো বেশি বুঝতে পারা যায়। এই ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার জন্যে দরকার সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিজ্ঞান মনস্ক মানুষের একই জায়গাতে মিলন। আপনার বাড়ির পাশের যে রেডিও, টিভি ও মোবাইলের মেকানিক সেও কিন্তু একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। আপনার আমার চেয়ে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের কাজ সে অনেক ভালো জানে। অতএব, আপনি যদি কোনো একটা গবেষণার জন্যে একটা ডিভাইস বানাতে চান সে হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। আবার একইভাবে এই রকম জিঞ্জিরার কোন মেকানিক ও যাতে আপনার গবেষণা কেন্দ্রে এসে তার সমস্যার সমাধান পেতে পারে সেই পথ ও খোলা রাখতে পারে। এই বিষয়ে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। জিলেট নামটি সারা পৃথিবীতে পরিচিত এই নামের ব্লেড ও রেজরের কারণে। ঘটনাটি কিং ক্যাম্প জিলেট এবং তার দাড়ি কামানোর জিলেট ব্লেড এবং রেজর আবিস্কার সমন্ধে। কিং ক্যাম্প জিলেট আমেরিকার মেসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ব্রুকলাইনে একজন সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন ১৮৯৬ সালের দিকে। কিন্তু বিক্রি করার চাইতে নতুন কোন কিছু তৈরি করার দিকেই তার ঝোঁক বেশি ছিলো। তাই সে তার বস উইলিয়াম পেইন্টারের কাছে গিয়ে পরামর্শ চাইলো। উইলিয়াম পেইন্টার ডিসপোজেবল বোতলের মুখ আবিষ্কার করেন এবং এটা আমেরিকাতে খুব ব্যবসাসফল হয়। সে তাকে পরামর্শ দিলো এমন একটা কিছু তৈরি করো যেটা ডিসপোজেবল হবে এবং তোমার প্রোডাক্ট কাস্টমারের বার বার কিনতে হবে। জিলেট একদিন দাড়ি কামাতে গিয়ে মোটা ব্লেডের ক্ষুর দিয়ে তার গাল কেটে যায়। এই ধরনের ব্লেড নিরাপদ নয়, কারণ এই ধরনের মোটা ব্লেডের কাটা খুব গভীর হতো এবং সেই সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার না হওয়ায় অনেকের মৃত্যুর কারণ হতো। তাছাড়া এই ধরনের ব্লেড বার বার ব্যবহারের কারণে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে রোগ সংক্রমিত হতো। আবার এই ব্লেড খুব দ্রুত ভোঁতা হয়ে যেত এবং বার বার এটিকে ধার দেয়া লাগতো। ক্ষুর দিয়ে গাল কাটার পর তার মাথায় হঠাৎ করেই আইডিয়া এলো ডিসপোজেবল ব্লেডের, যেটা নিরাপদও হবে এবং বার বার ধারও দেয়া লাগবে না। সাথে সাথেই সে এই ব্লেড তৈরির কাজে লেগে গেলো। যেহেতু তার ব্লেডটি খুব অল্প দামের হতে হবে, তাই সে কাজ শুরু করলো সিট স্টিল দিয়ে যেটা সেই সময়ের একমাত্র সস্তা স্টিল ছিলো। কিন্তু সে কাজ করতে গিয়ে দেখলো এটা খুবই নরম, যা দিয়ে খুব পাতলা এবং ধারালো ব্লেড বানানো সম্ভব নয়। সে বুঝতে পারলো তার এমন একজনের সাহায্য দরকার যার মেটাল সমন্ধে ভালো জ্ঞান আছে। তাই সে গেলো মেসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি বা এমএইটি-এর স্টুন্ডেন্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে। অনেকে আগ্রহ না দেখালেও উইলিয়াল নিকারসন নামের একজন এমআইটি গ্রেজুয়েট তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। তারা দুইজন মিলে অবশেষে তৈরি করলেন ডিসপোজেবল ব্লেড ও রেজর। জিলেট তার আবিষ্কারের প্যাটেন্ট করলেন এবং জিলেট কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন যেটি আজ সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। এই ঘটনাটি একটি ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই রকম বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের ব্যবসাভিত্তিক গবেষণার মিলনস্থলে পরিণত করতে হবে। একটি ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে সেটি হলো আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, আনন্দ, বিনোদন এবং দৈনন্দিন জীবন এ আমরা যা চাই সেই চাওয়ার উপর ভিত্তি করেই গবেষণা ও আবিস্কার করতে হবে। আমাদের নিজেদের মার্কেটে চলবে এই রকম প্রোডাক্ট। প্রথমেই চাঁদ ও মঙ্গল এ যাওয়ার মতো বড় বড় আবিস্কারের কথা চিন্তা করলে কিছুই হবে না। আমেরিকা ও চায়না এই রকম ছোট ছোট প্রোডাক্ট দিয়েই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভের পর এখন বড় বড় আবিস্কারের পথে এগিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আরেকটি শক্ত বন্ধন তৈরি করতে হবে ইন্ডাস্ট্রির। আমাদের অনেক সরকারি ও বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রি আছে যারা কোনো সমস্যায় পড়লে বিদেশ থেকে কনসালটেন্ট, বিজ্ঞানী বা ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে আসেন। কিন্তু এই ধরনের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্র করে তুলতে হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলোকে যেখানে আমাদের রিসার্চ একাডেমিকদের নেতৃত্বে, এমফিল, ও পিএইচডি স্টুডেন্টরা ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোর আরেকটি দুর্বলতা হলো মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের সাথে তাদের খুব দুর্বল সংযোগ। আমাদের মেডিকেল কলেজগুলো শুধু নামেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন, কিন্তু সার্টিফিকেট নেয়া ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ বিদেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মেডিকেল রিসার্চই সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং এর সাথে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ডাক্তাররা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উদাহরণ হিসেবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল কিংবা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কলম্বিয়া মেডিকেল স্কুল রয়েছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অংশ। এই মেডিকেল স্কুল ও সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ডাক্তাররা কাজ করেন ও শিক্ষকতা করেন। সেই সাথে গবেষণার জন্য তারা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলোতে গবেষণা করেন। যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানা ফারবার ক্যান্সার ইনস্টিটিউট কিংবা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরভিং ক্যান্সার সেন্টারের কথা উদাহরণ হিসেবে ধরি, এই ইনস্টিটিউটগুলোতে বেশিরভাগ গবেষকরাই ডাক্তার। তারা কেউ শুধুই গবেষণা অথবা কেউ কেউ গবেষণা হাসপাতালে কাজ ভাগ করে করেন। আর তারা যেহেতু রোগী নিয়ে কাজ করেন তাদের জন্য ব্যবসা ও সমস্যাভিত্তিক গবেষণা করা আরো সহজ হয়ে যায়।
তার মানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো হলো জ্ঞান তৈরির মিলনমেলা যেখানে শিক্ষক, ডাক্তার, গবেষক, ইঞ্জিনিয়ার, ইন্ডাস্ট্রির লোক কিংবা মেকানিক সবাই একসাথে হয়ে জ্ঞান তৈরি করে। অথচ আমাদের মেডিকেল কলেজের ডাক্তারদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সংযোগ নেই এবং সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের গবেষণার কোনো জায়গাও নেই।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য ফান্ডিং দেয়ার মডেল কী হতে পারে?
গবেষণার ফান্ডিংও হতে হবে বিশেষ করে বাংলাদেশের সমস্যা ও দেশের মানুষের চাহিদাভিত্তিক গবেষণার উপরে। এতে করে ব্যবসাভিত্তিক ও সমাধানভিত্তিক গবেষক তৈরি হবে। বিদেশের বেশির ভাগ গবেষণা ফান্ডিং দেয়ার ক্ষেত্রে একটা কথার উত্তর উপর গুরুত্ব দেয়া হয় সেটা হলো এই গবেযণা দেশের কী কাজে লাগবে এবং কোন সমস্যার সমাধান করবে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের ফান্ডিং মডেল আছে যেটা নিয়ে বিস্তারিত আলাদাভাবে লিখতে হবে। তবে তিনটি মডেল নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলতে চাই।
প্রথমটি হলো সরকারি মডেল। এই ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়ার মেডিকেল রিসার্চ ফিউচার ফান্ড বা এমআরএফএফ মডেলটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সংক্ষেপে বললে এই ক্ষেত্রে সরকার আনুমানিক ১ বিলিয়ন ডলার বা ১০ হাজার কোটি টাকার মতো একটা থোক বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছে যেটা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখে দেয়া হয়েছে। প্রতি বছর এই টাকার উপর যে ইন্টারেস্ট আসে সেই টাকা গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। এর ফলে সরকারকে প্রতি বছর গবেষণার জন্য বাজেট থেকে বরাদ্দ দিতে হয় না। বাংলাদেশ সরকার ও বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল গবেষণার জন্য আলাদা ফান্ড তৈরি করে এই মডেল ফলো করতে পারে।
দ্বিতীয় মডেলটি হলো ইন্ডাস্ট্রি থেকে ফান্ডিং। প্রতি বছর সরকারি ও বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রিগুলো তাদের সমস্যা সমাধানের কিংবা নতুন কোন প্রডাক্ট ডেভেলপমেন্টের জন্য ফান্ডিং দিবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ একাডেমিকরা সেই ফান্ডিং দিয়ে তাদের সমস্যা সমাধান কিংবা প্রোডাক্ট ডেভেলপ করে দিবে। এতে ইন্ডাস্ট্রির সুবিধা হলো এই গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যবহার করে তারা অল্প পয়সায় তাদের সমস্যা সমাধান করতে পারবে। উন্নত দেশগুলোতে এই মডেলটির বেশ প্রচলন রয়েছে।
তৃতীয় মডেলটি হলো বিভিন্ন ট্রাস্ট/চ্যারিটি সংগঠন থেকে ফান্ডিং। আমাদের দেশে অনেক ট্রাস্ট/চ্যারিটি সংগঠন রয়েছে, যাদের কাজ হলো গরিব মানুষদের অন্ন বস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা। এটা অবশ্যই ভালো কাজ কিন্তু এই কাজগুলো সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের জন্যে সহায়ক নয়। এই সংগঠনগুলোকে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা বরাদ্দ দিতে হবে সমাজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের জন্য।
এই তিনটি মডেল দিয়ে গবেষণা ফান্ডিং শুরু করলে আশা করি আমাদের দেশের গবেষকদের গবেষণা করার ফান্ডিংয়েরও অভাব হবে না এবং গবেষণাও হবে ব্যবসা ও দেশের সমস্য ভিত্তিক। পরবর্তী পর্বে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মডেলের আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি নিয়ে কথা বলবো। সাথেই থাকুন।
[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত হবে]