মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২২, ০০:০০

শিক্ষকদের নিরাপত্তা
অনলাইন ডেস্ক

নিজ জীবনের সরাসরি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়মিত পরিদর্শনের ওপর ভিত্তি করে বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের জানানোর নিমিত্তে এবং নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে পত্রিকার পাতায় আশ্রয় নিই। কিছু পত্রিকা গুরুত্ব সহকারে সেগুলো ছেপেও দেয়। কিছু কিছু শিক্ষক এবং শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা সেগুলো পড়েন, তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। আবার কেউ কেউ উল্টো কথা লেখেন, বিভিন্ন মাধ্যমে জানান। এসব দিয়ে কী হবে, আসল কথা লেখেন। শিক্ষা জাতীয়করণ কবে হবে সেটা লেখেন। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির কথা লেখেন। যদিও আমার বহু লেখায় শিক্ষা জাতীয়করণের কথা, যুক্তিসহ তুলে ধরেছি। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি কেনো দরকার তা লিখেছি। কিন্তু সব লেখায় তো আর একই কথা লেখা যায় না। সব লেখার টপিক এবং বিষয়ও এক নয়। শিক্ষকদের অবস্থার উন্নয়ন আমরা সবাই চাই। আবার শিক্ষকদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়া, শ্রেণিকক্ষে ও বাইরে একজন শিক্ষককে সে ধরনের ভূমিকায়ও সমাজ দেখতে চায়।

কিন্তু ইদানীং সব ঘটনাকে ছেপে একটি বিষয় প্রতিদিনই পতায় দেখছি। দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষকরা কমিটির সদস্যদের হাতে, কিংবা রাজনৈতিক কোনো নেতার হাতে, তথাকথিত ছাত্রনেতাদের হাতে, অভিভাবকের হাতে এমনকি শিক্ষার্থীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, অপমানিত হচ্ছেন, শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। এটি কেমন বিষয়? একজন শিক্ষক তা সে যে কোনো পর্যায়েরই হোক, যে কোনো বিষয়েরই হোক তিনি শিক্ষকই। তার গায়ে মানুষ কীভাবে হাত তোলে? আর সমাজ ও রাষ্ট্র সেটিকে নিয়ে রাজনীতি করে, কালক্ষেপণ করে? আমাদের দেশের শিক্ষকদের আমরা অতিশয় সম্মান প্রদর্শন করে আসছি যুগ যুগ ধরে, এটি আমাদের কালচার। পশ্চিমা দুনিয়ায় শিক্ষকদের আমাদের মতো সম্মান প্রদর্শন করে না কিন্তু শিক্ষকের গায়ে হাত দেয়া তারা কল্পনাও করতে পারে না। তাহলে সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে?

আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে শেখাই কীভাবে তারা একটি শ্রেণিকক্ষকে, বিদ্যালয়ের পরিবেশকে শিক্ষার্থীদের জন্যে নিরাপদ রাখবেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। একটি শ্রেণিকক্ষকে কীভাবে সব ধরনের শিক্ষার্থীর জন্যে নিরাপদ করা যায়, সব শিক্ষার্থী যাতে নির্ভয়ে, কোন ধরনের ইতস্তত না করে শ্রেণি-কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে সে ধরনের একটি পরিবেশ একজন শিক্ষককে তৈরি করতে হয়। এ ধরনের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে সাহস জোগাবে, কোনো কিছু না বুঝলে সত্যিকারভাবে বোঝার জন্য শিক্ষকের শরণাপন্ন হবে, শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেবে না, ক্লাসে আসার জন্য উদ্গ্রীব থাকবে, শিক্ষা হবে আনন্দময়। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেখে নিজের দুঃখের কথা ভুলে যাবেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে বন্ধুত্বপূর্ণ, হৃদ্ধতাপূর্ণ সম্পর্ক এবং বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে সেটি শ্রেণি-কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীদের বোঝাতে হবে যে, আপনি শ্রেণিকক্ষে কিংবা বিদ্যালয়ে আছেন শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের সহায়তা করার জন্য, তাদের কথা শোনার জন্য এবং তাদের গল্প জানার জন্য। তাদেরকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতে হবে, জানতে হবে। তাদের পছন্দ অপছন্দ জানতে হবে, কিসে তারা মজা পায়, কিসে তারা ভয় পায়-এগুলো জানা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা তাদের একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষেই প্র্যাকটিস করাতে হবে যে, একে অপরকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। একজন শিক্ষার্থী যদি কোনো ভুল উত্তরও দেয় তাহলে কেউ যাতে তাকে হাসি ঠাট্টার পাত্র না বানায়, তাকে ক্লাসে লজ্জা না দেয়। বোঝাতে হবে যে আমরা সবাই এখানে একে অপরের কাছ থেকে শেখার জন্য এসেছি। আমরা ভুল করে করে শিখি। সহনশীলতার অভ্যাস শ্রেণিকক্ষ থেকেই অনুশীলন করাতে হবে। তাহলে দুর্বল ছেলেটি, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী, লাজুক শিক্ষার্থীও শ্রেণিকক্ষকে নিরাপদ মনে করবে।

উপরোক্ত বিষয়গুলো আমরা এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আলোচনা করি। কিন্তু শিক্ষক নিজেই যদি শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তাহলে তিনি কীভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবেন। কথাটি বারবার মনে আসছে। বিদ্যালয় তো একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা শিক্ষাব্যবস্থায় মেধাবীদের অংশগ্রহণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের শিক্ষক সমাজের কর্মপরিবেশ এবং কর্মসন্তুষ্টির মাত্রার ওপর শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের শিক্ষকরা দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তটস্থ থাকেন শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতায়, যা তাদের কর্মস্পৃহাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। অতিসম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের? কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সভ্যতাকে, জাতিকে টিকিয়ে রাখবে যেখানে মানুষ গড়ার কারিগরদের পদে পদে অপদস্থ হতে হচ্ছে সমাজের বখাটেদের কাছে? ১৩ এপ্রিল গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জোহরের নামাজ শেষে কলেজ মসজিদ থেকে বের হয়ে কয়েক যুবককে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে বেপরোয়াভাবে মোটরবাইক চালানোরত অবস্থায় দেখতে পান। ফলে স্বীয় দায়িত্ববোধ থেকেই অধ্যক্ষ মহোদয় যুবকদের থামিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে এভাবে বাইক চালাতে নিষেধ করেন। এতেই যুবকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ মহোদয়কে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে শুরু করে। এরা কাদের সন্তান? বুঝতে কষ্ট হয় না। এরা জানে যে, এদের কিছু হবে না। এরা এ ধরনের ঘটনা আরো ঘটিয়েছে। একজন শিক্ষক তো শুধু ক্যাম্পাসের নয়, সমাজের নেতা, সমাজের অভিভাবক। তিনি সমাজে যে কোনো ধরনের অঘটন ঘটতে দেখলে বাধা দেবেন, এটিই তার ধর্ম, এটিই তার কর্ম, এজন্যই তিনি শিক্ষক। কিন্তু কী হয়েছে সমাজে?

৩০ মার্চ শরীয়তপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষাকেন্দ্রে বহিঃপরীক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য আগত অন্য কলেজের কয়েক শিক্ষক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধানের সম্মানে বিভাগের পক্ষ থেকে ছোট পরিসরে খাবারের আয়োজন করা হয়। ওই খাবার অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়ায়, একটি ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখার সভাপতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ২০-২৫ কর্মীসহ বাংলা বিভাগে উপস্থিত হয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বাকবিত-ায় লিপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে বাংলা বিভাগের একজন প্রভাষককে লাথি ও কিল-ঘুষি মারতে শুরু করে। এ ব্যাপারে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের সুযোগ না দেয়ার অপরাধে হেনস্তা করা হয়েছে বহু শিক্ষককে। এসব ঘটনায় ছুরিকাঘাতও করেছে শিক্ষকদের। এসব ক্ষেত্রে মামলাও করা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে হার মেনেছে শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণের বিষয়টি। এসব কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ইতোমধ্যেই শিক্ষক সমাজের আত্মসম্মান ও দায়িত্ববোধে চিড় ধরে গেছে।

হৃদয় মণ্ডল নামে আর একজন শিক্ষক ১৯ দিন কারাগারে থাকার পর ১০ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছিল, স্পর্শকাতর বিষয় যাতে সবাইকে দ্রুত ক্ষেপানো যায়। তিনি আসলে কী করেছিলেন সেটি ভাবার আগেই যেহেতু ধর্ম নিয়ে কথা তাই সবাই ক্ষেপে গিয়ে তাকে আক্রমণ করেছে। তার ওপর আক্রমণ মানে গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর আক্রমণ। একজন শিক্ষক যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, যে কোনো ধর্মেরই হোক না কেন, তিনি কখনোই অন্য ধর্মের অবমাননা করবেন না। ঘটনা ঘটার পরপরই আমরা বুঝতে পেরেছি কিন্তু যারা পানি ঘোলাটে করে মাছ শিকার করতে চায় সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তাদের কথা চিন্তা করে না, ব্যবস্থা নেয় না, লাগামহীনভাবে ঘটনাগুলো ঘটতে দেয়।

আমাদের সংসদে অনেক কিছুই আলোচনা হয়। আমি অনুরোধ করব একটি আইন যাতে পাস করা হয় যে, শিক্ষকের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। কেউ শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইন হাতে তুলে নিতে পারবে না, তা সে যতই ক্ষমতাবান হোন না কেন। যদি কেউ করার চেষ্টাও করে সেটি হবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল, মানবতা ভূলুণ্ঠিত করার শামিল। সর্বাগ্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে সমাজে যে পচন ধরেছে এ সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। আমাদের কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। এখান থেকেই শুরু হোক। এটি নিয়ে কোনো ধরনের রাজনীতি যাতে কেউ না করে সেজন্য সবাইকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। সূত্র : ভোরের কাগজ।

মাছুম বিল্লাহ : লেখক ও শিক্ষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়