মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

প্রসঙ্গ : শিক্ষা কারিকুলাম
অনলাইন ডেস্ক

শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই এই বিতর্ক দীর্ঘদিনের। শিক্ষাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, শিল্প ও আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব, কর্মোপযোগী এবং সর্বোপরি বিনোদনমূলক করার লক্ষ্যে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে সরকার। ২০২৩ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে এটি কার্যকর হবে। নতুন কারিকুলামে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত থাকবে না কোন পরীক্ষা, থাকবে না পিইসি-জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষাও। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শ্রেণীকক্ষে শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সমাজ ও বিজ্ঞান বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন করা হবে ৬০ ভাগ।

বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়ন বা পরীক্ষা হবে ৪০ ভাগ। ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ধর্ম ও শিল্পসংস্কৃতি বিষয়গুলোতেও হবে শ্রেণীকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন। নম্বর বণ্টনে এই হার কিছুটা পরিবর্তন হবে নবম ও দশম শ্রেণীতে। এক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান ও গণিতে শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ ভাগ আর সামষ্টিক বা পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে ৫০ ভাগ। থাকবে না বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষার মতো কোন বিভাগ বিভাজন। আরও একটু পরিবর্তন এসেছে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে। আবশ্যিক বিষয়গুলোয় শ্রেণীকক্ষে শিখনফলের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে ৩০ ভাগ আর চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে ৭০ ভাগ।

৭০ ভাগের ওপরই ছাত্র-ছাত্রীদের পাবলিক পরীক্ষা দিতে হবে। ঐচ্ছিক বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিতেই শ্রেণিকক্ষে শিখনফলের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। প্রতি বর্ষের শেষে আলাদা চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়া হবে। দুই বর্ষের উপরোক্ত সব পরীক্ষার নম্বর একত্রে করে দেয়া হবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল।

জাতীয় দিবসগুলো খোলা রাখার নিয়ম রেখে সপ্তাহে দুই দিন ছুটির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সে হিসাবে মোট ১৮৫ দিন কর্মদিবস বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীতে দেশের ৬২টি স্কুল, কারিগরি ও মাদ্রাসায় পাইলটিং কার্যক্রম এখন চলছে। এই পাইলটিং থেকে ফিডব্যাক নিয়ে চূড়ান্ত ও সঠিক কারিকুলাম প্রণয়ন করা হবে, যা ২০২৩ সাল থেকে কার্যকর। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে, ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণীতে, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণীতে এবং ২০২৬ ও ২০২৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে বাস্তবায়ন করা হবে।

ধর্মীয় শিক্ষা সবসময় ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনকালেই ধর্মীয় শিক্ষা বাদ দেয়া হয়নি। সর্বোপরি, গতানুগতিক পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভর পড়াশোনার পরিবর্তে পারদর্শিতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নতুন কারিকুলামে। শিক্ষার্থীরা সমাজ ও শিক্ষকদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে নিজেরা হাতে-কলমে শিখবে। পাশাপাশি তারা প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ ও যোগ্য হবে, মানবিক বোধসম্পন্ন শিক্ষার্থী হয়ে উঠবে এবং জাতীয় লক্ষ্য অর্জন করে শান্তিপূর্ণ সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে উদ্বুদ্ধ হবে।

প্রায় দেড় বছর (৫৭১ দিন) পর শ্রেণীকক্ষে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। করোনাকালে শিক্ষাব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য পরিস্থিতির বিবেচনায় মাননীয় মন্ত্রী ও মন্ত্রণালয় নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অনলাইন, অফলাইন, সপ্তাহে একদিন-দুইদিন ক্লাস, এসাইনমেন্ট, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা, অটোপাস ইত্যাদি। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পর ক্লাস-পরীক্ষা যখন পূর্ণোদ্যমে শুরু হলো, তখনই আবার করোনার নতুন আক্রমণ (চতুর্থ ঢেউ) দেখা দিল। আসল বন্যা, পিছিয়ে গেল এসএসসি পরীক্ষা। দেশে আরও আছে খরা-বৃষ্টি-শীত-গ্রীষ্ম-ঈদ ও পূজার ছুটি।

এসব কিছুর জন্য প্রথম ধাক্কাটা আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সম্প্রতি বন্যায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ভেসে গেছে, বই-পুস্তকসহ বাড়িহারা হয়েছে পুরো সিলেটবাসী। এখন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে মেরামত করা হচ্ছে, শিক্ষার্থীর হাতেও নতুন আরেক এক সেট বই দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

করোনাসহ এতোগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নবপ্রণীত কারিকুলাম নিয়ে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। যদিও নতুন কারিকুলাম প্রকাশের পর থেকেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রণীত হয়েছিল। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর পূর্বে ৬টি কমিশন কাজ করেছিল। সব কমিশনই নানা আলোচনা ও সমালোচনার মুখে পড়েছিল। বর্তমান কারিকুলাম নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হবে এটাই স্বাভাবিক।

শিক্ষা কারিকুলাম একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন-পরিমার্জন হবে ভবিষ্যতেও। তবে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করতে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক তা একেবারে নিশ্চিন্তে বলা যায়। কারণ শিক্ষায় এই সরকারের অনেক অবদান লক্ষণীয়। পহেলা জানুয়ারি একযোগে বই বিতরণ, শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত, বিশেষ করে নারী শিক্ষায় ও সক্ষমতায় অসামান্য অগ্রগতি ইত্যাদি। সম্প্রতি সরকার ২৭১৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে, ২০১৩ সালেও এই সরকার ২৬ হাজার ১৯৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ হাজার ১৬০টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন।

প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষালাভের জন্য বর্তমান সরকার পর্যায়ক্রমে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপন করে চলেছেন একের পর এক দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাবরেটরি ইত্যাদি। শিক্ষা উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতায় প্রণীত হয়েছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী বিশ্বমানের এই শিক্ষা কারিকুলাম, যেখানে ছিলেন দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদগণ, সময়ও লেগেছে বেশ। পরীক্ষাধীন এই কারিকুলামেও ভুলত্রুটি ভাল-মন্দ থাকতে পারে। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা বাদ দেয়ার ফলে প্রাইভেট ও কোচিং প্রবণতা কমে আসবে। আবার একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে আলাদা আলাদা পরীক্ষা রাখার ফলে বিষয়গুলো অল্প সময়ে আয়ত্তে আনতে কষ্ট হবে, বিশেষ করে বিজ্ঞান বিষয়গুলো। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো এবং শিক্ষক সমাজ কতটুকু প্রস্তুত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে (প্রয়োজনীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলছে) শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে ধাবিত হয় কিনা, তা দেখার বিষয়ষ এজন্য মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে।

অন্যথায় নতুন কারিকুলাম সাফল্যের মুখ দেখবে না প্রয়োজনে শহর থেকে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের তিন থেকে ছয় মাসের জন্য গ্রামের প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক চাকরি করার বিধান রাখা যেতে পারে। যাবতীয় একাডেমিক কার্যক্রমের আকর্ষণীয় ওয়েবসাইট (বাংলা ও ইংরেজিতে সাউন্ডসহ) যেখানে বেতন দেয়া, বৃত্তির টাকা উত্তোলন, উপস্থিতির হিসাব, নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে ক্লাস পরীক্ষা শেষ করে চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুত করে মোবাইল ফোনসহ অনলাইনে প্রকাশ করা এবং শিখনকালীন ও চূড়ান্ত পরীক্ষা মূল্যায়নের সফটওয়্যার প্রস্তুত থাকতে হবে।

যুগোপযোগী কারিকুলাম এবং ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শাসন করবে, আদেশ-উপদেশ দেবে এটাই স্বাভাবিক। প্রযুক্তির অপব্যবহারে আজকাল অনেক শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হয়ে তৈরি করছে টিকটক। এসব নিয়ে সম্প্রতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলা-জেল-জরিমানা ঘটেছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। শিক্ষার্থীদের শাসন করার ঘটনা বা কথোপকথন শিক্ষার্থী মোবাইলে ধারণ ও ভাইরাল করে ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ককে কলঙ্কিত করা ঠিক নয়। বরং ছাত্র-শিক্ষকের সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সকলের সহযোগিতা সব সময় কাম্য। এখানে ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব অপরিসীম এবং কমিটিতে থাকতে হবে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ। কারণ আজকাল প্রাইমারীর শিক্ষকও কমপক্ষে ডিগ্রি পাস হয়ে থাকে।

হাইস্কুলে মাস্টার ডিগ্রির নিচে কোন শিক্ষক নেই। আর কলেজে তো মাস্টার ডিগ্রি বাধ্যতামূলক। তাহলে কমিটির সদস্য কিংবা সভাপতি ওই প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের চেয়ে কম শিক্ষিত হলে কি চলে? কিন্তু বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসএসসি-এইচএসসি পাস করা (কিংবা আরও কম) ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি তার স্কুলের উচ্চশিক্ষিত শিক্ষকদের কথায় কথায় চড়-থাপ্পড় মারে, চাকরি থেকে বহিষ্কার ও নানাভাবে হয়রানি করে। যদিও বর্তমান আইনে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন স্থানীয় সংসদ সদস্য, কিন্তু তিনি একা এত প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না বিধায় তার মনোনীত কেও থাকেন। সে রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষিত শিক্ষকের কাছে কতটুক বিবেচ্য তা ভাবা দরকার।

দলীয় বিবেচনায় হলেও সে যেনো উচ্চশিক্ষিত ও শিক্ষানুরাগী হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ সবকিছুর বিবেচনায় প্রণীত নতুন কারিকুলামটি বাস্তবায়ন হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখবে, হবে সে সংস্কৃতিমনা, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী, দেশ-প্রেমিক ও বিশ্বমানের নাগরিক।

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার : অধ্যাপক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়