প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি বিশ্বে ভ্যালেন্টাইন’স্ ডে হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলাদেশেও বেশ কিছুদিন ধরে ভালোবাসার দিবস হিসেবে দিনটি পালন করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে অনেকেই এই দিনটিকে পালন করেন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে। ওইদিন রাজধানীর শিক্ষা ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের মিছিলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও নির্বিচারে গুলি চালালে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। সেসব শহীদের স্মরণে নির্মিত হয় শিক্ষা অধিকার চত্বর। শিক্ষাভবন ও হাইকোর্টের দক্ষিণ গেটের সামনে এই চত্বরটি।
১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানের ঘোষিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্র সংগঠনগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিলো ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেয়ার শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত একটি কর্মসূচি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ওই সমাবেশ ডাকে। মিছিলের অগ্রভাগে মেয়েরা, ভয় শঙ্কাহীন। সেদিন মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ব্যারিকেড দেয়। একসময় আকস্মিকভাবে রায়ট কার ঢুকিয়ে গরম পানি ছিটানো শুরু করে পুলিশ। এরপর লাঠিচার্জ ও নির্বিচারে গুলি। মিছিলে প্রথম গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল। এরপর একে একে জাফর, কাঞ্চন, দীপালী সাহাসহ নাম না জানা অনেকে।
সেই মিছিলের সংগঠক কর্মীরা বলছেন, সকালে মিছিলে গুলি করা হয়েছিলো টার্গেট করে, আর বিকেলে কলাভবনে ঢুকে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়েছিলো বেধড়ক। সহপাঠীদের লাশ যেমন পাননি তারা, কতজন শহীদ হয়েছিলো সেদিন, সে হিসাবও নেই তাদের কাছে। আছে কেবল দিনটিকে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে না পারার খেদ। তারা এ-ও বলছেন, ভালোবাসা দিবস তখন ছিলো না, এখন আছে, থাকুক। তাই বলে গণতন্ত্রের জন্যে যারা এদিন শহীদ হয়েছিলেন তাদের কথা স্মরণই করবো না, তা হয় কী করে।
‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কেনো গুরুত্বপূর্ণ?’ এমন প্রশ্নে সে সময় আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, একটা গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এ জায়গায় আসতে পেরেছি তাদের স্মরণ করা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময়ের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী লায়লা আফরোজ বলেন, আমাদের ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্ররা মিলে মিছিল নিয়ে গিয়ে মজিদ খানের শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করে শ্বেতপত্র দিবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় নানা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী যোগ দেয়। মিছিলের সামনেই ছিলেন মেয়েরা। সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলটি কার্জন হলের সামনে পৌঁছালে পুলিশ-বিডিআর মিলে ব্যারিকেড দেয়। পুলিশ কোনো উস্কানি ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ওপর টার্গেট ফায়ার করলো। প্রথমে টিয়ার গ্যাস আর জলকামান ছোড়ে। এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি কতজন সেদিন মারা গেছে। রাইফেলের আওয়াজে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো চারপাশ। আমরা কার্জন হলের ভেতরে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাই। ফলে জানিও না কারা কোথায়।
কারা কোথায় তার হিসাব নেই জানিয়ে সাবেক ছাত্রনেতা ও ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মোশতাক হোসেনের মতে, জয়নাল ছাড়া পরে মোজাম্মেল আইয়ুব নামের আরেকজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। জাফর, কাঞ্চন, দিপালী সাহা নামের একটি ছোট বাচ্চাসহ অনেকে নিখোঁজ হয়ে যায়।
কেবল সকালের টার্গেট ফায়ারই নয় সারাদিন এবং শেষত বিকেলের বেধড়ক পিটুনির কথা উল্লেখ করে লায়লা আফরোজ বলেন, অনেকক্ষণ লুকিয়ে থেকে আমরা ১টার দিকে কলাভবনের দিকে যেতে চেয়েছি। কামরুন্নাহার ডানা, শাহীন আখতার সবাই তখন ক্যাম্পাসেই। আমরা বিকেলের দিকে ভিসির বাড়ির সামনে যখন দাঁড়ানো। তখন রাইফেল তাক করে খোলা জিপে সামরিক বাহিনী ঢুকলো কলাভবনের দিকে। যেখানে আন্দোলনকারীরা ছিলো। পরদিন জানতে পারি সেখানে যারা ছিলো তাদের পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শরীরে ক্ষত। এরপর একনাগাড়ে পাঁচ মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে।
তিনি বলেন, চীনে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। গোটা পৃথিবী সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই ঘটনার পরে আর স্মরণ করাই হলো না। ওটা ছিলো ভয়াবহ এক হত্যাকা-। অথচ এরশাদ সরকার এই ভয়ঙ্কর দিনটিকে ভুলিয়ে দিতে পরের বছর থেকেই ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে হাজির হলেন। পরের প্রজন্মকে জানতেই দিতে চাইলেন না সেদিন কী নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া নিরীহ শিক্ষার্থীরা।
আসলে ইচ্ছে করেই ভালোবাসা দিবস আনা হলো কি-না? এমন প্রশ্নে মোশতাক হোসেনের মত, আমরা যখন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি তখন ভালোবাসা দিবস ছিলো না। পরে সেটিকে আমাদের সামনে হাজির করা হলো। ভালোবাসা দিবসের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না। কিন্তু শহীদদের একেবারেই স্মরণ করবো না, সেটা তো হতে পারে না।
হাবিবুর রহমান : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।