প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:০২
সাক্ষাৎকার : এম. এম. শরফুদ্দিন
সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ

কবি ও শিক্ষক এম. এম. শরফুদ্দিন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প ও ফিচার লেখার মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা করে আসছেন। অমর একুশে বইমেলা-২০২৫ তাঁর লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মুক্তিপত্র’ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘পাঠক ফোরামে’র মুখোমুখি হন।
আপনার কবি হয়ে ওঠার যাত্রাটা কেমন ছিল? কোথা থেকে শুরু হলো কবিতা লেখা?
এম. এম. শরফুদ্দিন : আপনাকে ধন্যবাদ একটি মূল্যবান প্রশ্ন করার জন্য। আমি কবি হতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে কবিতা লেখার শুরুটা ছিল একটু এলোমেলো। কী লিখতে, কী লিখতাম তা বুঝতে পারতাম না। অনেক কাটাকাটির পর একটি লেখা দাঁড় করানো সম্ভব হতো। তারপরেও থেমে নেইÑলিখতে শুরু করি, লিখে যাচ্ছি। মাধ্যমিকের গণ্ডিতেই আমার লেখালেখি শুরু, যা এখনো চলমান।
আপনার শৈশব, পারিবারিক পরিবেশ কিংবা কোনো বিশেষ স্মৃতি কি আপনাকে লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ করেছে?
এম. এম. শরফুদ্দিন : হ্যাঁ, শৈশব থেকে আমি নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করতাম। আর এই নিরিবিলি থাকা থেকে কবিতা লেখা শুরু করি। পারিবারিক পরিবেশও আমার লেখালেখিতে সহায়তা করেছে। যেমনÑআমি যখন বাড়িতে আমার রুমে অবস্থান করতাম তখন বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কেউ আমার রুমে আসতো না। যার ফলে আমার লেখালেখিতে বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হতো। আমিও উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে ভুল করতাম না।
শিক্ষকতা এবং কবিতাচর্চা এই দুই ভূমিকায় আপনি কীভাবে ভারসাম্য রাখেন?
এম. এম. শরফুদ্দিন : শিক্ষকতা এবং কবিতাচর্চা এই দুইটি বিষয় আমার কাছে মনে হয় একটির সাথে অন্যটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যদিও আমি শিক্ষকতা পেশার অনেক পূর্ব থেকেই কবিতাচর্চা করে আসছি। কারণ আমি বাংলা বিষয়ের একজন ছাত্র হিসেবে কবিতাচর্চাটা ভালো লাগতো। শিক্ষকতা একটি পেশা এবং সেখানে সাহিত্যের রস ও ভাব অনুধাবন করার সুযোগ রয়েছে। যাকে সাহিত্যের সেই রস ও ভাব আকর্ষণ করে সে হয়ে যায় সাহিত্য প্রেমি, হয়ে যান লেখক। তাছাড়া শিক্ষকতা পেশার কারণেই আমার কবিতাচর্চা করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণÑশিক্ষকতা পেশায় নির্দিষ্ট সময় শেষে লেখালেখির জন্য অনেক সুযোগ পাওয়া যায়, যে জন্য এ দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্যহীনতার অভাব কখনই অনুভব করিনি।
সম্প্রতি আপনার কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। এই বইয়ের লেখার পেছনে কী কী ভাবনা কাজ করেছে?
এম. এম. শরফুদ্দিন : আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন যে, অমর একুশে বইমেলা-২০২৫খ্রি. আমার লেখা প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মুক্তিপত্র’ প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম কবিতা ‘মুক্তিপত্র’ কবিতায় কাব্যগ্রন্থের মোট ৩২টি কবিতার নামকরণ তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি কবিতায় যে ভাবনাটি ফুটে উঠেছে তা হলোÑমুক্তি। অর্থাৎ মানব জাতি হিসেবে আমাদের জীবনের সাথে জড়িত প্রতিটি অসঙ্গতি থেকে আমরা কীভাবে মুক্তি পেতে পারি তারই ইঙ্গিত প্রতিটি কবিতায় রয়েছে। তাছাড়া ভালোবাসা হচ্ছে একটি মহৎ বিষয় কিন্তু দেখা যায় এই মহৎ বিষয়টিতেও অশ্লীলতা জড়িত। এই অশ্লীলতা থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় অথবা কী করলে অশ্লীলতার প্রসার হবে না সেই বিষয়েও ভাবনা আমার লেখায় রয়েছে।
আপনার কবিতার প্রধান প্রধান থিম বা বিষয়বস্তু কী?
এম. এম. শরফুদ্দিন : আপনি যদি আমার কবিতার বইটি পড়েন তখন উপলদ্ধি করতে পারবেন যে, প্রতিটি কবিতার বিষয়বস্তু একটিমাত্র লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে লেখা। আর সেই লক্ষ্যটি হচ্ছেÑমানুষ, সমাজ, দেশ, জাতি এবং বিশ্বকে সকল ধরণের প্রাকৃতিক অভিশাপ, মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, অপশক্তি, অন্যায়, জুলুম থেকে কীভাবে মুক্তি লাভ করা যায়। তবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা, সম্মান ইত্যাদির উপর অধিকতরভাবে জোড় দেওয়া হয়েছে।
কবিতায় আপনি কী বেশি গুরুত্ব দেনÑভাব, ভাষা, নাকি ছন্দ?
এম. এম. শরফুদ্দিন : কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ভাব, ভাষা ও ছন্দ সবগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হয়। আমি চেষ্টা করি সবগুলো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কবিতা লেখার জন্য। কতটুকু সফল হয় তা বিচার করার ভার আমার সম্মানিত পাঠকবৃন্দের কাছে।
কবিতা লেখার সময় আপনার অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি কেমন থাকে? নির্জনতা দরকার হয়?
এম. এম. শরফুদ্দিন : অভ্যন্তরীণ এবং বিষয়বস্তুর উপর প্রস্তুতি না থাকলে সঠিক মানদণ্ডে লেখা সম্ভব হয় না। একটি ভালো লেখার জন্য অবশ্যই অভ্যন্তরী প্রস্তুতি থাকা জরুরি। অবশ্যই নির্জনতা প্রয়োজন, যে কোনো লেখার ক্ষেত্রে নির্জনতা না থাকলে লেখার ভাব এবং ব্যঞ্জনা ধরে রাখা যায় না। প্রকৃতপক্ষে আমি নির্জনতা ছাড়া ভালো লিখতে পারি না। এটা আমার খুবই খারাপ একটি দিক।
কোন কবি বা সাহিত্যিকেরা আপনার লেখায় প্রভাব ফেলেছেন?
এম. এম. শরফুদ্দিন : আমি আমাদের দেশের প্রত্যেক কবি, লেখক ও সাহিত্যিকদের শ্রদ্ধা এবং সম্মান করি। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এদের লেখা সাহিত্যগুলো আমাকে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশে অনুপ্রাণিত করেছে।
আপনি কি সমসাময়িক বাংলা কবিতা পাঠ করেন? কার লেখা আপনাকে আকর্ষণ করে?
এম. এম. শরফুদ্দিন : পেশাগত কর্মব্যস্ততার কারণে সম্প্রতি তেমন কোনো কবিতা পাঠ করা হয় না। বাংলাদেশে সমসাময়িক অনেক কবি আছেন, তার মধ্যে : শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলেন উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে কবি আল মাহমুদের কবিতা আমাকে আকর্ষণ করে।
শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে আপনি কীভাবে অনুপ্রাণিত করেন?
এম. এম. শরফুদ্দিন : যেহেতু আমি প্রাথমিকের শিক্ষক সেহেতু আমার শিক্ষার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিশুতোষ ছড়া, গল্প পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে থাকি। তাছাড়া পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদেরকে মাসের ২য় ও ৩য় বৃহস্পতিবার নিজেদের মাঝে গল্প বলার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মাসে একজনকে সেরা পাঠক নিবার্চন করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করে থাকি। এতে করে শিক্ষার্থীরা গল্প পড়তে এবং লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়। আবার ছড়া তৈরির ক্ষেত্রেও আমি একটি লাইন তৈরি করে দিয়ে তাদেরকে ছন্দ মিলিয়ে পরবর্তী লাইন তৈরি করতে বলি। যেমন : ‘বিদ্যালয় ছুটি হলে ভাই’। দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থী পরের লাইনটি লেখে : ‘বাড়ি চলে যাই’। এইভাবে শিক্ষার্থীদেরকে সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী করে তুলতে চেষ্টা করি, শিক্ষার্থীরাও এতে আনন্দ পায়।
একজন শিক্ষক ও একজন কবি হিসেবে আপনি সমাজে কী ভূমিকা রাখতে চান?
এম. এম. শরফুদ্দিন : দেখেন আমরা সবাই মানুষ, কিন্তু কয়জন লোক আছি ভালো মানুষ? একজন শিক্ষক হিসেবে আমি সব সময় আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখাই এবং একজন ভালো মানুষ হওয়ার ভীত তৈরি করতে চেষ্টা করি। যাতে তারা একসময় সমাজে সত্য ও ন্যায়ের কথা বলতে পারে। কবি হিসেবে আমি আমার সমাজের যত অন্যায়, অবিচার, জুলুম রয়েছে তার বিরুদ্ধে কবিতা লেখবো এবং তরুণরা তাদের শক্তি ও সামর্থকে ভালো কাজে লাগিয়ে সমাজকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয় কবিতার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করবো। তাছাড়া আমি কয়েকটি সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত থেকে তাদেরকে সামাজিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দিচ্ছি।
ভবিষ্যতে কী ধরনের লেখালেখি বা সাহিত্যকর্ম নিয়ে আপনি কাজ করতে চান?
এম. এম. শরফুদ্দিন : যেহেতু আমি একজন প্রাথমিকের শিক্ষক সেহেতু ভবিষ্যতে পাঠকদের শিশুতোষমূলক কিছু একটা উপহার দেবার আশা রাখি। আপনি হয়তো জানেন আমি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় কবিতার পাশাপাশি ছোট গল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচার লেখে থাকি। আরেকটি কথা না বললেই নয়, তা হচ্ছে আমার লেখালেখিতে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং আমার ‘মুক্তিপত্র’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়েছেন আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষাগুরু জনাব হাবীব উল্লাহ ভূঞা (সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, নারায়ণপুর ডিগ্রি কলেজ, মতলব দক্ষিণ, চাঁদপুর)। স্যারের প্রতি আমি সবসময় কৃতজ্ঞ। তাছাড়া আমার কবিতা লেখার আগ্রহ যুগিয়েছে ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ পত্রিকা। কেননা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘পাঠক ফোরাম’-এ আমি নিয়মিত লেখতাম এবং প্রকাশও হতো। নিজের কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সেই উৎসাহ আমার লেখালেখিতে বিশাল প্রভাব রেখেছে। তাই আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই ‘দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ’ পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি।
নতুন লেখকদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
এম. এম. শরফুদ্দিন : নতুন লেখকদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে যে, আপনার প্রতিভা আপনি চেষ্টা না করলে প্রস্ফুটিত হবে না। তাছাড়া আমরা জানি, সাহিত্য হচ্ছে সমাজের দর্পণ। সমাজের অসঙ্গতিগুলো সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরার জন্য নবীনদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তাই বলবো যারা নতুন লেখক আপনারা লেখে যান এবং আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করুন।