প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২২, ০০:০০
ফরিদগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন জাতীয় বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উপলক্ষে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে প্রবেশ। সেই থেকে পথচলা শুরু। সময়ের পরিবর্তনে ইচ্ছে আর চেষ্টায় আবৃত্তি, রচনাসহ নানা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজের জাত চিনিয়েছেন। উপজেলা থেকে জেলা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে পর পর বেশ ক’বার সাফল্যের দেখাও পেয়েছেন। বলছি, মুশফিকা ইসলামের কথা।
সপ্তম শ্রেণীতে থাকাকালীন বিতর্কযাত্রা শুরু হওয়া মুশফিকা ভিন্ন সময়ে বিতর্ক মঞ্চে বহু প্লাটফর্মে দলপ্রধান হিসেবে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিজ দলকে জিতিয়েছেন বহুবার। দায়িত্ব পালন করেছেন চাঁদপুর সরকারি কলেজ ডিভেট ফোরামের সাধারণ সম্পাদকের। চাঁদপুর সরকারি কলেজে রসায়ন বিভাগের অনার্স সম্পন্ন করার পর একই ডিপার্টমেন্টে পড়ছেন মাস্টার্সে। পাশাপাশি চাঁদপুর আল-আমিন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করছেন খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। সবশেষ চলতি বছরের মে-জুন মাসে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২২-এ জাতীয় পর্যায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন মান রেখেছেন চাঁদপুরের। জাতীয় পর্যায়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে নিজ অধ্যায়নরত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চাঁদপুর সরকারি কলেজের নাম।
চাঁদপুর কণ্ঠের পাক্ষিক আয়োজন শিক্ষাঙ্গনে আজ থাকছে মুশফিকা ইসলামের সাফল্যগাঁথার গল্প।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : শামীম হাসান।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
মুশফিকা ইসলাম : আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার সখ কী, জানতে চাই।
মুশফিকা ইসলাম : বিতর্ক করা, প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে নিজের সামর্থ্যরে প্রমাণ রাখা। আর অবসরে নতুন নতুন ভিন্ন কিছু রান্না করা উপভোগ করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : উপস্থিত বক্তব্য, বিতর্ক ব্যতীত সহ-শিক্ষা কার্যক্রমগুলোর কোনটিতে আপনি পারদর্শী?
মুশফিকা ইসলাম : আবৃত্তি, রচনা ও কুইজ প্রতিযোগিতায় বহুবার অংশ নিয়েছি। এসব কিছুতে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছু অর্জনও আছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার কিছু সাফল্য-গাঁথার কথা বলুন।
মুশফিকা ইসলাম : এ বছরেই আমার সবচেয়ে বড় অর্জন দুটি। একটি হলো বিটিভি আয়োজিত জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কে অংশগ্রহণ করা এবং অন্যটি জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা। যেখানে আমার দল দেশসেরা ৬-এ স্থান করে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ পাঠ্যসূচির বাইরে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের পরিবারের সমর্থন পেতেন কি না?
মুশফিকা ইসলাম : পারিবারিক সহযোগিতার জায়গায় সবসময় বেশ টানাপোড়েন ছিলো। যেহেতু আমাদের দেশে মেয়েদের যে কোনো কাজ এবং অর্জনকে একটু ভিন্নভাবে দেখা হয়। তবে হ্যাঁ, দিনশেষে সত্যি বলতে আমার মায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা। তিনি কখনো কোথাও আমাকে না খেয়ে বের হতে দেননি, কথাটি সাধারণ মনে হলেও ভীষণ অর্থবহ। কারণ সকাল ৮টার প্রতিযোগিতায় আসবো জানলেও আমার মাকে আমি কাকভোরে উঠে নাস্তা তৈরি করতে দেখেছি। এ ভালোবাসা, এই সহযোগিতা অনবদ্য। তবে আমার ছোট ভাইয়ের অনুপ্রেরণা এবং সাহায্য পেয়েছি সবসময়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বাবা-মায়ের সেই ছোট্ট মুশফিকা থেকে আজকের জাতীয় পর্যায়ে সেরা হওয়া মুশফিকাতে পরিণত হতে আপনি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা ও উৎসাহ পেতেন কোথা থেকে, কার কাছে থেকে?
মুশফিকা ইসলাম : এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার পেছনে যে মানুষটার অবদান সবচেয়ে বেশি, সে হলো এহসানুল হক বাপ্পি (আমার কলেজের ছোট ভাই)। বিষয়টা না দারুণ ছিলো। সত্যি বলতে আমি এ প্রতিযোগিতার ব্যাপারে জানতামই না। গিয়েছিলাম দেখার জন্যে, সেখানে বাপ্পি আমাকে হঠাৎই বলে, ‘আপু তুমি একটু এই বক্তব্যটা দাও, দেখি কেমন হয়?’ অথচ আমি টপিকের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। ওর অনুরোধে দাঁড়িয়ে ৪ মিনিট কথা বলি। সেই কথা বলাতে কলেজে-উপজেলায়-জেলায় প্রথম হয়ে যাবো ভাবিনি। চট্টগ্রাম বিভাগে অংশ নেয়ার আগের রাতে আমি ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিই। তারপর বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম!
ঢাকায় যাওয়ার পূর্বে চাঁদপুর সরকারি কলেজের মান্যবর অধ্যক্ষ স্যার যখন আমাকে বললেন, ‘কেউ যখন জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পায় তার সব ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়া উচিৎ’। এই কথাটি আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে এবং শুধুমাত্র এই একটি কথাই আমাকে এতো সাহস দেয় যে, যখন বক্তব্য দিবো তার আগে যখন গলা থেকে টনসিলের জন্যে ব্লিডিং হচ্ছিলো সেই অবস্থায় দাঁড়িয়েও আমি কথা বলেছি। স্যারের কাছে আমি সবসময় সবরকম সহযোগিতা পেয়েছি। একইভাবে আমার রসায়ন বিভাগের শিক্ষকদের ভালোবাসা এবং দিকনির্দেশনাও ছিলো বরাবর। তবে শুরুর দিকটা কঠিন ছিলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ছোট বেলায় কখনো ভেবেছেন বড় হয়ে একদিন আপনি বড় বড় মঞ্চে কথা বলবেন এবং আপনার কথা শত মানুষ শুনবে?
মুশফিকা ইসলাম : ভাবিনি, তবে স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নকে সত্যি করার জন্যে অনেক বেশি খেটেছি। প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা কতোটা কঠিন! সেই কঠিনকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি সবসময়। একটা কথাই ভেবেছি, কোনোভাবেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। আমরা ভবিষ্যদ্বাণী জানি না, কিন্তু স্বপ্নটা দৃঢ় হলে বাস্তবায়ন করতে পারি। আর আমি সেটাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার জীবনের বিতর্ক শুরু কীভাবে এবং কোথায় থেকে?
মুশফিকা ইসলাম : বিতর্কের শুরুটা ২০১১ সালে, সপ্তম শ্রেণিতে থাকাকালীন। আমার প্রথম বিতর্ক ছিলো জাতীয় বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ শীর্ষক আয়োজিত একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। আমি তখন ফরিদগঞ্জ পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম।
চাঁদপুর কণ্ঠ : একজন শিক্ষার্থী বিতার্কিক হয়ে উঠার জন্যে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?
মুশফিকা ইসলাম : এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ইচ্ছাশক্তি। বিতর্ক একটি শিল্প। তবে অন্য শিল্পগুলোর চেয়ে একটু আলাদা বটে। কারণ, এখানে পড়াশোনা করতে হয়, যুক্তি দিতে হয়, ব্রেইনে চাপ পড়ে, চিন্তাশক্তি বিকশিত করতে হয়, শুদ্ধ চিন্তা থাকতে হয়। সবাই বিতার্কিক হবে, এটা জরুরি নয়। কেউ গান গাইবে, কেউ আবৃত্তি করবে কিংবা অন্যান্য সহ-শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থাকবে এটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী বিতার্কিক হলে তার জন্যে এটা ভীষণ উপকারী, কারণ পড়াশোনার সাথে এটার সরাসরি যোগসূত্র আছে। সুতরাং তার যদি ইচ্ছা থাকে তবে সে বিতর্কে আসতে পারে। আসার পর তার জন্যে করণীয় হলো, দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপটসহ দেশ-বিদেশের সমসাময়িক ঘটনাগুলো নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করা। একই সাথে ব্যক্তিজীবনেও যুক্তির সাথে যুক্ত থাকা। এই জায়গায় এলে সময় দিতে হবে, সে রকম পর্যাপ্ত সময় দেয়া, লেগে থাকা, পরিশ্রমি হওয়া এবং প্রচুর অনুশীলন করা।
চাঁদপুর কণ্ঠ : পেশায় কী হতে চান?
মুশফিকা ইসলাম : প্রশাসনিক ক্যাডার।
চাঁদপুর কণ্ঠ : পড়াশোনা থেকে শিক্ষকতায় এলেন কীভাবে?
মুশফিকা ইসলাম : এটা একদমই হুট করে আসা। আসলে শিক্ষক হবো এ রকমটা কখনো ভাবনায় ছিলো না। নিজেকে প্রশাসনিক পেশায় দেখবো এটাই ভাবতে চেয়েছি। তারপর একসময় ভেবে দেখলাম বেকার থাকার চেয়ে কিছু একটা করি! সেই ভাবনা থেকেই শিক্ষকতায় আসা এবং আসার পর এখানে এতো বেশি ভালো লাগা কাজ করছে সেটি ভাষায় প্রকাশ করবার মতো না।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষকতা পেশাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুশফিকা ইসলাম : শিক্ষকতাকে সবসময়ই আমি শ্রেষ্ঠ পেশা হিসেবে দেখি। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। আমার জীবনে শিক্ষকদের অবদান না থাকলে আমিও একজন সঠিক মানুষ হতে পারতাম না।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষকতা জীবনের কোনো স্মরণীয় ঘটনা থাকলে বলুন?
মুশফিকা ইসলাম : আসলে আমার অভিজ্ঞতার জায়গা খুবই কম। শিক্ষকতা সবেমাত্র শুরু করেছি। আশা করছি, এর মাধ্যমে অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ হবে। তবে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে যদি বলি, যখন আমার শিক্ষার্থীরা ভালো ফিডব্যাক দেয় যে, ম্যাম আপনার পড়ানোটা সহজ এবং সাবলীল, আমরা ভালোভাবে বুঝি। এই অনুভূতিটাই শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। শিক্ষকদের কাছে এ ছোট ছোট ঘটনাগুলোই স্মরণীয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি যদি শিক্ষামন্ত্রী হন তবে প্রথমে কোন্ কাজটি করবেন?
মুশফিকা ইসলাম : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে আরো সহজ করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করবো। যেনো শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাকে ভয় না পেয়ে উপভোগ করে। তাদেরকে বিদ্যালয়ে আসার জন্যে বাধ্য করবো না, বরং এমন পরিবেশ তৈরি করবো যে বিদ্যালয়ে আসার জন্যে তারাই অধীর থাকবে। আমাদের প্রাথমিক থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আরো বেশি পড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে কাজ করবো। যেনো কোনো শিক্ষার্থী চোখে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে পাবলিকে সুযোগ পেয়ে র্যাগিংয়ের যাঁতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে সে স্বপ্ন থেকে বিচ্যুত না হয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মুশফিকা ইসলাম : এটা অত্যন্ত জরুরি। পড়াশোনায় ফার্স্ট হলেই কেবল জীবনে প্রথম সারিতে থাকা যায় না। জীবন-জীবিকা, দর্শন, ভবিষ্যৎ সবকিছুতে নতুনমাত্রা যোগ করে সহশিক্ষা কার্যক্রম। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধিও প্রয়োজন। তবেই ভালো শিক্ষার্থী হওয়া সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, সহ-শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের সঠিক মানুষ হতে সহায়তা করে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অনেকে বলেন সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিলে পড়াশোনার ক্ষতি হয়, তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
মুশফিকা ইসলাম : আমি তাদেরকে বলবো, সুযোগ থাকলে আপনি বিতর্ক করে দেখেন, শিখছেন নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন? খেলার মাঠে না নামলে আপনি কি করে বুঝবেন বলটা ভারি নাকি হালকা? এই ধরনের বক্তব্য যারা দেন, তারা আসলে অনেকটা না বুঝেই দেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ‘আঙুর ফল টক’ এটাও সত্যি। পড়াশোনা মানে কী? শুধুই পাঠ্যবই? উত্তরটি যাদের কাছে হ্যাঁ, তাদের কাছে এটা সত্যি যে সহশিক্ষা কার্যক্রম পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটায়। আর যদি মনে করেন, ‘বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’ তবে সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলো আপনার জীবনকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিবে এটা সত্যি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষা ও সহশিক্ষা এবং জীবনের দৌড়ে যারা এগিয়ে থাকতে চায় তাদের জন্যে আপনার পরামর্শ কী?
মুশফিকা ইসলাম : শুদ্ধ মানুষ হতে হবে, জীবনে স্বচ্ছ হতে হবে। তবেই সবকিছুতে সমানতালে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা অস্বচ্ছ হলে আমাদের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করে না এবং আমরা তাল হারিয়ে ফেলি, পেছনে পড়ে যাই। দিনের ২৪ ঘণ্টা সবার জন্যে সমান। কত ঘণ্টা আপনি কাজে লাগাননি সেটাই হলো এগিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে পড়ার কারণ! প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান, এটা ভেবেই এগোতে হবে।