শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৫

ধারাবাহিক উপন্যাস-১২

নিকুঞ্জ নিকেতন

রাজীব কুমার দাস
নিকুঞ্জ নিকেতন

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৮.

আজ বাদ জুম্মা আয়েশার কবর জিয়ারত করে আসব। আজকের পাক দিনে সে জান্নাতুল ফেরদৌস লাভ করেছিল। বলেছিল আমাকে ছাড়া কোথাও যাবে না অথচ মাঝপথে এভাবে একা ফেলে আমাকে না বলেই চলে গেল। ওয়াদা করলেও সে ওয়াদা পূরণ করা হয়নি তার। জানি না কতটুকু সফল হয়েছিলাম সাংসারিক জীবনে তবে তার বিষয়ে আমার চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সবসময় তাকে ঘিরে রাখার চেষ্টা করেছি তাছাড়া সেও ছিল বেশ পর্দাশীল ও নামাজি। ধর্মীয় বিষয়গুলো পালন করত অক্ষরে অক্ষরে। আয়েশার ইন্তেকালের পর থেকে কেমন যেন একটা ব্যথা অনুভব করতাম। কখনো কখনো নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয়। ভাবতাম চাইলেই হয়তো আরেকটু ভালো থাকা যেত তাহলে কেন চাইনি। মনের এই বিষণ্নতা ঢেকে রাখতে আমি সবসময় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি, মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করি অন্যদের সাথে নিজেকে কারণ জীবনের করুন ব্যথাগুলো আমাকে ধীরে ধীরে গিলে খায়। ছেলে-মেয়েদের তেমন কিছু দিতে পারিনি তাই তাদের কাছেও হয়তো প্রশ্নবিদ্ধ। ভাই-বোন-পরিবার ইত্যাদি ভেবে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো পার করে এখন আমি সর্বস্যহারা। যদিও সন্তানেরা কখনো আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি তবু তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে ইতস্তত: বোধ করি। বাবা হিসেবে যতটুকু করার তা হয়তো পুরোপুরি করতে পারিনি। দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আর ছোট ছেলেটা কলেজ শেষ করেছে মাত্র। ছাত্র অতটা ভালো না তাই দেশে থেকে কিছু একটা করে যেতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। এদিকে দুবাইয়ে তার এক খালুর মাল্টিশপ আছে সে চাইছে সেখানে চলে যেতে। একমাত্র ছেলে মনটা মানছে না তারপরও তার তো কিছু করতে হবে। এ দুর্মূল্যের বাজারে যেখানে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকার ভালো রেজাল্ট করেও চাকরি পাচ্ছে না সেখানে এই নূন্যতম রেজাল্ট দিয়ে সে কীভাবে আগাবে। আমি তো আর সারাজীবন বেঁচে থাকব না তার ভবিষ্যৎ জীবিত থাকতে গড়ে দিতে না পারলে কবরে গিয়েও শান্তি পাব না। হাঁটতে হাঁটতে গোরস্থান পর্যন্ত চলে এসেছি। দোয়া শেষে কিছুটা সময় সেখানে কাটালাম ভালো লাগছে। ওখানে যে চিরদিনের জন্য শুয়ে আছে সে আমার অতি আপনজন। আমার সময়ও হয়তো আর বেশি একটা নেই। কোনো একদিন জীবনের নিয়ম ভেঙে আমিও তার পাশে এসে জায়গা নিব। আমাদের দুজনের সাংসারিক জীবনে তাকে অনেক কিছুই বলার ছিল অথচ বলা হয়নি। বলা হয়নি তোমার কাছে আমার আর কোনো পাওয়া নেই কারণ যা কিছু চাওয়া ছিল তার বহুগুন আমাকে দিয়ে গেছ। বলা হয়নি তোমাকে আমার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমাদের অনেক কথাগুলোই অসম্পূর্ণ থেকে যায় যা বলা হয় না। বলা হয় না বলেই আফসোসটা থেকে যায় শেষ অবদি। হাঁটতে হাঁটতে বাসার কাছে চলে এলাম। পেনশনের টাকাগুলো বুঝে পেয়েছি বেশ কিছুদিন হলো অথচ এখনো সেগুলো নিয়ে কিছু করা হয়নি। আয়েশার ইচ্ছে ছিল আমার অবসর হয়ে গেলে পেনশনের টাকা দিয়ে দুজনে হজ করে আসব কিন্তু তার ইচ্ছেটা রাব্বুল আল-আমীন পূর্ণ করল না। তার নেক আমলের বদলে হয়তো বেহেশতের তওফিক দান করবেন-আমীন।

‘আব্বু খাওয়ার টেবিলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছি আপনি ফ্রেশ হয়ে চলে আসুন।’

‘ব্যাস পাঁচ মিনিট, তোমরা বস গিয়ে আমি আসছি।’

প্রতিদিন আমাদের একসাথে খাওয়া হয় না যদিও তারপরও জুম্মাবারে পরিবারের সকলকে নিয়ে একসাথে খাবার টেবিলে বসার চেষ্টা করি। এতে মহব্বত বাড়ে আর সংসারে একে অপরে অমিল হওয়ার সুযোগটাও কমে যায়। মেয়ে-মেয়ের জামাই একই শহরে থাকায় প্রায় শুক্রবারেই আসে বাসায়। ভালো লাগে সন্তানদের কাছে পেলে।

‘বাহ্ আমার পছন্দের খাবারগুলো আছে দেখছি।’

‘আপনি গরুর কালভূনা পছন্দ করেন তাই রান্না করেছি। আজ রান্না আমার নিজের করা আব্বু। খালাকে বলেছি রান্না না করতে। কাল থেকে তো উনিই আপনাদের রেঁধে খাওয়াবেন। জিসানের জন্য কাচ্চি করে দিয়েছি ও সেটা খুব পছন্দ করে। সে আর তার দুলাভাই কাচ্চি খাবে আর আমাদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা আছে।’

‘ফ্রিজে তো গরুর গোসত থাকার কথা না বাজারে কাকে পাঠিয়েছিলি?’

‘ওরা শালা-দুলাভাই মিলে আজ বাজার করেছে।’

‘আব্বা আপনার অবসর পরবর্তী কিছু ভেবেছেন নাকি?’

‘না সোহেব তেমন কিছু ভাবিনি। সবে মাত্র পেনশনে গেলাম এখন কেন এসব? যাক না আরও কিছুদিন তারপর না হয় দেখা যাবে। আমার তো ছেলেকে নিয়ে টেনশন। তুমি মেয়ের জামাই তাই তোমার সাথে শেয়ার করি বিষয়টা।’

‘অবশ্যি করবেন আব্বা। তা কী শেয়ার করতে চান বলুন দেখি।’

‘বলছিলাম কী তোমার শ্যালক জিসান সে এবার কলেজ পাশ করল। তার জন্য কিছু একটা করা প্রয়োজন। রেজাল্টের যা অবস্থা তাতে মনে হয় না দেশে একটা ভালো চাকরি জোগাড় করতে পারবে। ওরও ইচ্ছে দেশের বাইরে গিয়ে কিছু একটা করার।’

‘তা কোথায় যেতে চাইছে?’

‘দুবাই। তোমার এক খালু শশুড়ের মাল্টিশপ আছে। ওর ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নিচ্ছে। দেশ থেকে কিছু লোক সে নিবে তার দোকানের জন্য। আমাকে বলেছিল বিষয়টা এইতো গত পরশু কথা হয়েছিল আমি বলেছিলাম পরে জানাব তাকে। এদিকে জিসানেরও আগ্রহ আছে সেখানে যাওয়ার। তোমরা আমার আপনজন তাই তোমাদের সাথে কোনো পরামর্শ না করে যেতে দিতে পারি না।’

‘আমি বলছিলাম কী যেতে চাইছে সেটায় সমস্যা না। ওখানে গিয়ে যেন বসে না থাকতে হয় নয়তো বিদেশে গিয়ে কোনো লাভ হবে না। আপনি এটা কনফার্ম করতে পারলে আমার মনে হয় যাওয়ার সিদ্ধান্ত খারাপ হবে না আব্বা।’

‘আপনজনের মধ্যে তাই সাহস করা যায়। এখন মানুষ বিদেশ গিয়ে অপরিচিতদের মাঝে কাজ-কর্ম করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে আর এখানে তো নিজেদের মানুষ আছে, সমস্যা হওয়ার কথা না। তোমরা সায় দিলে বিষয়গুলো নিয়ে তার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করব। পড়াশোনা যখন ভালোভাবে করতেই পারছে না তাহলে দেশে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। এখন যুবক বয়স বাইরে গিয়ে শ্রম দিয়ে কিছু কামাই রোজগার করে এনে দেশে ভালো একটা এমাউন্ট দিয়ে ব্যবসা করলে বাকি বয়সটুকুতে নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবে। আমার কী, আমি তো সারাজীবন তাকে আগলে রাখতে পারব না। ভেবেছিলাম একমাত্র ছেলে আমার ভালো রেজাল্ট করবে, বড়সড় না হোক কোনোমতে একটা চাকরিও যদি করে তাহলে আমার আর কোনো টেনশন নাই কিন্তু সেটা যখন হয়নি তাহলে এখন থেকেই পরিশ্রম করুক, কী বলো তোমরা।’

‘আমি আপনার সাথে একমত আব্বা আশাকরি ওর বোনও আপত্তি করবে না।’

‘আব্বু আমাদের একটা মাত্র ভাই আমরা দু বোন মিলে কী ভাইকে চালাতে পারব না?’

‘অবশ্যি পারবে। তা কতদিন চালাবে তোমরা দু-বছর, চার বছর, দশ বছর, তারপর? তোমরা কী চাও না তোমাদের ভাই নিজ যোগ্যতায় কামাই করুক। দান নিয়ে কিছু সময় চলে গেলেও জীবন চালানো যায় না। একটা কথা মনে রেখ দান যখন দীর্ঘ সময় ধরে চলে তখন সেটা দান থাকে না হয়ে যায় ভিক্ষা। ছেলে আমার কর্মঠ হোক ভিখারি নয়, বাবা হিসেবে সন্তানের জন্য এটাই কামনা করি। আমি তোমাদের স্বাবলম্বি হতে শিখিয়েছি পরনির্ভরশীল হতে নয়।’

‘ঠিক আছে আব্বু আপনি যেভাবে ভালো মনে করেন। আপনি কখনো আমাদের জন্য খারাপ কিছু ভাববেন না।’

‘তাহলে তোমাদের সম্মতিতে আমি কথা ফাইনাল করে ওর যাওয়ার ব্যবস্থা করি, কী বল তোমরা?’

‘জিÑআপনি যেমনটা ভালো মনে করেন, আমরা সহমত।’

খাবার টেবিলে আর এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো কথা হয়নি। এদিকে একমাত্র ছেলে চলে যাবে দূর দেশে কথাটা ভাবতেই কেমন যেন আঁতকে উঠল

মন। ওর মায়ের মৃত্যুর পর সংসারটা ওলট-পালট হয়ে গেল। বড় মেয়ের বিয়ে হলেও ছোটটা তখনো কলেজ ছাত্রী। মেয়ের জামাই সে সময় পাশে এসে না দাঁড়ালে আমার পক্ষে সংসারের হাল ধরে রাখা সম্ভব হতো না। ছেলেটা তখন ষষ্ট শ্রেণিতে পড়ে। এত অল্প বয়সে মা হারা হওয়ায় তাকে শাসন করা বা পড়াশোনার জন্য কঠোর হওয়া হয়নি কারো। এদিকে বোনদের আদরের ছোট ভাই তাই তার সকল আবদারই ওরা চেষ্টা করেছে পূরণ করতে। ছোট মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আমি আরও অসহায় হয়ে পড়ি। এই ছেলেকে নিয়েই অবশেষে আমার সংসার গড়ে ওঠে। ছোটবেলায় ছেলেটা লেখাপড়ায় বেশ ছিল কিন্তু ওর আম্মার মৃত্যুর পর সকলের আদর ও মমতায় বেখেয়ালি হয়ে উঠেছে। পড়াশোনায় কোনো মনযোগ নেই শুধু খেলা আর আড্ডাবাজি। এটা থেকে দূরে পাঠাতেই তার বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্তে আমি দ্বিমত করিনি। সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ না হলে বাবা-মায়ের সারাজীবনের চেষ্টাই বিফলে যায়। নরেনদ্র দা একটা কথা ঠিকই বলতÑআমাদের জীবন সংসার একটা সাধনা আর এ সাধনায় আমরা অজান্তেই একেকজন সাধক।

[পরের পর্ব আগামী সংখ্যায় দেখুন]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়