প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষক জাতির মস্তিষ্ক। আর শিক্ষার্থী জাতির সমৃদ্ধি অর্জনের হাতিয়ার। এই তিনটি নিয়ামকের মধ্যে সমন্বয় সাধনই কেবল দিতে পারে একটি অপ্রতিরোধ্য উন্নত জাতি। কিন্তু বর্তমান সময়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যে চমৎকার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। দুই পক্ষই একে অন্যের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। শিক্ষাকে দ্বিধাহীন ছন্দে এগিয়ে নিতে এ অবস্থার পরিবর্তন অপরিহার্য।
বর্তমান সময়ে মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে শিক্ষকরা যা পড়ান, তা কখনো প্রশ্ন হিসেবে পরীক্ষায় থাকে না। তাঁরা ক্লাসে পড়ান একভাবে। গাইড দেখে সৃজনশীল প্রশ্ন করেন ভিন্নভাবে। ফলে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্র লিখতে নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষকদের প্রতি এক ধরনের অসন্তোষ দেখা যায়। এই অসন্তুষ্টির কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রতি বিনয়ী বা অনুগত থাকছে না। আবার বিনয়ী বা অনুগত না থাকার কারণে এবং শাসন করার প্রথা উঠে যাওয়ায় শিক্ষকরাও একধরনের হতাশায় ভুগছেন।
আগের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী ও উদাহরণসমূহের সমাধান জানলেই পরীক্ষায় পাস করা বা ভালো করা কঠিন ছিলো না। কিন্তু এখন অনুশীলনী ও উদাহরণগুলো ভালোভাবে শেষ করার পরও সৃজনশীল প্রশ্নের মারপ্যাঁচে শিক্ষার্থী পাস করবে না ফেল করবে তা বলা কঠিন। ফলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যাচ্ছে, ক্লাসে মেধাতালিকায় প্রথম দিকের শিক্ষার্থীরাও বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছে। কেনো এমনটি ঘটছে! এটা কি শিক্ষকের দক্ষতার ঘাটতি, নাকি শিক্ষার্থীর অপারগতা, নাকি শিক্ষা পদ্ধতির ত্রুটি?
আমি আগেই বলেছি, একজন শিক্ষক ক্লাসে যা পড়ান তা পরীক্ষায় প্রশ্ন হিসেবে আসে না। তাহলে ওই পাঠ পড়ে লাভ কী? এমন ভাবনা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে আসতেই পারে। এমন ভাবনা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীকে অমনোযোগী করে তুলছে। তাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও শিক্ষকের উপস্থিতি। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি, পড়াশোনায় আগ্রহী কোনো শিক্ষার্থী যদি শিক্ষককে বলেন যে ‘স্যার, সৃজনশীল প্রশ্নে যে অঙ্কগুলো সাধারণত পরীক্ষায় আসে, সেগুলো বইয়ে থাকে না। এগুলো একটু যদি সমাধান করে দিতেন তাহলে ভালো হতো।’ শিক্ষকের সোজাসাপ্টা উত্তর, ‘গাইডের সৃজনশীল প্রশ্নের কোনো সমাধান বোঝানো বা করানো আমার দায়িত্ব না। ওগুলো নিজ উদ্যোগে করতে হবে।’ এমন উত্তর নিঃসন্দেহে শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর হৃদ্যতাপূর্ণ শ্রদ্ধার সম্পর্ক তৈরি করে না। এক্ষেত্রে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড হতাশ এবং অসহায় অবস্থার মধ্যে থাকে। যে শিক্ষার্থীরা মেধাবী ও অসচ্ছল তারা নিজে পড়ে এই বিপর্যস্ত অবস্থা পাড়ি দিতে চায়। আর যাদের সংগতি আছে তারা কোচিং এবং প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করে এই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। ফলস্বরূপ যা ঘটার কথা ঠিক তা-ই ঘটে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখলাম, মাধ্যমিক শ্রেণির ৭৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২৮ জন পাস। বাকি ৫০ জন অকৃতকার্য হয়েছে।
এখানে শিক্ষকদেরও শারীরিক ও মানসিক শক্তির সীমাবদ্ধতার কথা সহানুভূতির সঙ্গে ভাবতে হবে। একজন শিক্ষক শিক্ষা বোর্ডের চারশ’ পৃষ্ঠার একটি বই থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন। এরপর আবার হাজার পৃষ্ঠার গাইডবই পড়ানোর মতো সময় বা সুযোগ কোনোটাই শ্রেণিকক্ষে বাস্তবিক অর্থে থাকে না। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েই গড়ে উঠছে অফলাইন ও অনলাইন কোচিং সেন্টার। আমার এক বন্ধুর শ্যালক ইউটিউবে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে কোচিং করায়। ছেলেটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কোচিং থেকে তার এক বছরের আয়ের আয়কর দিতে হয়েছে ১২ লাখ টাকা। এবার বুঝে নিন, শিক্ষা কি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের হাতে আছে!
শিক্ষা চলে গেছে কোচিং সেন্টার অথবা প্রাইভেট টিউশনির কবজায়। কারণ সেখানে গাইড ঘেঁটে বছরভিত্তিক প্রশ্নের সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিরন্তর অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই শিক্ষা পদ্ধতির কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের সময় স্কুল বা কলেজে গিয়ে শিক্ষকদের ক্লাস মনোযোগ দিয়ে শুনলে ও লিখে নিলে ফেল করা তো দূরের কথা; বরং পরীক্ষায় ভালো ফলের সম্ভাবনাই বেশি থাকতো। কিন্তু এখন ক্লাসে মনোযোগী হয়ে শিক্ষকের পাঠদান হুবহু তুলে নিলেও খুব একটা লাভ হয় না। কারণ প্রশ্ন তো সৃজনশীল। যার দু-একটি উদাহরণ বইয়ে সন্নিবেশিত। কিন্তু সব প্রশ্ন পেতে হলে গাইডবই অপরিহার্য। এ অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর দর্শন ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ¯েœহ-ভালোবাসার মেলবন্ধন না হয়ে ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। যেখানে শিক্ষার্থী ভাবছে ক্লাস না করে এই সময়টা কোচিং করলে পরীক্ষায় ভালো করা যেতো। আর শিক্ষক ভাবছেন শিক্ষার্থীদের যে কোনোভাবে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত করতেই হবে।
এমন বিপরীতমুখী ভাবনা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কে সংকট তৈরি করছে। শিক্ষণীয় কোনো বিষয় অনুধাবন ও আত্মস্থ করার ক্ষেত্রে অংশীজনের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু শিক্ষার পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে শিক্ষা পরিবারের অংশীজনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন সময়ে হতাশায় ভুগছে এবং কখনো কখনো আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে।
সম্প্রতি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের একজন শিক্ষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে শিক্ষার্থীরা কেমন করছে? তিনি বললেন, মোটের ওপরে ভালো। তবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রোগ্রাম তুলে দিয়ে ওই প্রোগ্রামের আউটপুট জানতে চাইলে অনেক শিক্ষার্থীই তা না পারলেও প্রশ্নপত্রে দেয়া প্রোগ্রামটিই হুবহু তুলে দেয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা মনে করে যেহেতু কিছু লিখে দিয়েছি, পরীক্ষক নম্বর দেবেনই। প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক কিছু লিখলেই নম্বর পাওয়া যায় এ ধারণাটা তাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অভ্যস্ততা থেকেই এসেছে বলে অনেকের ধারণা।
তবে আশার কথা, এই যে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বর্তমান সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা উপলব্ধি করে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এর ফলে শিক্ষা ফিরে যাবে স্কুল-কলেজের শ্রেণিকক্ষে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক নতুন করে গড়ে উঠবে।
ড. মোঃ নাছিম আখতার : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।