সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২২, ০০:০০

চলমান পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে কিছু কথা
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওপর জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম) সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে, যেখানে শিরোনামটি ছিল মূলত গবেষণার বিষয়বস্তু। নায়েম এজন্যে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য কারণ শিক্ষার উন্নয়নে আমাদের দেশে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো গৎবাঁধা কিছু প্রশিক্ষণ আর সার্টিফিকেট বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কিছুটা হলেও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাবলির অন্তত একটিকে নিয়ে গবেষণা করেছে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, চলমান পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের শিখন-পঠন প্রক্রিয়াকে করে তুলছে প্রতিবন্ধক ও একঘেয়েমিপূর্ণ। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই শ্রেণিকক্ষের চলমান পাঠদান পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট নয়। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হবে। তা নিয়ে আলোচনা করবে। ব্যবহারিক ক্লাসের মাধ্যমে রপ্ত করবে চারপাশের নিত্যনতুন অভিজ্ঞান। সৃজনশীল ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে প্রতিদিন একটু একটু করে সমৃদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তৈরি হবে ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এ ধরনের কার্যাবলি করা থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে পাঠদানের জন্য সৃজনশীল পদ্ধতির পাশাপাশি স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেয়ে পরীক্ষার সিলেবাস শেষ করাটাই মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সিলেবাস শেষ করা নয়। শিক্ষার্থী যদি তার সঠিক জ্ঞানর্জন করতে না পারে তবে কী হবে সেই সিলেবাস শেষ করে? শিক্ষার্থীর প্রয়োজন আত্মোপলব্ধির, প্রয়োজন শিক্ষকের চমৎকর উদ্ভাবনী ক্ষমতা। শিক্ষককে আবিষ্কার করতে হবে শিক্ষার্থীর সাফল্যের গোপন সূত্র, তার সক্ষমতা ও জ্ঞানের গভীরতা। শিক্ষার্থীর মূল লক্ষ্য হতে হবে জানার জন্য শেখা এবং শেখার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে করে করে শেখা, যা কর্মজীবনে কাজে লাগাতে পারবে। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতোই মুখস্থনির্ভর পাঠদান চলছে যদিও সৃজনশীল প্রশ্ন চালু হয়েছে বেশ ক’বছর আগে। প্রায় সব বিষয়েই চলছে একই অবস্থা। শিক্ষাক্রম বিষয়ে অনেক শিক্ষকের স্বচ্ছ ধারণা নেই। কোন প্রক্রিয়ায় পাঠদান দিতে হবে, কতক্ষণ পড়াতে হবে, শিক্ষকদের এসব নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাছাড়া প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং অ্যাবিলিটির জন্য আলাদা কোনো মূল্যায়ন পদ্ধতিও নেই, বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত নন অনেকেই। প্রশিক্ষণ ছাড়াও কিছু কিছু শিক্ষক তাদের আগ্রহের কারণে বিষয়গুলো শিখে ফেলেন কিন্তু অনেকের মধ্যে সে ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়নি। এটি একটি নেগেটিভ দিক। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থী না বানিয়ে পরীক্ষার্থী বানিয়ে ফেলেছি, শিক্ষা ব্যবস্থাটাই হচ্ছে পরীক্ষানির্ভর। এখানে শেখার চেয়ে পরীক্ষায় পাসই মুখ্য। পাবলিক পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন মাথায় রেখেই স্কুলে পড়াশোনা হয়, যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বোঝা ক্রমে বাড়িয়ে তুলছে, অধরা থাকছে একটি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ। দেখা গেছে মাধ্যমিক পর্যায়ের ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থীই চলমান পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। এমনকি খোদ শিক্ষকদের ২৯ শতাংশও বর্তমান পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ করার সুযোগ কেমন? শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর নিজের মতো করে চিন্তা বা প্রশ্ন করার সুযোগই বা কতটুকু? এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া যায়। গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কয়েকটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পেলে অভিভাবকরা খুশি হন, এটিই স্বাভাবিক। শুধু যদি নম্বরপ্রাপ্তি উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ এবং কর্মজীবনে প্রবেশের অন্যতম শর্ত না হতো, বরং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার পরীক্ষা করা হতো তাহলে তো এই বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকরাও চিন্তিত থাকতেন না। এটি রাষ্ট্রকে করতে হবে। অভিভাবকদের ওপর দোষ চাপালে হবে না। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও চাহিদা অনুসারে ফিনল্যান্ডে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের পাঠক্রম সংশোধন ও পরিমার্জন করতে পারে, যেটি আমাদের দেশে সম্ভব নয়। দেশটির জাতীয় শিক্ষা সংস্থা স্কুল ও শিক্ষকদের জন্য স্ব-মূল্যায়ন পদ্ধতিকেও উৎসাহিত করে, এটি আমরা করতে পারি।

আমাদের আনুষ্ঠানিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর চিন্তন দক্ষতা বা যোগ্যতাকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এজন্য শিক্ষার্থীরাও এসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ায় উৎসাহ পায় না। শ্রেণিকক্ষে ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’ প্রক্রিয়া প্রয়োগের বিভিন্ন বাধার কথা তুলে ধরা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে শিক্ষকদের বেশিরভাগই মনে করেন যে, শিক্ষকদের মানসিকতা ও যোগ্যতার অভাব, শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ, সমন্বয় স্বল্পতা, মুখস্থনির্ভর পাঠ উপকরণ, অতিরিক্ত সংখ্যক পরীক্ষা, বড় আকারের শ্রেণিকক্ষ ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবেই শ্রেণিকক্ষে সৃষ্টিশীলতা কিংবা অংশগ্রহণমূলক পাঠদান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে শিক্ষকদের ওপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা এবং শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ভালো নম্বর নিশ্চিত করার একটি বড় চাপ থাকে। সুতরাং তাদের সবারই লক্ষ্য থাকে পরীক্ষা ও নম্বর। প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষার চিত্র অনেকটা আগের মতোই। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়। প্রতি বছর ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল প্রশ্নের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্ন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করতে না পারে এবং যথার্থ নিয়মানুযায়ী উত্তর লিখতে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিষয়টিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, বরং এক ধরনের ভীতির মধ্যে থাকে। শিক্ষার্থীদের এ ভীতি দূর করার জন্য একজন শিক্ষককে সঠিকভাবে তথ্য উপস্থাপন করে উদাহরণের মাধ্যমে সৃজনশীল পদ্ধতি বিষয়টাকে সহজ করে দেয়া প্রয়োজন। একটি সৃজনশীল প্রশ্নের শুরুতে একটি নতুন পরিস্থিতিযুক্ত উদ্দীপক এবং উদ্দীপক-সংশ্লিষ্ট চারটি প্রশ্ন থাকে। প্রশ্ন চারটি কাঠিন্যের ক্রমানুসারে পর্যায়ক্রমে থাকে। একটি সৃজনশীল প্রশ্ন চিন্তন দক্ষতার স্তর যাচাই করতে পারে। প্রতিটি সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য ১০ নম্বর বরাদ্দ থাকে। সৃজনশীল প্রশ্নের প্রথম অংশ হলো (ক) জ্ঞান স্তরের যা সহজ ও নিতান্তই স্মৃতিনির্ভর। প্রশ্নটি স্মৃতিনির্ভর হলেও সেটি অর্থবহ এবং শিক্ষাণীয় হয় প্রয়োজন। এ অংশটির জন্য বরাদ্দ থাকে ১ নম্বর। সৃজনশীল প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশটি হলো (খ) অনুধাবন স্তরের। এর মাধ্যমে শিক্ষাক্রমের আওতায় পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু অনুধাবন করার ক্ষমতা যাচাই করা হয়। পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন ঘটনা বা বিষয়বস্তুর বিবরণ দেয়া থাকে। এ ধরনের প্রশ্নে সরাসরি পাঠ্যবইয়ের অনুরূপ বিবরণ জানতে চাওয়া হয় না। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দিতে বলা হয়। প্রশ্নের এ অংশের জন্য ২ নম্বর বরাদ্দ থাকে। প্রশ্নের তৃতীয় অংশটি হলো (গ) প্রয়োগ স্তরের প্রশ্ন। সৃজনশীল প্রশ্নের এ অংশটি ভালো মানের নতুন পরিস্থিতিযুক্ত উদ্দীপকের ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ উদ্দীপক যদি খুব মানসম্পন্ন হয় তবে প্রয়োগ দক্ষতার প্রশ্নটি করা সম্ভব। এ প্রশ্নের উত্তর প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠ্যপুস্তকে থাকে। পাঠ্যপুস্তকের তথ্য এবং এর অনুধাবন উদ্দীপকে বর্ণিত নতুন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী প্রয়োগ করবে। প্রশ্নের এ অংশের জন্য ৩ নম্বর বরাদ্দ থাকে। সৃজনশীল প্রশ্নের চতুর্থ অংশ (ঘ) হচ্ছে উচ্চতর দক্ষতার প্রশ্ন। এ স্তরের প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিচার-বিবেচনা করার দক্ষতা, বিশ্লেষণ করার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতা ইত্যাদি যাচাই করা হয়। এ প্রশ্নের উত্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠ্যপুস্তকে দেয়া থাকে এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য নতুন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী তার বিচার-বিশ্লেষণের, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও মূল্যায়নের দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ পায়। এ অংশের জন্য ৪ নম্বর বরাদ্দ থাকে। শিক্ষকদের আগ্রহ থাকলে বিষয়গুলো আয়ত্ত করে অনেক আনন্দের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করতে পারেন।

প্রচলিত পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যেভাবে গণিতসহ অন্য কোনো বিষয় বোঝাতে চেষ্টা করেন তাতে দুই থেকে তিনজন সমস্যার সমাধান করা শিখতে পারে। বাকিরা শ্রেণিকক্ষে চুপচাপ থেকে সময় পার করে দেয়। পরে তারা বাসায় গিয়ে নিজেদের মতো করে বা অন্যের সাহায্যে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। অনলাইনে যাদের অ্যাকসেস আছে তারা কেউ কেউ ইউটিউবে বিষয়গুলোর ওপর যে শিক্ষাপদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে তার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করে। এখানে নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে বিধায় সমস্যার সমাধান হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শ্রেণিকক্ষে প্রকৃত সৃজনশীলতার চর্চা ও শিক্ষার্থীদের ক্রিটিক্যাল থিংকিং স্কিল উন্নত করার প্রচেষ্টা করা হয় না বললেই চলে।

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষক ও লেখক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়