প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
স্কুলে যাওয়ার সময় দেখে গেছি সামান্য একটু উপরে দু-দুটো পেয়ারা পেকে টস টস করছে। বুড়িমার চোখ এড়িয়ে গেলো কি করে ! সে তো সারাক্ষণ টহল মারছে। যাক গে। স্কুল থেকে ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম। আছে আছে একই জায়গায় আছে। প্রাইভেট থেকে ফেরার পথে হাফিস করে দিতে হবে। একটু সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব থাকবে। বুড়িমা তো সন্ধ্যার পরে চোখে একটু কমই দ্যাখে।
বুড়িমা : কে এলি রে ? ওরে কে এলি?
আমি : আমি বুড়িমা।
বুড়িমা : ওরে আমিটা কে রে? তুই কি ছুমু? স্কুল থেকে ফিরলি?
আমি : হ্যাঁ বুড়িমা। তুমি ঘরে কি করছো?
বুড়িমা : শুয়ে আছিরে। ওরে ছুমু কুঁজো থেকে এক মগ পানি গড়িয়ে রেখে যা না রে। আজ রোজা রেখেছি। সন্ধ্যায় ইফতার করবো। দুপুর থেকে শরীরে জোড় পাচ্ছি না রে। তোর বাবাকি দোকানে?
আমি : হ্যাঁ বুড়িমা। আজ তো শুক্রবার তাড়াতাড়ি ফিরবে।
ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। বুড়িমা বিছানায় শুয়ে আছে। কপালে হাত দিলাম। নাহ গরম নয় তবে কেমন ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে। কুঁজো থেকে পানি গড়িয়ে মাথার পাশে রাখলাম।
আমি : ও বুড়িমা , বুড়িমা, এবার যাই কেমন, পড়তে যাবো নয়তো দেরি হয়ে যাবে। যাওয়ার পথে একবার আসবোনি আমি কেমন।
বুড়িমা : হ্যাঁরে যাকনি, যাবিতো যা না, কে আটকাচ্ছে তোকে। আর শোন, তোর বাবা দোকান থেকে ফিরলে একবার ঘুরে যেতে বলিস।
আমি : আচ্ছা বুড়িমা।
আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর না বুড়িমার বাড়ি। এই যেমন আমাদের বাড়ির পাশেই ছোট্ট একটা ডোবা, পাশে একটা লিকলিকে আমগাছ হয়েছে, তারপর একটু খানি ফাঁকা জমি তারপরেই বুড়িমার বাড়ি। আমাদের বাশার পাশেই এই বুড়িমা থাকে অনেক দিন আগে থেকেই। দাদুকে কখনো দেখিনি অনেক আগেই চলে গেছেন। কিন্ত যা রেখেগেছেন তা একজনের জন্য যথেষ্ট। বুড়িমার কোন ছেলে মেয়ে নেই। তাই তিনি একাই থাকে বাড়িতে। তবে বুড়িমার বয়স যথেষ্ট হয়েছে।
"বুড়িমা থুরথুরি, তোর গাছের আম পাড়ি",
এসব বলা একদম ঠিক নয়, তবে এসব বললে বুড়িমা সেই ক্ষেপে। আর তাই এসব বলে ক্ষেপাই। আর এসব নিয়েই বুড়িমার সাথে আমাদের ঝগড়া।
আমি : বুড়িমা চলে গেলাম।
প্রাইভেট পড়া শেষে ফেরার পথে ঢুঁ মারলাম।
কোথায় পেয়ারা? কিচ্ছু নেই, সব ভোঁ ভোঁ। উল্টে বুড়িমা গাছে উঠে বসে আছে। হঠাৎ দেখি পেয়ারা দুটো ঠক করে পায়ের সামনে পড়লো। কেউ কি দেরি করে ? তাড়াতাড়ি বেগে ভরে গাছের উপরে তাকালাম। কোথায় বুড়িমা? কেউ নেই। একটু ভয় ভয় ভয় যে করছে না তা নয়। তবুও সাহস করে ঘরে ডুকলাম। বুড়িমা যথারীতি মেঝেতে শুয়ে আছে।
আমি : বুড়িমা ও বুড়িমা আলো জ্বালাওনি কেন?
সন্ধ্যা তো হলো। সুইচ দিতে যাবো ঠিক তখনই, বুড়িমা বলে উঠলো,
বুড়িমা : শোন ছুমু, দু নম্বর উনুনের মাঝখানের গর্তে তোর জন্য কিছু রাখা আছে। বুকের মধ্যে করে নিয়ে যা। পেয়ারা দু'টো এখন খেয়ে নে। আর শোন, স্কুল থেকে আমার জন্য চুপিচুপি যে আমের আচারটা কিনে নিয়ে এসেছিলি, টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, ওটা এখনও কিছুটা আছে আমার সাথে দিয়ে দিবি কিন্তু।
আমি : এই তোমার একটা দোষ বুড়িমা। শুরু করলে থামতে চাও না। শোন না একটা পেয়ারা তুমি খাও। পেয়ারা গুলো টুসটুসে; দাঁতে লাগবে না গো, এই দ্যাখো আমি খাচ্ছি।
বুড়িমা : নারে ছুমু তুই দুটোই খেয়ে নে। উনুনের ভিতরের জিনিস টা নিয়ে নে। ভুলে যাস নে। তোর বাপ বোধ হয় ফিরলো দোকান থেকে। ডেকে নিয়ে আয়। আমাকে ছেড়ে কিন্তু কোথাও যাবি নে। যতক্ষণ না আমি বলছি।
বুড়িমাটা না মাঝে মধ্যে মায়ের মতোন হয়ে যায়। অন্ধকার হয়েছে তো কি হয়েছে, বুড়িমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম। কপালটা ঠান্ডা ঠান্ডা। দু দুটো হামি খেলাম, কিন্তু গরম হলো না। বুড়িমার কি ঠান্ডা লাগছে? গায়ে কি কিছু চাপা দিবো? নাহ বাড়ি যাই, অনেক দেরি হয়ে গেছে আজ। বকুনি তো কপালে আছেই আজ। আর আগে গিয়েই বুড়িমার কথা বলবো।
বাবা : কিরে কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
আমি : বুড়িমার বাড়িতে, তোমাকে বলছে বুড়িমা একটু যেতে কি জেনো কথা বলবে।
বাবা : আচ্ছা যা তুই।
যাক বুড়িমার কথা বলাতে বকুনিটা একটু কমই হলো। বাবা উদ্যমী মানুষ,তাই বুড়িমার ঘরে ঢুকেই তাড়াহুড়া করে আলো জ্বালালেন। ডাক্তার ডাকলেন, পাড়া প্রতিবেশি সবাই এলেন।
ডাক্তার কাকু বললেন বিকেল ৩টা থেকে ৩ :৩০ ধরে নেন। এখন তো ৭টা বেজে গেছে। আমি সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি, আপনারা রেডি হতে পারেন, দিনের বেলা মারা গেছে, এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে, লাশ নিয়ে যেতে পারেন।
বড়দের এই একটা দোষ, নিজেরা কম জানে কিন্তু স্বীকার করে না। এই তো কিছুক্ষণ আগেই আমি কথা বললাম। তখন তো সন্ধ্যা হয় হয়। বুড়িমার দিকে তাকালাম দেখলাম বুড়িমা বলতে না করছে।
খাট, সাদা কাপড়, আগড় বাতি, গোলাপজল, সব এসে গেলো। বাবা পাড়ার কাকুরা সবাই রেডি। বুড়িমা তো আর বুড়িমা নেই এখন লাশ। খাটে করে বুড়িমাকে নিয়ে গেলো :-
পেয়ারা গাছের দিকে তাকালাম, বুড়িমা গাছে নেই। কোথায় গেলো? কলা গাছ দাড়িয়ে আছে, সাদা গোমটা মাথায় দিয়ে। দৌড়ে চলে গেলাম বুড়িমার কাছে।
বাবা হঠাৎই বলে উঠলেন, জেরিনটা ওকে খুব ভালোবাসতো। ছুমু এখন আমাদের সাথেই যাক জেরিনের আত্মা শান্তি পাবে।
আমি মাথা তুলেই দেখি মাকে আমি জড়িয়ে ধরে আছি।
ও ছুমু ওখানে গেলে কেন? এদিকে এসো। এতক্ষণে মসজিদের ইমাম মুখ খুললেন। বললেন :-
ইমাম : শুনো সবাই , আজ শুক্রবার। আর এই দিনটা খুব ভালো দিন। তবে জেরিন ছুমুকে খুব ভালোবাসতো তাই এই আত্মা এখন যেতে চাচ্ছে না। জেরিনের আত্মা ছুমুর সাথেই থাকতে চায়। আর এই কলাগাছটা কেটে ফেলো। আর এই জায়গাতে দুটো শিক গেথে রেখো। নয়তো জেরিনের আত্মা এইখানে ঘুরতে থাকবে।
বাবা ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে লাগলেন খুব ব্যাথা লাগছিলো। লাশ নিয়ে যাচ্ছে কবর দিতে। আমাকে ও সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে বাবা। মাঝ রাস্তায় হঠাৎ ঝড় উঠলো। চুঁরবড় কোঁটায় বৃষ্টি। মনে হচ্ছে আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। আমরা এই অবস্থাতেই একটা ভাঙা বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রায় ভোর রাত্রিতে আমরা কবরস্থানে পৌঁছালাম।
রাস্তায় যতক্ষণ ছিলাম বুড়িমা আমার সাথে খুব গল্প করছিলো। কেমন করে বিয়ে হলো? কি করে আমাদের এখানে এলো? আমার বয়সি তার একটা ছেলে ছিলো। কি করে হঠাৎ দু দিনের জ্বরে মারা গেলো। এইসব। পাশাপাশি আমরা দু জন হাটতেছিলাম। বৃষ্টি কমলে আমরা সবাই কবর স্থানের দিকে রওনা হলাম। কবরস্থানে দেখলাম বুড়িমা খাটে বসে বসে আমের আচার খাচ্ছে।
ওহহো জানাতে ভুলে গেছিলাম আমার জেদাজেদিতে টেলু কাকু আমের আচার বুড়িমার সাথে দিতে বলেছিলেন। পাশের বাড়ির এক দাদু এলেন। বুড়িমা খেতে চাইলেন না তবু বাবা জোড় করে খাওয়ালো। বুড়িমার মুখের পাশ দিয়ে ফেলে দিলো বাবা দেখতে ও পেলেন না। আমার একটু ও ক্ষিদে পায় নি। তবুও পলাশ কাকু জোড় করে আমাকে রসগোল্লা খাওয়াতে নিয়ে গেলো। অত বড় বড় দু দুটো পেয়ারা খাওয়ার পর কারো খিদে পায় ? বুড়িমার ঘরেই তো পেয়ারা দুটো খেলাম। রসগোল্লা খেয়ে এসে দেখি বুড়িমাকে কবর দিয়ে ফেলছে। তবে বুড়িমা যেন ভিতরে নয় কবরের উপরে বসে আছে। দু হাত মেলে দিয়ে যেন আমাকেই ডাকছে।
আমি : "দাঁড়াও বুড়িমা আমি আসছি আমাকে ধরে তুমি উঠবে"।
আমি পলাশ কাকুর হাত ছেড়ে এক দৌঁড়ে চলে যাই বুড়িমার কাছে। কিন্তু যেন বুড়িমাকে আমি ধরতেই পারছিনা। তাকে ধরাই যাচ্ছে না। তাকে ঝড়িয়ে ধরলেই তার শরীর ছেদ করে আমার হাত আমার কাছে ফিরে আসে। তারপর আর আমার কিছু মনে নাই। আমার বিশেষ কিছু ক্ষতি হয় নাই। বুড়িমা তার সকল সম্পত্তি আমার নামে করে দিয়ে গেছেন। এবং বাবাকে সব দেখাশোনা করতে দিয়ে গেছেন। যতদিন না আমি বড় হচ্ছি ততদিনের জন্য। বুড়িমার সকল সম্পত্তির কাগজ পত্র দু উনুনের মধ্যেই রেখেছিলেন। ঐদিন ঐ খামটাই বুড়িমা আমাকে বুকের মধ্যে করে নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
আগে বুড়িমাকে খুব দেখতে পেতাম, এখন খুব কম দেখতে পাই। ডাকলেও আসতে পারে না বলে বয়স হয়েছে তো।
বুড়িমা ঠিকই বলেছিলো ভালোভুতদের ভালো লোকেরা দেখতে পায়।