প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২২, ০০:০০
স্কুলের কথা মনে হলেই স্মৃতির মধ্যে ঘোরাফেরা করে অনেক কথা। অনেক গল্প। এখন প্রায় যার সবটাই অতীত। অতীতের জানালা খুললে দেখতে পাই মুসলিম স্কুলের হলুদ দালান, খেলার মাঠ, মাঠ সংলগ্ন পুকুর। দক্ষিণে ঈদগাহ। আরও দক্ষিণে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ। পশ্চিমে মিউনিসিপ্যালিটির পুকুর, আরও পশ্চিমে ‘কুষ্টিয়া কোর্ট’ রেলওয়ে স্টেশন। উত্তরে স্কুলের হোস্টেল, আরও উত্তরে রেললাইন, রেললাইন পার হলে মিউনিসিপ্যালিটি বাজার। আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস টু –তে। খুব ছোটো আমি। ঊনিশ শ সত্তর সালে। আব্বা হাত ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
তাঁর আগে আম্মার কাছে পড়েছি আদর্শলিপি, বর্ণমালা, ছড়া, কবিতা, রূপকথা। আব্বার পুস্তক প্রকাশন ছিল, বইয়ের বড়ো ব্যবসা ছিল। বাড়িতে বইয়ের অভাব ছিল না। কিন্তু স্কুল কী জানতাম না। স্কুলের শিক্ষক সম্পর্কেও ধারণা ছিল না। শিক্ষকেরা ভালো না-খারাপ, তারা কতটা ভালোবাসার মানুষ— এসব মনেই হয়নি।
স্কুল সম্পর্কে আমার ধারণা ছিলই না, ওই বোধ-বুদ্ধিরও বয়স তখন না। মাত্র পাঁচ/ছয় বয়স। ভর্তি হয়ে গেলাম মুসলিম হাই স্কুলে। সেই যে ভর্তি হলাম টু-তে, তারপর— থ্রি ফোর ফাইভ সিক্স সেভেন এইট নাইন টেন— এসএসসি পর্যন্ত।
স্কুলের সহপাঠী সবাই ছিলাম অপরিচিত। পরে আমাদের মধ্যে দিনে দিনে ঘনিষ্ঠতা হয়। স্কুল জীবনের বন্ধুদের কোনোদিনই ভোলা যায় না। স্কুলের শিক্ষকদের ভালোবাসায় আপ্লুত স্নেহ ভোলবার নয়। স্কুলে প্রতিটি বিষয়ে অসাধারণ সব শিক্ষক পেয়েছিলাম।
স্কুল নিয়ে আমি আগেও লিখেছি। আমার সকল শিক্ষকদের নিয়েও লিখেছি। আজ শুধু প্রধানশিক্ষককে নিয়ে লিখবো। তাঁর কাছে আমার সবচেয়ে বেশি ঋণ। তিনি না হলে আমার স্কুলে পড়ালেখা হয়ত হতো না।
একটা জাতির জীবনে একজন শিক্ষক অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
আমার নিজের জীবনে সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য কী ? এটা যদি কেউ জিগ্যেস করে তাহলে বলবো, আমি আমার জীবনে ওয়ারেস হোসেনের মতো শ্রেষ্ঠ শিক্ষক পেয়েছি। ওয়ারেস স্যার সমস্ত পৃথিবীকে আমাদের চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিতেন। এবং তারপরে সে অশ্বারোহীর মতো সেই পৃথিবীর ওপর দিয়ে ছুটতে থাকতেন। আমরা তাঁর পেছনে পেছনে ছুটতাম পাগলের মতো— কী বলছেন, কী পড়াচ্ছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতামৃ আমদের একবার এখানে নিয়ে যাচ্ছেন, আরেকবার ওখানে নিয়ে যাচ্ছেন— আমরাও মুগ্ধের মতো তাঁর পেছনে পেছনে ছুটে যাচ্ছি, তাঁকে অনুসরণ করছি, হঠাৎ দেখতাম ঢং ঢং বেল পড়ে গেছে। পয়তাল্লিশ মিনিটের ক্লাসকে মনে হতো দশ মিনিট ! মনে হতো স্কুলের পিওন লোকমান চক্রান্ত করে বেল বাজিয়ে দিয়েছে !! এতটাই অসাধারণ শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্পোর্টস এমন কোনো বিষয় নেই যে তিনি আমাদেরকে ধারণা দিতেন না। তবে তাঁর ক্লাস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। তিনি যেহেতু প্রধান শিক্ষক ছিলেন তাই তাঁর রুটিন মাফিক ক্লাস পাইনি। তিনি কোনো কোনো শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে আমাদের ক্লাস নিতেন।
‘একটা স্কুল, একটা কলেজ, একটা বিশ্ববিদ্যালয়— সেখানে দালান থাকে, টেবিল থাকে, চেয়ার থাকে, আসবাবপত্র থাকে, মাঠ থাকে, শিক্ষক থাকে, ছাত্র থাকে, ব্ল্যাকবোর্ড থাকে, চক থাকে, ডাস্টার থাকে, (আজকাল মাল্টিমিডিয়াও থাকে), লাইব্রেরি থাকে, কত কিছু থাকে— কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো হলো-- শিক্ষক। একটি শিক্ষাঙ্গণের সবচেয়ে বড়ো সৌন্দর্য হলো ভালো শিক্ষক। একজন শিক্ষক যদি ভালো হন, বড়ো হন তাহলে সমস্ত জাতি যুগ যুগান্ত বড়ো হয়ে যায়’।
‘একজন সক্রেটিস জন্মেছিলেন বলে একজন প্লেটো জন্মেছিলেন, একজন প্লেটো জন্মেছিলেন বলে একজন অ্যারিস্টটল জন্মেছিলেন, একজন অ্যারিস্টটল জন্মেছিলেন বলে একজন আলেকজান্ডার জন্মেছিলেন। সেই আলেকজান্ডার বিশ্বকে যে নতুন মাত্রার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন তা অবাক হওয়ার মতো। সক্রেটিস ছিলেন সকল শিক্ষকের শিক্ষক। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ছাড়াও সক্রেটিসের আরেকটি ধারা আছে। তাঁর একজন শিষ্য ছিলেন ক্লিসথেনিস। এই ক্লিসথেনিস ছয় মাইল দূরে থাকতেন।
শুধু সক্রেটিসের কথা শুনার জন্য পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এই ক্লিসথেনিস প্রত্যেকদিন এথেন্সের বাজারে আসতেন। এই ক্লিসথেনিসের শিষ্য ছিলেন ডায়োজেনিস, খুবই বিখ্যাত মানুষ, ডায়োজেনিসের শিষ্য ছিলেন জেনো। এই জেনো ছিলেন স্টোইক ফিলোসফির উদ্গাতা। যে স্টোইক ফিলোসফী পরবর্তীকালে সমস্ত রোমান সম্রাজ্য এবং সমস্ত ইউরোপকে অভিভূত করে রেখেছিল প্রায় এক হাজার বছর। সুতরাং একজন শিক্ষক যে কত বড়ো তা বলে বুঝানো যাবে না। পৃথিবীতে বড়ো মানুষ মাত্রই শিক্ষক’।
ওয়ারেস স্যার ছিলেন বড়ো মাপের একজন শিক্ষক।