সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার
  •   দৈনিক ইনকিলাবের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ্ মিজির দাফন সম্পন্ন
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ৩১ মে ২০২২, ০০:০০

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও আমাদের প্রস্তুতি
অনলাইন ডেস্ক

একসময় গ্রামবাংলায় গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ ছিলো। সময়ের পরিক্রমায় তা অনেক বদলে গেছে। মুরব্বীদের মুখে শুনেছি, গরুর দুধ জাল দিয়ে পথের ধারে, মাঠের কাছে মা-খালারা বিকেলবেলা অপেক্ষায় থাকতেন কারো ছেলেমেয়েকে খাওয়ানো যায় কি-না, না হলে ফেলে দিতে হতো-কারণ গরুর বাচ্চা অতিরিক্ত দুধ খেলে পেটের পীড়ায় অসুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই গরুর দুধ এখন আর গ্রামবাংলায় কিনতে পাওয়া যায় না। মানুষ হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালন করেন না। মানুষের মনে-চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তন চলে এসেছে। সময়ের পরিবর্তনে মানুষ এগুলো বাদ দিয়ে অলস হয়ে পড়েছে। পূর্বে একজন কৃষক ভোরে পান্তাভাত খেয়ে মাঠে চলে যেতেন। কৃষাণী দুপুরের খাবার নিয়ে খাওয়ায়ে আসতেন। বিকেলবেলা কৃষক ঘরে ফিরতেন। এখনকার পরিবারের বাবারা বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে আগে মোবাইলে কথা বলে হাঁটতে হাঁটতে চায়ের আড্ডায় গিয়ে মশগুল হয়ে পড়েন। পূর্বকালের একজন কৃষক ৭/৮টার মধ্যে হয়তো ২০ টাকা ইনকামের কাজ করে ফেলতেন, এখন ওই সময়ের মধ্যে ৫০ টাকা খরচ করে ফেলছেন। সময়ই তাদের বদলে দিয়েছে। পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে ধনীরা আরো ধনী, গরিবরা আরো গরিব হচ্ছে।

আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে বিদেশ থেকে কাপড় এসে জামা-কাপড় সেলাই শেষে আবার বিদেশে চলে যাচ্ছে। অধিকাংশ উন্নত বিশ্বে জনবল কম বা কর্মঘণ্টা হারে পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় তারা আমাদের দেশের সস্তা শ্রমের বাজারের সুযোগ নিচ্ছে। তাদের টাকা রয়েছে। যদি তারা অটোমেটিক মেশিনে অভ্যস্ত হয়ে যায় তাহলে এ কাপড় মেশিনে একদিক দিয়ে দিবে অন্যদিক দিয়ে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট হয়ে বের হয়ে আসবে।

আমাদের দেশে আর এ কাপড় পাঠাতে হবে না। তখন আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হবে।

আবার ভিয়েতনাম দ্রুতগতিতে গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশন শুরু করছে। ফলে বায়ারগণ সে দেশের প্রতি আকর্ষণ বোধ করছে। কারণ একটি মেশিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে পারে বলে প্রোডাক্ট তৈরিতে সময় কম লাগে আবার সস্তা হয়। তাই আমাদেরও বর্তমান পরিস্থিতির সাথে তাল মেলাতে অটোমেশনে চলে যাওয়া প্রয়োজন হবে।

জাতিসংঘ সারা বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেগুলোকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিলনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। পরে ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালকে এডিজি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। যা সম্প্রসারিত হয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে। কিন্তু ইতিমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। যার প্রভাব ২০৩১ থেকে শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূলকথা ‘সর্বত্র ডিজিটালের ছোঁয়া’ লাগানো। অর্থাৎ অটোমেশন প্রক্রিয়া চালু করা। আগে একটি ব্যাংকে চেক ভাঙাতে গেলে প্রথমে একজন টোকেন দেন। তিনি চেকের পাতা ভলিয়্যুমের পেইজে রেখে আসেন। আরেকজন অফিসার ভলিয়্যুমে গিয়ে হিসাব-নিকাশ করে রেখে আসতেন। আরেকজন অফিসার হিসাব চেক করে চেকটি পাশ করে ক্যাশিয়ারের কাছে দিলে ক্যাশিয়ার টাকা দিতেন। এ ৪/৫ জনের কাজ এখন মাত্র একজন আরো দ্রুত চেক পাশ করে গ্রাহকের হাতে টাকা পৌঁছে দেন। আবার এটিএম কার্ড, ভিসা কার্ড, মাস্টার কার্ডে লেনদেনের ক্ষেত্রে কোনো মানুষের সাহায্য লাগে না। ২৪/৭ এ সেবা ব্যবহার করা যাচ্ছে। এ ধরনের অটোমেশনের ফলে মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে। শুধু যারা দক্ষ তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ লোক বিদেশে ঝুঁকিপূর্ণ কনস্ট্রাকশন কাজে লেবার হিসেবে অথবা মরুভূমিতে চাষাবাদ কিংবা ঝাড়ু দেয়ার কাজে যাচ্ছে। সবগুলোই সস্তা শ্রমের শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। খুব কম লোকই ঞৎধরহবফ সধহঢ়ড়বিৎ হয়ে যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা পেশাজীবী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এ কর্মীর স্থান যদি রোবট দখল করে তাহলে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ লোক আর এ সস্তা শ্রমের চাকুরিও করতে পারবে না। বেকার হয়ে যাবে। আমরা অনেকেই জানি ভারতের রেমিট্যান্সের একটি বিশাল বাজার বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। আরেকটু বিশ্লেষণ করে বলা যায়, গার্মেন্টসের মধ্য পর্যায়ের কর্মী টেকনিক্যাল কর্মীসহ বায়ারের সাথে ডিলিংস কর্মী ভারতীয়। কারণ তারা প্রযুক্তিগত জ্ঞানসমৃদ্ধ ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী। তাই গার্মেন্টসের আরামের চাকুরি করছে ভারতীয় নাগরিক আর বাংলাদেশের নারী শ্রমিকগণ সুইয়িং ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলসহ পরিশ্রমের কাজগুলো কম পারিশ্রমিকে করছে।

বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ করে হাওর এলাকায় জমিতে ফসল রোপণ ও ফসল তোলার জন্যে টোটাল হার্ভেস্টার মেশিনসহ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে, যা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভেবে দেখার বিষয়, এ ধরনের একটি মেশিন একশজন কৃষি শ্রমিকের কাজ কয়েক ঘণ্টায় করে দিতে পারে।

একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে পারলেও মেশিনটি ২৪ ঘণ্টাই চলতে পারে। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ রকম আরো অনেক অনেক উদাহরণ রয়েছে।

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এক বছরে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী পাস করে (উচ্চশিক্ষা) তার ৪০ ভাগ শিক্ষার্থীর সরকারি-বেসরকারি সেক্টরে চাকুরি পাওয়ার সুযোগ থাকে। বাকি ৫৬ ভাগ বেকার থাকছে।

এবার আসি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দিকে অগ্রসরমান পৃথিবীতে আমাদের কী কী করণীয় থাকতে পারে। প্রথমত, আমাদের একদল দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে, যারা ভবিষ্যতে অটোমেশনের কাজে বা তা পরিচালনার কাজ করবে।

দ্বিতীয়ত, কারিগরি শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে চায়নার মতো একটি বাড়ি একটি কুটিরশিল্প স্থাপন করতে হবে। সকল শিক্ষার্থীকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন দক্ষতা।

তৃতীয়ত, আমাদের দেশের গার্মেন্টস শিল্পে অটোমেশন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। সাথে সাথে দক্ষ প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তুলতে হবে, যারা এ অটোমেশন প্রক্রিয়া পরিচালনা করবে।

চতুর্থত, সর্বক্ষেত্রেই আইসিটি জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সময়ই আমাদের ডিজিটাল করে ফেলবে।

পঞ্চম, শুধু পুঁথিগত বিদ্যার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে হবে। আমাদের বেশ কিছু ছেলেমেয়ে গুগল, অ্যাপলের মতো বিদেশী কোম্পানিতে উচ্চ বেতনে জব করছে। যাদের একাডেমিক পড়াশোনা খুবই কম। কিন্তু তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা অনেক। বিদেশীরা লোক নিয়োগে সার্টিফিকেট চান না। চান ব্যক্তি কী করতে পারেন, কোন্ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে।

ষষ্ঠ, নতুন নতুন জব মার্কেট খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের দেশের অনেকেই রয়েছেন বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তা যারা শুধুমাত্র ইউটিউব বা ফেসবুক থেকে মাসে ৩-৫ লক্ষ টাকা আয় করছেন।

সপ্তম, ফ্রিল্যান্সিং ও আউটসোর্সিং জব মার্কেটে কাজ করার উপযোগী জনশক্তি তৈরি করতে হবে।

অষ্টম, কৃষিক্ষেত্রে সৃজনশীলতা আনতে হবে। নতুন নতুন চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন ও ইমপ্লিমেন্টেশন করতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশের জমিতে আধুনিক চাষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শস্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাবদা, গুলশা, শিং, কই বা মাগুর মাছ চাষ না হলে এ মাছ মানুষ খেতেই পেতো না।

নবম, নতুন নতুন ফল ও ফসল চাষ করে লাভবান হতে হবে। যেমন : স্ট্রবেরী, ড্রাগন, পারসিমনসহ বিদেশী ফলের চাষ হতে পারে। এতে করে আমদানি করতে হবে না। পুকুরে মাছের সাথে সাথে ঝিনুকে মুক্তা চাষের কৌশল শেখা যেতে পারে। আবার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল প্লাটফর্ম কাজে লাগানো যেতে পারে।

২০৩১ সালের মধ্যে ডিজিটাল প্রক্রিয়ার দ্রুত বিকাশ ঘটবে। আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তা করা না গেলে এ জনবহুল দেশের অর্থনীতি ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান খান : বিভাগের সাবেক শিক্ষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদবিজ্ঞান, ঢাকা উদ্‌যান সরকারি কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়