প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২৫, ০৯:০০
অবুঝ প্রাণীর টান

আমিন ছোট থেকে যেমন কঠিন, তেমন নরম মনের মানুষ ছিলো। মানুষ থেকে শুরু করে পশু-পাখি সবার জন্যেই উপকারী ব্যক্তি ছিলো। শিশুদের আদর করতো বেশ। কারো সন্তান যখন শরীরে কাদা-মাটি লাগিয়ে খেলা করতো, তখন তাকে ধুয়েমুছে ঘরে পৌঁছে দিতো সে।
আমিন শহরের তুলনায় গ্রামের বাড়িতে থাকতে বেশি পছন্দ করতো তার স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে। তার গ্রামের নাম ছিলো মনোহরপুর গ্রাম। ঐ গ্রামে যাতায়াতের একমাত্র ব্যবস্থা ছিলো নৌকা এবং ছোট লঞ্চ। আবার সন্ধ্যার পর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পায়ে হেঁটে বা নিজস্ব বা পরিচিত নৌকা থাকলে যাতায়াত করা লাগতো। একদিন রৌদ্রমাখা ঝলমলে দিনে আমিন কাজের উদ্দেশ্যে একটি স্থানে যায়। সেখান থেকে ফেরার সময় গ্রামের খালের পাড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলো। হঠাৎ দেখতে পেলো একটি ছোট কুকুর স্রোতের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। সে দ্রুত একটি কলাগাছের বাকল দিয়ে কুকুরটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো। কুকুরটি কোনো রকমে একটি মানুষের সাহায্যের হাত বাড়াতে দেখে কলাগাছের বাকলটি ধরে উপরে উঠে আসলো।
কুকুরটি খুবই ক্লান্ত ছিলো। আমিন তখন পাশের একটি দোকান থেকে কিছু খাবার কিনে কুকুরটিকে খেতে দিলো। কুকুরটি খাবার পেয়ে শরীরে শক্তি ফিরে পেলো। আমিন কুকুরটিকে কিছুটা সুস্থ দেখতে পেয়ে বিদায় দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লক্ষ করলো পেছন কে যেন হাঁটছে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো সেই কুকুরটি। কুকুরটি আমিনকে অনুসরণ করছিলো। যদিও কুকুর মানুষের ভাষা বুঝে না, তারপরও আমিন বললো, তুমি চলে যাও তোমার পরিবারের কাছে। কিন্তু কুকুরটি কিছু না বুঝলেও কোনো এক টানে আমিনের সাথেই চলতে শুরু করলো এবং একসাথে আমিনের সাথে বাড়িতে চলে আসলো।
তারপর থেকেই আমিনের সাথেই থাকা শুরু হলো কুকুরটি।
আমিন কুকুরটির নাম দিয়েছিলো মতি। মতি আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে এবং তাদের দুজনার ভেতর অন্যরকম সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
যখনই আমিন কোথাও যেতো, মতি আমিনের পিছু পিছু যাওয়ার চেষ্টা করতো। গ্রামীণ রাস্তা, সাঁকো কিংবা নৌকা দিয়ে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে যেতে হয়।
আমিন কোথাও গেলে আমিনের অনুপস্থিতিতে ঘর-বাড়ি পাহারা দিতো মতি। আমিন কোথাও গেলে মতি ছুটে নদীর পাড়ে যেতো, কখন তার মালিক আসবে তার জন্যে অপেক্ষা করতো। দূর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যায়, কখনো রাতে। যখন দেখতো তার মালিককে দূর থেকে, চারদিকে ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেতো এবং একজন দায়িত্ববান সঙ্গী হিসেবে তাকে অ্যাপায়ন করতো। খুব খুশি থাকতো মতি। আমিনও মতিকে দেখে শান্তি পেতো।
আমিন মতিকে প্রায়ই তার খাবারের অংশ খেতে দিতো পরিবারকে লুকিয়ে। অসুস্থ হলে ওষুধ খাওয়াতো। বৃষ্টি-ঝড়ের দিনে থাকার ব্যবস্থা করে দিতো। এভাবেই দিন কাটতো তাদের। আমিনের দুটি সন্তান ছিলো, তারাও মতিকে খুবই ভালোবাসতো।
মতি এখন অনেক বড়। তার ১০টি ছানা হয়েছে, এর মধ্যে ২টি বেঁচে আছে। তাদের নাম রাখা হয়েছিলো টনি ও টমি। মতির বয়স বেশি হওয়ায় মতি অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তারপর থেকে আমিনের সঙ্গী ছিলো টমি ও টনি।
আমিন খুবই কষ্ট পেয়েছিলো মতির মৃত্যুতে। কিন্তু টমি ও টনি ঠিক তাদের মায়ের মতো আমিনের প্রতি অসামান্য ভালোবাসায় মত্ত। মতি যা করতো, টমি ও টনিও সেই একই কাজ করতো আমিনের জন্যে। দিন এভাবেই চলছিলো।
একদিন সকালে আমিন একটি কাজে যায়। টমি ও টনি খুবই অস্থিরতায় ছিলো। তারা আজ আমিনের পিছে যাবেই। আমিন নৌকা করে নদী পার হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ টনি নদীতে ঝাঁপ দিলো। সাঁতরিয়ে আমিনের কাছে পৌঁছালো। আমিন কোনোভাবে যেতে পারছিলো না। যদি হারিয়ে যায় বা কোনো ক্ষতি হয় টনির। আমিন আবার টমি ও টনিকে বাড়িতে রেখে আসার জন্যে বাড়িতে ফিরে আসলো। পরে অন্যভাবে বাড়ির পেছন দিয়ে আমিন চলে গেলো। কিন্তু অবুঝ প্রাণীগুলো বুঝলো তার মালিক ঘরেই আছে। তাই শান্ত হয়ে বসে রইলো দরজার সামনে।
অনেকদিন হলো টমি ও টনি তার মালিককে দেখতে পাচ্ছে না। ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তাদের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। কারণ রাত হোক বা দিন সকালেই তার মালিক আমিনকে দেখতে পেতো।
কেউ নদীর পাড়ে, কেউ ঘরের কোণায় দরজার পাশে বসে থাকে এবং মাঝে মাঝে তাদের মালিককে ডাকে তাদের নিয়মে। মালিকের শব্দ নেই, দেখা নেই।
মালিককে দেখবেই বা কীভাবে। মালিক তো সেদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং সেদিন রাতেই তার পরিবারের লোকজন আমিনের কাছে চলে গিয়েছিলো।
দীর্ঘ অসুস্থতার পর আমিন মৃত্যুবরণ করলো। টমি ও টনির সাথে আর দেখা হলো না। যখন আমিনকে বাড়িতে নিয়ে আসলো, কুকুর দুটির খুশির শেষ ছিলো না আমিনের পরিবারকে দেখে। কারণ তাদের সাথে তাদের মালিক তো রয়েছেই। কিন্তু মালিককে দেখতে পায় না। তবে তার ঘ্রাণ পাচ্ছে।
অবুঝ প্রাণীর বুঝতে বাকি ছিলো না খাটিয়াতেই শুয়ে আছে তাদের প্রাণপ্রিয় মালিক। টমি ও টনি নিস্তব্ধ হয়ে মালিকের খাটিয়ার পাশেই বসে রইলো। তাদের দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে, আশেপাশের মানুষ দেখতে পেলো সেটি এবং গোঙ্গানোর শব্দ করছিলো আমিনের নিথর দেহের পাশে। তাদের ছায়া চলে গেলো।
আমিনকে দাফন করতে যখন মাটি দেয়া হলো, তখন টমি ও টনি বাধ্য সন্তানদের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। মাটি দেয়া শেষ হয়ে গেলে সবাই চলে গেলেও টমি ও টনি তার মালিককে একা রেখে যায় নি। তার মালিকের কবরের পাশে বসে ছিলো।
গ্রামবাসী-আত্মীস্বজন লক্ষ করলো, এই দুটি প্রাণী মালিকের কবরের পাশে সব সময় শুয়ে বসে থাকে। একজন কোথাও গেলেও অন্যজন তার মালিকের কবরের পাশে বসে থাকে। তাদের শান্তির জায়গা এখানেই। রাত-দিন আমিনের কবর পাহারা দেয়াই যেনো তাদের কাজ। এরকমই চলছিলো তাদের প্রাণ থাকা অব্দি। গ্রামবাসী বুঝতে পারলো অবুঝ প্রাণীর মায়া, ভালোবাসা, টান। মানুষ ভুলে গেলেও ভুলে যায় না অবুঝ প্রাণীরা।