শনিবার, ০১ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৯

সময়-অসময়

ক্ষুদীরাম দাস
সময়-অসময়

অরুণিমা দত্তের জীবন ছিল যেন শরতের আকাশÑনির্মল, উজ্জ্বল এবং প্রাচুর্যে ভরা। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই সে তার নিজের হাতে গড়া ‘আলোকময়ী’ নামের পোশাক প্রস্তুতকারক কোম্পানিটিকে দেশের অন্যতম সফল ব্র্যান্ডে পরিণত করেছিল। অরুণিমার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, দামি গাড়ি, আর তার ফ্ল্যাটজুড়ে লেগে থাকা জমকালো পার্টির ঝলকানি প্রমাণ করত তার সাফল্যের উচ্চতা।

আর এই সাফল্যের চূড়ায়, অরুণিমার চারপাশে সবসময়ই ছিল মানুষের ভিড়। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, ব্যবসায়িক সহযোগীÑকারো অভাব ছিল না। এদেরকেই অরুণিমা মনে মনে নাম দিয়েছিল ‘দুধের মাছি’।

যেমন, ছিল অমল সেন। অমল ছিল অরুণিমার স্কুল জীবনের পরিচিত। অরুণিমার ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অমল তার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। প্রতিদিন সকালে ফোন করে কুশল জিজ্ঞেস করা, অরুণিমার প্রতিটি সাফল্যে সবার আগে মিষ্টি নিয়ে হাজির হওয়া, এবং সুযোগ পেলেই তার নতুন কেনা গাড়ির প্রশংসা করা ছিল তার নিত্যদিনের কাজ। অমল সবসময় বলত, ‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা, অরুণিমা। তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’ কিন্তু অমলের আসল লক্ষ্য ছিল তার ছোটখাটো সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা অরুণিমার বড় কোম্পানির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।

আরও ছিল শ্রেয়া, এক ঝলমলে সমাজকর্মী, যে অরুণিমার দাতব্য অনুষ্ঠানগুলোতে সামনের সারিতে বসে ছবি তুলত। শ্রেয়া সবসময় বলত, ‘আপনার মতো দানশীল মানুষ সমাজে বিরল, ম্যাম। আমি আপনার পাশে আছি।’ আসলে শ্রেয়ার উদ্দেশ্য ছিল অরুণিমার পরিচয়ে আরও বড় ডোনারদের কাছে পৌঁছানো এবং সমাজের এলিট সার্কেলে নিজের জায়গা পাকা করা।

অরুণিমার ছোট মামাতো ভাই রনি তো ছিল একেবারে সর্বক্ষণের সঙ্গী। রনি কাজ না করলেও অরুণিমার পার্টিতে ম্যানেজার সেজে ঘুরে বেড়াত, দামি পানীয় পান করত এবং অরুণিমার ক্রেডিট কার্ডে টুকটাক কেনাকাটার সুযোগ খুঁজত। সুখের এই সময়টা ছিল যেন এক বিশাল মেলা, যেখানে দুধের মিষ্টতা ভোগ করতে সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। অরুণিমাও জানত, এই ভিড়ের ৯০ শতাংশই স্বার্থের সুতোয় বাঁধা, কিন্তু ভিড়টা তার একার নয়, বরং তার সাফল্যের, এই বোধটুকু তাকে এক ধরনের মিথ্যা আত্মতৃপ্তি দিত।

কিন্তু জীবন তো মসৃণ রাস্তা নয়, তাতে হঠাৎ বাঁক আসে।

২০২৪ সালের এক শীতের সকালে অরুণিমার সেই উজ্জ্বল জীবনে নেমে এল ঘোর অন্ধকার। দেশের অর্থনীতির মন্দা, আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং তার সবচেয়ে ভরসার ম্যানেজারের ব্যক্তিগত লোভের কারণে কোম্পানির হিসেবে বিশাল গরমিল ধরা পড়ল। রাতারাতি ‘আলোকময়ী’ দেউলিয়া হওয়ার পথে চলে গেল।

সরকারি তদন্ত শুরু হলো। ব্যাংকগুলো ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে তালা লাগার উপক্রম হলো। অরুণিমা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল। মাথার ওপর এত বড় ঋণের বোঝা, সমাজের সমালোচনা আর তার চেয়েও বড় কথাÑআস্থাভঙ্গের যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করল।

এই দুঃসময়ে অরুণিমা প্রথম যে কাজটি করল, তা হলো তার ‘আপনজনদের’ ফোন করা। সে মনে মনে বিশ্বাস করত, এত বছর ধরে যাদের সে সাহায্য করেছে, যাদের সঙ্গে সে আনন্দ ভাগ করে নিয়েছে, তারা আজ তার পাশে দাঁড়াবে।

বিপদটা যেন ছিল একটি শক্তিশালী ছাঁকনি। এই ছাঁকনি যখন কাজ শুরু করল, তখন সম্পর্কের স্বরূপ মুহূর্তেই বদলে যেতে শুরু করল।

প্রথমে ফোন করল অমল সেনকে। ‘অমল, আমার একটা জরুরি আইনি পরামর্শ দরকার। আর এই মুহূর্তে আমার হাতে নগদ টাকাও নেই...’

অরুণিমাকে শেষ করতে না দিয়েই অমল ব্যস্তভাবে বলল, ‘অরুণিমা, কী বলছ এসব? আমি তো এখন দেশের বাইরে। খুবই জরুরি একটা কাজ। তাছাড়া আইনি ব্যাপারে আমি তো কিছুই বুঝি না। তুমি বরং অন্য কাউকে দেখো। পরে কথা হবে...।’ ফোনটা কেটে গেল। সেই অমল, যে গতকালও অরুণিমার বাড়ির গেটের বাইরে ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করত, আজ সে ব্যস্ততার অজুহাতে সেকেন্ডের মধ্যে সরে গেল। তার সাপ্লাইয়ের লোভ শেষ, তাই সম্পর্কের দরকারও ফুরিয়ে গেল।

এরপর অরুণিমা শ্রেয়াকে ফোন করল, ‘শ্রেয়া, আমার এই মুহূর্তে কিছু ডোনেশন নয়, বরং কিছু মানুষের কাছে সাহায্য দরকার। তোমার পরিচিত বৃত্তটা তো বিশাল...’

শ্রেয়া কণ্ঠে চরম বিরক্তি মিশিয়ে উত্তর দিল, ‘শুনুন, আমি এখন আপনাকে ‘ম্যাম’ বলতেও স্বচ্ছন্দ বোধ করছি না। আপনাকে নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। আমার সংগঠনের দুর্নাম হোক, আমি চাই না। তাছাড়া এখন আপনার কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা করা আমার নৈতিকতার বিরোধী। আপনি বরং আপনার উকিলের সঙ্গে কথা বলুন।’ নৈতিকতার দোহাই দিয়ে শ্রেয়া সম্পর্ক ছিন্ন করল।

রনির কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। অরুণিমার ফ্ল্যাট হাতছাড়া হওয়ার প্রথম দিনেই রনি তার পুরনো জামাকাপড় ও গয়নাপত্র গুছিয়ে নিল এবং একটি ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখে গেল : ‘দিদি, আমি আপাতত কাকার বাড়ি যাচ্ছি। এখানে থাকলে আমারও খারাপ লাগছে। তুমি সামলে নিও।’ সেই রনি, যে এতদিন অরুণিমার টাকায় চলত, সে দুঃসময়ে একটুও পাশে থাকল না।

অরুণিমা বুঝতে পারল, এই তথাকথিত আপনজনেরা কেউ তার নয়। এরা ছিল শুধুমাত্র তার সুখের দিনের দুধের মাছি, যারা কেবল মিষ্টতাটুকুই চেটে নিত, বিপদের তিতকুটে স্বাদ নিতে প্রস্তুত ছিল না। ছাঁকনি তার কাজ শুরু করে দিয়েছেÑসব অন্তঃসারশূন্য, সুবিধাবাদী সম্পর্কগুলোকে ছেঁকে বাইরে ফেলে দিচ্ছে। অরুণিমা তার ফোনবুক দেখতে লাগল। এক বিশাল ভিড় এখন শূন্যতায় পরিণত হয়েছে।

এই শূন্যতার মাঝেও কিছু মানুষ ছিল, যারা ছাঁকনি পেরিয়ে অরুণিমার জীবনে টিকে রইল। সংখ্যায় তারা ছিল হাতে গোনা।

প্রথমজন হলেন তার পুরনো হিসাবরক্ষক, প্রশান্তবাবু। তিনি অরুণিমার ব্যবসা শুরুর সময় থেকে তার সঙ্গে ছিলেন। যখন পুরো ম্যানেজমেন্ট অরুণিমাকে ছেড়ে চলে গেল, প্রশান্তবাবু তখনও

অফিসে বসে ছিলেন।

‘ম্যাডাম, কাল রাতে সব কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখেছি,’ প্রশান্তবাবু শান্তভাবে বললেন, ‘হিসেবে গরমিলটা আপনার ভুলে নয়, বরং আপনার প্রাক্তন ম্যানেজারের চক্রান্তে হয়েছে। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। আমি জানি, আপনি সৎ। আমি আপনার সঙ্গে আছি, যতক্ষণ না এই জট খুলছে।’

প্রশান্তবাবু কোনো টাকা বা ক্ষমতার লোভে আসেননি। তার আনুগত্য ছিল ব্যক্তি অরুণিমার সততা আর পরিশ্রমের প্রতি। তিনি দিনরাত এক করে আইনি লড়াইয়ের জন্য কাগজপত্র গোছাতে লাগলেন।

দ্বিতীয়জন ছিলেন রীনা, অরুণিমার বাল্যকালের বন্ধু, যে কোনোদিন অরুণিমার ব্যবসার সাফল্যের ভাগ চাইতে আসেনি। রীনা ছিল একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা। অরুণিমার বিলাসী জীবনযাপনের সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না, তাই সুসময়ে তাদের দেখা কমই হতো।

বিপদের খবর শুনে রীনা ছুটে এলো। সে কোনো আর্থিক সাহায্য করতে পারল না বটে, কিন্তু তার চেয়েও মূল্যবান কিছু দিলÑআবেগিক সমর্থন।

‘শোন অরুণি,’ রীনা তার ভাঙা কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘টাকা-পয়সা, ব্যবসাÑএগুলো আসবে-যাবে। কিন্তু তোমার সাহস আর সততাটা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না! আমরা একসঙ্গে লড়ব। আমি রোজ তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসব। যখন তোমার কথা বলার দরকার হবে, আমি শুনব। আর যখন কাঁদার দরকার হবে, আমার কাঁধ পাতব। আমি তোমার বন্ধু, তোমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কোম্পানির নয়।’

রীনার দেওয়া সাধারণ টিফিন বক্সের খাবার, আর নিঃশর্ত সহানুভূতি অরুণিমাকে কঠিনভাবে বাঁচতে শেখাল। রীনা যেন প্রমাণ করল, সত্যিকারের বন্ধুত্ব কোনো স্বার্থের বিনিময়ে গড়ে ওঠে না, তা গড়ে ওঠে আত্মার টানে।

অরুণিমার আইনি লড়াই চলল প্রায় দু'বছর ধরে। এই সময়ে তার জীবন পুরোপুরি পাল্টে গেল। বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে সে এক সাধারণ জীবনযাপন শুরু করল। তার প্রাক্তন ম্যানেজার ধরা পড়ল এবং অরুণিমা আংশিকভাবে তার হারানো মর্যাদা ফিরে পেল। কোম্পানি সম্পূর্ণভাবে আগের অবস্থায় না ফিরলেও, সে আবার নতুন করে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করল।

এই পুরো যাত্রাপথে, অরুণিমা একটি কঠিন কিন্তু মূল্যবান শিক্ষা লাভ করল।

সে বুঝল: সুখের দিনে দুধের মাছির অভাব হয় না। সেই দিনগুলো ছিল এক রঙিন প্রতারণার মেলা। আর বিপদ ছিল সেই অনিবার্য ছাঁকনিÑযা তার জীবন থেকে সব আবর্জনা ছেঁকে সরিয়ে দিয়েছে।

আজ অরুণিমার চারপাশে কোনো ভিড় নেই। আছে কেবল প্রশান্তবাবু, যিনি আজও তার নতুন ছোট অফিসটিতে হিসেবপত্র সামলান, আর রীনা, যে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার এসে তার খোঁজ নিয়ে যায়। এই সম্পর্কগুলো সংখ্যায় নগণ্য হলেও, এদের ভিত্তি ইস্পাতের মতো মজবুত।

অরুণিমা এখন আর ভিড় দেখে মুগ্ধ হয় না। সে জানে, জীবনে ভিড় নয়, স্থায়িত্ব প্রয়োজন। ছাঁকনি তাকে দেখিয়ে দিয়েছে যে জীবনের প্রকৃত রত্ন লুকিয়ে থাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার গভীরে, আর এই রত্নগুলিকে চেনার জন্য মাঝে মাঝে জীবনের বড় বিপদ আসাটা জরুরি। সে তার নতুন, শান্ত জীবনে সুখী। কারণ এবার তার চারপাশে যারা আছে, তারা অরুণিমাকে ভালোবাসে, তার সাফল্যকে নয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়