মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০০:০০

ফিরতে চাই স্কুল জীবনে
অনলাইন ডেস্ক

আজ যা বর্তমান, আগামীকাল তা অতীত। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে অতীতের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি কী? যদি এক মুহূর্তর জন্যে অতীতে ফিরে যেতে হয় তবে কোথায় যেতে চাই? চোখ বন্ধ করে আমি বলবো, ‘স্কুল জীবন’। এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কিছু নেই।

সময় চলে গেছে বহুদূর! কিন্তু মনে হয় এইতো সেদিন আমরা ছোট ছিলাম। খুব ছোট। আহ্, কোথায় গেলো সে দিন? মাত্র কিছুদিন আগেও নীল জামা, নীল শার্ট পরে দু ভাইবোন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে দুর্গাকুমার পাঠশালায় যেতাম। দুজনের ছিলো এই ভাব, এই মারামারি। একটা বৃত্তির বই, তা নিয়েও হতো টানাটানি কাড়াকাড়ি। মানবজাতির শৈশবের অনন্য এক অধ্যায়জুড়ে আছে ভাইবোন। এমন ভাইবোনের জুটি আমাদের অনেকের পরিবারেই ছিলো, আছে। কারও বা ছিলো বোন। এখন যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুবান্ধব স্কুলজীবনের আলোচনা সামনে আনে, তখন আনমনে চলে যাই সেই শৈশব, কৈশোরে।

প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুলে যেতে যেতে পথ বদলে গেলো। ভাই চলে গেলো সরকারি পাইলট বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে, আর আমি গেলাম সরকারি অগ্রগামী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। পথে এলো একই স্কুলের, পাড়ার বান্ধবী রুবি। এক বছরের বড় হলেও তাকে নাম ধরে ডাকতাম। দাঁড়িয়া পাড়ার সরু গলি ধরে জনাকীর্ণ জিন্দাবাজারের পথে হেঁটেই পৌঁছে যেতাম স্কুলে। রিকশায় জ্যামে আটকে থাকার চেয়ে পায়ে হেঁটে আমরা পৌঁছে যেতাম ঠিক সময়ে। ঝড়, বৃষ্টি, শীত, গরম- এসব কোনো কিছুই সমস্যা ছিলো না। সকালের মিষ্টি রোদে বই হাতে ব্যাগ হাতে নিজের ছায়া দেখার মাঝেও আনন্দ ছিলো। মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যেতে যেতেও এসব স্মৃতি আমায় আনমনা করে।

সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়তো অনেক আগেই। সকাল দশটা বাজতেই ক্লাস শুরু। তার আগে জমা হতাম সবাই স্কুলের মাঠে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ দিয়ে শুরু হতো দিন। আকাশে-বাতাসে যেনো সত্যিই সে গানের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়তো। ড্রামের বিটে বিটে তাল মেলাতাম আমরা ছোট ছোট কিছু প্রাণ।

জিন্দাবাজারের বিশাল উঁচু দেয়ালঘেরা এই স্কুল আমার স্বপ্ন ছিলো। ভর্তি পরীক্ষায় উতরে যাওয়া কঠিন বিষয়। সে কঠিন কাজটা মেধা তালিকায় থেকে জয় করার পর অন্যরকম আনন্দ হয়েছিলো। স্কুলে ঢুকতে যাওয়ার আগে হাতের ডানে ছিল স্টেশনারি দোকান। সেখানে ভিউ কার্ড, স্ট্যাম্প- কত কী বিক্রি হতো। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে একটা ভিউ কার্ড কিনতে পারার আনন্দ ছিলো অন্য রকম। পাশেই চানাচুরের গাড়ি। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা দিয়ে সেই চানাচুর ছিলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মজাদার খাবার। মা-বাবার কাছে আমাদের বেশি কিছু চাওয়ার ছিলো না। টিফিনের জন্যে বরাদ্দ ছিল এক টাকা; সেও ছিলো অনেক বেশি। পাশেই পাঁচ পীর সাহেবের মাজার। মেয়েদের ভালো মার্ক ও পাস করানোর জন্যে তারা সচেষ্ট ছিলেন। বাবা শাহজালালের চেয়েও বেশি কাছে ছিলেন তারা। তাই মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় ভালো মার্ক পাইয়ে দেয়ার জন্যে সেই এক টাকার ভাগ তাদেরও দিতে হতো। কাজটা কোনো কোনো মেয়ে করেছে আমি জানি না। তবে আমি আর নেলী প্রায় সময় বার্ষিক পরীক্ষায় আট আনা পয়সা ঠিক ছেড়ে দিতাম। কেউ যাতে বুঝতে না পারে, সেটাও মাথায় থাকতো। এখন মনে হলে মাঝেমধ্যে হাসি পায়।

সিলেটে কালীঘাটে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষেই ছেলেদের পাইলট স্কুল। বলা যায় প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ এক স্কুল। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম এ স্কুলেই। কালিঘাট বাজারের ভেতর ট্রাকের আনাগোনা ছিলো বিরক্তিকর। নতুবা সব মিলিয়ে ছিলো অপূর্ব সুন্দর এক এলাকা। এ স্কুলের সঙ্গে একটা সংযোগ ছিলো নূরুল আলম চৌধুরী স্যারের জন্যে। স্যারকে বোধ করি ছেলেরা সিক্স মিলিয়ন স্যার ডাকতো, স্যারের হাঁটার স্টাইলের জন্যে। স্যারের কাছে আমরা প্রাইভেট পড়তাম। ব্লু বার্ডসংলগ্ন মেডিকেল কলোনিতে আমাদের শৈশব কেটেছে। স্কুলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছড়াটা ছিলো আমাদের প্রাণ। এ স্কুলের অনেক বন্ধুবান্ধবী পরে কলেজজীবনে অনেক কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। স্কুলের গল্প উঠলে সবারই ঝুড়ি থেকে এটা-সেটা বের হতো। তাছাড়া শৈশব থেকে আমার ভাই মামুনের জন্যেই অনেক ছেলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বরাবর ছিলো। ছোটবেলায় ছেলেগুলোর সঙ্গে তেমন কথা না হলেও বড় হয়ে অনেকের সঙ্গে দেখা হতো। কাউকে চিনতাম। কাউকে চিনতাম না।

ফয়েজ ছিলো মামুনের জানি দোস্ত। সেই প্রথম শ্রেণি থেকে। ওকে আর মামুনকে আলাদা করার তীব্র চেষ্টায় আমার মা ব্যর্থ হয়েছিলেন। পরে সে সম্পর্ক রূপ নিয়েছিল অনেকটা পারিবারিক বন্ধুত্বে, যা এখনো বহাল। তেমনি আমার অনেক বান্ধবীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ না থাকলেও আমার পরিবার ও ভাইদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। সুপ্রানা, আর ফখরুল ছিলো একই ক্লাসে। আমাদের মতোই ভাইবোনের জুটি। আরও অনেকে ছিলো, সবার নাম মনে নেই। সিলেটের ছোট শহরে সবাই আলাদা স্কুলের হলেও মোটামুটি চেনা-জানা ছিলো অনেক। একসময় বাসা বেশি দূর বলে মামুন বয়েজ স্কুল ছেড়ে দ্য এইডেড হাইস্কুলে ভর্তি হলো। এখানকারও চেনা-জানা অনেকে বন্ধু তার। কিশেরীমোহনে আমার পরিচিত তেমন কেউ নেই। বিশেষ করে বিজয় দিবস বা গার্লস্ গাইডের অনুষ্ঠানে অনেকেই একসঙ্গে জড়ো হতাম স্টেডিয়াম বা বিশেষ কোনো স্থানে। চেনা চেনা মুখগুলো কখনো আবার কলেজের করিডরে নতুন করে বাঁধা পড়েছে।

স্কুল ও বন্ধুত্বের মধ্যে এক সেতুবন্ধন আছে, যা এড়িয়ে যেতে পারে না কেউ। বন্ধুত্ব টিকে থাকে এক অদৃশ্য বন্ধনে; এক মায়ায়, যার নাটাই স্বয়ং বিধাতার হাতে হলেও এর মাতৃগর্ভ হলো স্কুল বা পাঠশালা। যে যতো বড়ই হোক না কেনো এখানে কারও কোনো পদবি নেই। এখানকার সব বন্ধু যেনো নির্মল এক ভালোবাসায় বাঁধা। আমরা খেলার সাথি, পড়ার সাথি- এটাই আমাদের পরিচয় শুধু। যখন হাই স্কুলে এলাম শ্রেণিকক্ষে অনেক নতুন মুখ; কাকে ছেড়ে কাকে ধরি? এ দেখতে সুন্দর তো ও মনের দিক থেকে খুব ভালো; সাহায্য চাইলেই অঙ্কের খাতা বাড়িতে দেয়। এখানেও ধাঁধা, কে ভালো বন্ধু হবে? সত্যি বলতে ভালো বন্ধুত্ব প্রকৃতির এক দান। ভালো বন্ধুদের তালিকায় এক নম্বরেই আসে একজনের নাম। আজ না হয় নামটা না-ই বললাম। কিন্তু বলা যায় অনেকেই ভালো বন্ধু। বিষয়টা শুধু আমার বা তোমার নয়; সবার ক্ষেত্রই প্রযোজ্য। আমাদের স্কুলজীবন কাটে মা-বাবার কঠিন শাসনের মধ্যে। বলা যায় রীতিমতো মা-বাবার বাধ্য গোলাম ছিলাম। তাদের সব কথা শুনতে, মানতে হবে। এর বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা কখনোই ছিলো না। তবুও কী আনন্দ ছিলো! কী মধুর ছিলো দিনগুলো! পরীক্ষার খাতায় মার্কস, বছর শেষে ফলাফল, পাস করা, না করা- এগুলো একটা ব্যাপার ছিলো; নতুবা সবাই সুখী। সেই সুখের জীবন পেছনে ফেলে সবাই এগিয়ে যায় জীবনের উজানে। কিন্তু মনের গহীনে স্বমহিমায় অম্লান হয়ে থাকে সেই শৈশব, সেই স্কুল, যার স্মৃতি এক লহমায় মুছে দিতে পারে যে কোনো গ্লানি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়