প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
আমি পুরানবাজার কলেজ ঘাট। আমার আবার আত্মকথা কী? প্রতিদিন কতো শত যুবক-যুবতী আমাকে স্বাক্ষী করে আসে যায়, তার খবর কে রাখে? প্রতিদিন শত শত যুবক-যুবতীকে পারাপার করে দিই। শুধু আমি পড়ে থাকি একাকী। আমার এক অভিশপ্ত জীবন। সবার কথা আমি শুনি কিন্তু কেউ আমার কথা শোনে না, শুনতে চায় না। ডাকাতিয়ার কূল ছাপিয়ে জলের কলকল শব্দ আমি নীরবে কান পেতে শুনি। অন্ধকার রাতে আমার খুব ভয় হয়। নিশি যামিনী কখন হয় অবসান সে প্রতীক্ষায় থাকি।
আজ তোমাদের আমার জীবনের কিছু স্মৃতি শোনাবো। শুনতেই হবে তোমাদের। মাইকেলের ভাষায় বলি
‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ ডাকাতিয়ার তীরে’।
কতো শত হাসি-কান্না, মিলন-বিরহের সাক্ষী আমি। আমি দেখেছি যুবক-যুবতীদের জীবন চলা। তাদের কষ্ট আমাকে বিষণœ করে তাদের আনন্দ আমাকে করেছে আনন্দিত। আমার বুকে ঠাঁই দিয়েছি সবাইকে। ডাকাতিয়ার বুক চিরে গগনবিদারী ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজের চলে যাওয়া, কলেজের ছুটির ঘণ্টা, যুবক-যুবতীর কলকাকলী আমাকে উদ্বেলিত করে সবসময়।
কত মানুষ আসছে, স্নান করছে, বেড়াচ্ছে, আরাধনা করছে। কেউ হয়তো একাকীত্বের মুহূর্ত কাটিয়ে দিচ্ছে। নদীর জল যে চলতে চলতে এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়াবে তাণ্ডও হওয়ার উপায় নেই। নদীকে বলি, তোরা বেশ আছিস। কত দেশ ঘুরিস। আমার তো কোথাও যাওয়ার জোঁ নেই। এই শহরটার সাথে একটু একটু করে আমিও পুরানো হয়ে যাচ্ছি। সারাদিন ধরে মানুষজনকে দেখি আর ভাবি মনের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলো বলার মতো যদি কাউকে পাই। আমি ডাকাতিয়া পাারে কলেজের সেই পুরাতন ঘাট। আজ ঠিক করেছি তোমাদের গল্প শোনাবো। আমার চোখে যে মুহূর্তগুলো লেগে থাকে, সে রকম কিছু খুব পরিচিত দৃশ্যই তুলে ধরবো তোমাদের সামনে।
ঐ যে দেখছো সেতু। এ সেতু নির্মাণ হওয়ার পর যুবক-যুবতীদের খুব কম দেখা পাই। আমার ব্যস্ততা এখন কমে গেছে। কালের আবর্তনে আমিও হারিয়ে যাবো একদিন। আমার বুকে থেমে যাবে মানুষের পদচারণা। আমি নিঃস্ব। আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ঘনিয়ে আসছে। প্রতিদিন কতো শত মানুষ পার হয় সেতু দিয়ে। আমাকে সবাই ভুলে যাচ্ছে। শুনেছি আমাকে আবার নতুন রূপে সাজানো হবে। কতো দামী দামী টালি বসবে আমার বুকে। আমার সে কি আনন্দ। যুবক-যুবতীরা পড়ন্ত বিকেলে বিশ্রাম নিতে আসবে। সূর্যাস্তে ফিরে যাবে এই তো আমার আনন্দ।
আমাকে আবার নতুন করে রূপ দেবার চেষ্টা হচ্ছে। আমাকে সাজানো হচ্ছে নতুন রূপে। আমার কী আনন্দ। আমার দু পাশে কৃষ্ণচূড়া লাগানো হয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুল দেখতে অনেকে এসে আমার বুকে বসে। এবার গাছটায় অনেক জারুল ফুটেছে। এখানে নাকি দামি টালি বসানো হবে, দৃষ্টিনন্দন করা হবে। আমি খুব উৎফুল্ল হই। আমি আমার পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবো। কতো কপোত-কপোতী এসে একদণ্ড বসবে এখানে। কে যেনো আমার কানে কানে এসে বললো, এখানে একটি হিজল গাছ লাগানো হবে। খুব ভালো হবে। তার ছায়ায় আমি দুদণ্ড বিশ্রাম নিবো। হিজল গাছের ডাল এসে নুয়ে পড়বে ডাকাতিয়ার জলে। দুরন্ত ছেলেরা নদীর বুকে সাঁতার কাটবে আর গাছের ডাল নিয়ে খেলা করবে। আমি অপলক তাকিয়ে থাকবো।
আমার জীর্ণদশা দেখে অনেকেই আমাকে অবজ্ঞা করতো। আমাকে নতুন করে সাজাবার পর কত শত মানুষ আসে আমাকে দেখতে। আমিও যেনো আমার যৌবন ফিরে পেয়েছি।
এইতো সেদিন দেশের শিক্ষামন্ত্রী এসেছিলেন। কোলাহলে পূর্ণ হয়ে গেলো ক্ষণিকের মধ্যে। তখন সূর্য অস্তমিত গিয়েছে আঁধার নেমে এসেছে। তিনি আমার উপরে দুদণ্ড দাঁড়ালেন। আমার অব্যক্ত কথাগুলো তাকে শোনাতে চেয়েছিলাম, বলতে চেয়েছিলাম, তিনি কি পাষাণের কথা শুনবেন?
এর কিছুদিন আগে এসেছিলেন আইসিটি মন্ত্রী পরিবারসহ। আমার পরে দুদণ্ড বসেছিলেন। আমার চত্বর আবার কোলাহলে পূর্ণ হয়ে গেলো। কানে কানে অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কোনো কথাই বলা হলো না।
শহর থেকে কতো ফটোগ্রাফার আসবে আমার ছবি তুলতে। আমার খুব ভালো লাগে। তরুণ প্রাণের উচ্ছ্বাস-আবেগ আমাকে প্রসন্ন করবে। আমাকে সাক্ষী করে নৌবিহারে বের হবে সবাই। বেশ সুন্দর লাগে সবাইকে একসাথে দেখতে। কতো জায়গার, কতো দেশ বিদেশের মানুষ। ভাবি, এতো পুরানো হয়ে গেছি আমি, এই নদী, এই শহর। তাণ্ডও এতো মানুষ আসে কীসের টানে? ভেবে পাই না কাকে জিজ্ঞেস করব, কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর পাবো।
মাঝি নাদের আলী প্রতিদিন নৌকা বাঁধে আমার তরে। গালে হাত দিয়ে কী যেনো ভাবে। আমার ইচ্ছে করে বলি তুই এতো ভাবিস কী? লাভ-লোকসান, আজকের ব্যবসা না অন্য কিছু? আমার তো নিজের কোনো চিন্তা নেই, তাই সবার হয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে। আমি সবার ব্যস্ততা দেখি কিন্তু আমার কোনো ব্যস্ততা নেই। আমি সকলের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। এবার দুদণ্ড বিশ্রাম দাও আমাকে।