প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
বিশাল এক জাহাজ পণ্য নিয়ে পানিতে ভাসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হঠাৎ জাহাজ মালিক খবর পেলেন যে জাহাজের ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। মালিক-কর্মচারী সবাই মিলে পুরো একদিন চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনোভাবেই চালু করতে পারলেন না। মালিকের মাথায় হাত।
পণ্য নিয়ে সময়মতো যেতে না পারলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। এমন সময় এক কর্মচারী এসে বললেন, ‘স্যার, আমি এক বৃদ্ধ লোককে চিনি। অনেক দিন ধরে তিনি জাহাজের ইঞ্জিনের কাজ করেন। তিনি মনে হয় পারবেন।’
দক্ষ বৃদ্ধ লোকটির ডাক পড়ল। তিনি ব্যাগ বোঝাই যন্ত্রপাতি নিয়ে ইঞ্জিনরুমে ঢুকলেন। পাঁচ মিনিট ধরে ভালো করে ইঞ্জিন দেখলেন। তারপর ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে ইঞ্জিনের এক জায়গায় সজোরে আঘাত করলেন। ইঞ্জিন চালু হয়ে গেল! মালিক হতবাক। পুরো এক দিন তারা চেষ্টা করে কিছুই করতে পারলেন না। আর এই বৃদ্ধ কিনা পাঁচ মিনিটে শুধু একটা হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে চালু করে দিলেন। ধন্যবাদ দিলেন বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ বললেন, ‘আমি আমার বিল পরে আপনাকে পাঠিয়ে দেব।’ বলে চলে গেলেন। এক সপ্তাহ পরে জাহাজ মালিকের কাছে বিল এলো, ১০ হাজার ডলার। মালিক চরম বিস্মিত আর রাগান্বিত হয়ে বিল ফেরত দিয়ে লিখে পাঠালেন ‘যৌক্তিক বিল করে আবার পাঠান। পাঁচ মিনিটের কাজ আর একটা হাতুড়ি মারার বিল ১০ হাজার ডলার হতে পারে না।’ বৃদ্ধ সেই বিলটাই আবার দিয়ে লিখে পাঠালেন, ‘পাঁচ মিনিট হাতুড়ি মারার বিল দুই ডলার, আর কোথায় মারতে হবে সেটা জানার বিল বাকি ৯ হাজার ৯৯৮ ডলার।’ এমনটাই হওয়া উচিত কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ জনবলের আত্মবিশ্বাস। কিন্তু আমাদের দেশে বাস্তবে ঠিক তার উল্টা ঘটনা ঘটছে।
কিছুদিন আগের ঘটনা। আমার প্রাইভেট কারটি চলতে চলতে স্টার্ট বন্ধ হওয়ার সমস্যা দেখা দিল। গাড়ি সম্পর্কে অভিজ্ঞজনকে জিজ্ঞেস করি, কী এর সমস্যা। কেউ বলে ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ে সমস্যা, কারো মতে কন্ট্রোলার ঠিকমতো কাজ করছে না। কারো মতে ইঞ্জিনের ইগনেশন কয়েল দুর্বল। আবার কেউ বলেন, ইঞ্জিন পুরনো হয়ে গেছে, বদলাতে হবে। এমন দোদুল্যতার মধ্যে গাজীপুরে পরিচিত মেকারের কাছে গাড়ি দিলাম বিষয়টি পরীক্ষা করার জন্য। তিনি এমন পরীক্ষাই করলেন যে কন্ট্রোলার নষ্ট করে প্রমাণ করলেন, কন্ট্রোলার ভালো ছিল। পড়লাম মহাবিপদে। গাড়ি তো আগে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। এখন জায়গা থেকে একচুলও সরানো সম্ভব নয়। কারণ আর স্টার্টই নিচ্ছে না। শেষে ঢাকায় ফোন করে রিকন্ডিশন কন্ট্রোলার এনে লাগিয়ে গাড়ি সচল করে ঢাকায় পাঠালাম। যাতে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাড়ি ঢাকায় থাকল, কন্ট্রোলার পরিবর্তন করালাম, সেন্সর পরিবর্তন করালাম। ইগনেশন কয়েল পরিবর্তন করালাম। এরপর গাড়ি কিছুটা ঠিক হলো কিন্তু স্টার্ট বন্ধের সমস্যা থেকেই গেল। এ অবস্থায় একজন পাকা মিস্ত্রি বললেন, ওয়্যারিংয়ে সমস্যা আছে। গাড়ির নিরুপদ্রব সার্ভিস পেতে গাড়ির ওয়্যারিংয়ের তারও নতুন লাগালাম। এর পরও গাড়ির স্টার্ট বন্ধের সমস্যা থেকেই গেল। এরই মধ্যে আমার মানসিক ও শারীরিক পেরেশানির সঙ্গে সঙ্গে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান নেই। ঢাকার এক হেডমিস্ত্রির কাছ থেকে সাজেশন এলো ‘ইঞ্জিন ফেলে দিয়ে নতুন ইঞ্জিন লাগাতে হবে।’ পেশায় শিক্ষক, এরই মধ্যে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে আমার কাহিল অবস্থা। আবার ইঞ্জিনের জন্য ৬০ হাজার টাকা আমার জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’। ভাবলাম ইঞ্জিন পরিবর্তন করার আগে নিজের মাথাটা খাটাই। খেয়াল করলাম স্টার্ট বন্ধ হওয়ার সময় হঠাৎ বন্ধ হয় না। ইঞ্জিনের শক্তি ধীরে ধীরে কমে তারপর বন্ধ হয়। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে মনে করলাম গ্যাসের সাপ্লাই কম হয়; কিন্তু গ্যাস ফুল থাকলেও একই সমস্যা থাকে। তার মানে কোনো কারণে গ্যাসের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাস মিস্ত্রির কাছে নিয়ে গেলাম ক্ষীণ আশা নিয়ে। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে স্যার, দেখি। সিলিন্ডারে গ্যাস ভরানোর সময় তার সঙ্গে তরল কিছু তেলের মতো বস্তু জমা হয়। এগুলো গ্যাসপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সিলিন্ডার খুলে পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রায় দুই লিটারের মতো তরল পদার্থ বের হলো। খরচ হলো আমার এক হাজার ৫০০ টাকা। এরপর আর কখনোই আমার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়নি। এটি শুধু একটি বাস্তব ঘটনা। এমন অসংখ্য ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে এবং মানুষ পড়ছে আর্থিক ও মানসিক ভোগান্তিতে। প্রতিটি সেক্টরেই কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের এমন বেহাল। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ না ঘটলে দেশের টেকসই উন্নয়ন সুদূর পরাহত।
বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার কম্পিউটার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। এ ছাড়া রয়েছেন প্রায় ৫০০ পলিটেকনিকের ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলী। কিন্তু বিশ্বমানের আন্তর্জাতিক কম্পানিগুলো যখন জনবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়, তখন কাঙ্ক্ষিত প্রযুক্তিবিদ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। কেন এমন অবস্থা? প্রকৃতপক্ষে আমরা ভুলে গিয়েছি যে দক্ষ জনবল তৈরিতে যে উদ্যোগ, সেখানে থাকতে হবে সততা, নিষ্ঠা ও ব্যাবসায়িক মনোভাববিবর্জিত মানসিকতা। তাই সংখ্যার বিচারে কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়লেও প্রকৃতপক্ষে এই খাতে দুর্বলতা থেকেই যাচ্ছে। শিক্ষার কার্যক্রম চলতে হবে শতভাগ সততার সঙ্গে। কিন্তু জাতীয় পত্রিকায় এমন খবরও দেখেছি যে পরীক্ষার হলে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা নিয়েছেন। জাতি বিধ্বংসী এই সংস্কৃতি থেকে সর্বপ্রথম শিক্ষকদের বেরিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি তথ্য-প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা একটি সরকারি ভার্সিটিতে মাস্টার্স কোর্সে ভর্তির জন্য লিখিত পরীক্ষা দেন। এক ঘণ্টা লিখিত পরীক্ষায় ৫০-এ শূন্য ও এর কাছাকাছি নম্বর পান তারা। এমন উদ্বেগজনক ভিত্তিজ্ঞানের বহিঃপ্রকাশও দেখা যায়। উন্নয়নের ট্রেন চালু রাখতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনতে হবে তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক ডিগ্রিগুলোর মানের বিষয়টিকে। দক্ষ জনবল তৈরির এমন অবস্থা চাকরির ক্ষেত্রে হতাশ ও উদ্বি¯œ করছে তরুণদের। একটি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ¯œাতক ও ¯œাতকোত্তর পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেলেও ভালো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। উচ্চশিক্ষায় দুর্দান্ত ফল অর্জনকারীদের মধ্যে ২৮ থেকে ৩৪ শতাংশ বেকার। আবার যারা চাকরি পান, তাদের বেতন ৪০ হাজার টাকার কম। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে সরকারের কঠোর নজরদারি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়নের নিয়ামক। এদের যতœ নিয়ে দক্ষ করি, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি।
লেখক : উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।