শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪

অপেক্ষা

সুমাইয়া শিমু
অপেক্ষা

মহাসড়কের পাশে বন্ধ একটা দোকান, সম্ভবত চায়ের দোকান। সেই দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো সাদ আর তার বাবা অয়ন হোসেন।

সাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে বাবা তুমি এখানে দাঁড়াও অনেক রাত হয়েছে, দেখি কোন গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।

অয়ন হোসেন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ১১:৪৫ বেজে গেছে। সাদ তুই বড় এখানে বসে পর কাল সকালে যা করার করিস আজ রাস্তায় বেশ ফাঁকা আমার খুব ভয় করছে চাঁদ একটু হেসে পড়ে তুমি ভয় পাচ্ছ কিচ্ছু হবে না বাবা দেখছো না কতগুলো লাইভ চলছে ভয়ের কিছু নেই এই যাবো তো এই চলে আসব।

অয়ন হোসেন ছেলের হাত ধরে বলে বুড়ো হয়েছি, নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়েছি, মনে করে আমাকে নিয়ে যাবি তো?

তার বাবার হাত দুটো ধরে বসিয়ে দিলো। তুমি এখানে চুপ করে বসে থাকবে। যতক্ষণ না আমি আসি তুমি এখান থেকে এক পাও নড়বে না।

সাদ রাস্তা পেরিয়ে হাই রোডের দিকে চলে যাচ্ছিল গাড়ির সন্ধানে, আর বৃদ্ধ বাবা অয়ন হোসেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! রাতের বেলা হাইরোড যেন এক আতঙ্ক। খুব কম গাড়ি যাতায়াত করছে। অনেকটা সময়ের পর পর একটা করে গাড়ি যাচ্ছে।

অয়ন হোসেন ভাবলেন ছেলে এই বুঝি গাড়ি নিয়ে আসলো। খুব খিদে পেয়েছে, একটু খাবার খেয়ে নেন আবার পথের দিকে চেয়ে থাকেন । মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে ঐতো ছেলেটা আসছে। যত সময় যাচ্ছে ততই অয়ন হোসেনের ভয় বাড়তে লাগলো। বৃদ্ধ অয়ন ছেলের পথ চেয়ে সারা রাত কাটিয়ে দিল। তবে সাদ এখনো আসেনি। বৃদ্ধ অয়ন সারারাত ঘড়ির কাঁটা গুনছে। তবে গুনতে গুনতে সকাল হয়ে গেল ।বৃদ্ধ অয়ন এখন ভয় পেতে লাগলো । ছেলেটার আবার কিছু হয়নি তো ? না হলে তো ছেলেটা এতক্ষণে চলে আসতো। নাকি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মনে মনে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো। তৎক্ষণাৎ নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে বৃদ্ধ অসুস্থ বাবাকে কেউ ফেলে যেতে পারে নাকি?

রাস্তার পাশে বসে আছেন। আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে কুয়াশায় আশেপাশে তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আজ খুব শীত পড়েছে। অচেনা শহর এই শহরে আমার ছেলেটা হারিয়ে যায়নি তো?

পুরো শরীর কাঁপছে। কোথাও শোয়ার একটু জায়গা নেই। সারারাত ছেলের কথা ভেবে ছেলের কথামতো এখানেই ছেলের জন্য অপেক্ষা করছিল। বৃদ্ধ মানুষ এখন যে শীতের কাছে নিজের কাছে যুদ্ধ করতে আর পারছে না। মনে মনে ভাবছেন ঘরে থাকলে এতক্ষণে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম।

বৃদ্ধ অয়নের কাঁধে একটা ব্যাগ আর কিছু টাকা অনেকগুলো ঔষধ আর কিছু কাগজপত্র এই ব্যাগটি বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে ঘুরি-মুড়ি হয়ে বসে আছেন। আর ছেলের অপেক্ষা করছেন তবে না ছেলে তো আর আসছে না বাবাকে নিতে।

অয়ন হোসেন পথের ধারে চুপ করে বসে বসে হাজার ছেলে মেয়েকে যেতে দেখে। কিন্তু তার ছেলে তো আসছে না। উনার চোখে মুখে করুন অপেক্ষার ছাপ বসে গেছে। যা হাজার টাকার ফলমূল খেলে ও যাবে না। বসে থাকতে থাকতে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসলো, ওমনি কারো কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে বললেন খোকা এলি তুই? চোখ খুলে দেখে এত খোকা নয় ওই ছেলেটা বলছে: ও কাকু কে আপনি? এটা আমার দোকান। এখানে কি করছেন? একটু তাকিয়ে দেখেন কাকু এটা অভির চায়ের দোকান। মানে আমার দোকান।

অয়ন : চশমার কাঁচ মুছে বলেন, ঠিক আছে বাবা। সরে যাচ্ছি।

অভি : সরে যেতে হবে না কাকু। আপনি এক পাশে বসেন। সকাল সকাল তো দোকানে কাস্টমার আসবে।

বৃদ্ধ অয়ন কে দেখে কাস্টমার এসেই জিজ্ঞেস করে , কিরে অভি কে এই বৃদ্ধ?

অভি : (একটু মজা করে বলে) পুরনো ফার্নিচার ভাইয়া ভাবি ব্যবহার করতে পারবে না । তাই রাতের আধারে ফেলে রেখে গেছে।

দোকানে একটু ভিড় কমতে অভি ঐ বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বলে।

অভি : কাকা, তোমার বাড়ি কোথায়?

বৃদ্ধ এবার একটু অন্য মনস্ক হয়ে বলে, খোকা বলে গেছে যতক্ষণ না আমি আসি এখান থেকে এক পাও নড়বে না। খোকা এনে ফিরে যাব এবার ওকে খুব কষ্ট হল।

অভি : (হাত মুখ ধোয়ার জন্য পানি দিয়ে বলছ যায়) নিন কাকু হাত মুখ ধুয়ে নিন।

বৃত্ত মাথা নেরে সম্মতি জানালো।

অভি চা-বিস্কুট দেয়। বৃদ্ধ ছোট বাচ্চার মত আস্তে আস্তে খেয়ে নেয়। পরে নিজের কাছে থাকা খাবার বের করেন। বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে।

অভি কাছে এসে বলে কাকু তোমার বাড়ি কোথায়?

তুমি বলতে পারবে তোমার বাড়ির ঠিকানা।

এবার বৃদ্ধ বলেন গোপালগঞ্জ। আমি বুঝতে পারছি এখানে থাকলে তুমি বিরক্ত বোধ করছ।

অভি : না কাকু তা নয়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি শিক্ষিত ও সাধারণ গরিব ঘরের মানুষ নয়, যাই হোক মুড়ি খাও তোমার খিদে পেয়েছে।

খাওয়া শেষ করে বৃদ্ধ টাকা দিতে যায়।

অভি : ওটা থাক কাকু, তোমার কাজে লাগবে।

এমন সময় কিছু লোক এসব বলে , কতবার বলেছি দোকান এখানে দিবি না । যদি কাল সকালে দোকান দেখি তোর ভালো হবে না।

অয়ন হোসেন লোকগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন। কেন ও এখানে দোকান দেবে না?

তোকে কেন বলবো রে?

অন্যজন বলে, ও এখানে থাকলে আমাদের একটু অসুবিধা হবে।

বৃদ্ধ অয়ন: কেন? এত বড় রাস্তা ওর এই জায়গাটা প্রয়োজন কেন?

আগের জন বলে :এত কথা তোর জানার প্রয়োজন নেই চুপ করে বসে থাকো।

অভি : কাকা তুমি কিছু বলো না।

বৃদ্ধ অয়ন: ঠিক আছে দেখা যাবে কে কি করতে পারে।

কাল এসে যেন এই দোকান না দেখি অভি কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখে।

ওরা চলে যাওয়ার পর বৃদ্ধ অয়ন অভিকে বলে;

বৃদ্ধ অয়ন: আমার মনে হয় ওরা এই জায়গাটা দখল করে কিছু একটা করতে চায় ।ঠিক আছে, একটা কাগজ আর কলম দাও তো আর ওদের নামগুলো বলতো।

কাগজে কিছু লিখে অভির হাতে দিয়ে বলেন , কোর্টে গিয়ে অরুণ সেনগুপ্ত নামক ব্যক্তির হাতে দিবে। আশা করি কাজ হয়ে যাবে।

অভি সাইকেল চালিয়ে চলে গেল।

অভি কোর্টে এসে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে অরুন স্যার কোথায় ?

কেউ মুখ ঘুরিয়ে দেখে কিন্তু কেউ কথা বলে না। কেউ আবার কিছু না বলে অভির পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ ভোলায়। কেউ ফোনে এত ব্যস্ত যে কথা না বলে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

বেচারা অভি বুঝতে পারছিল না কি করব? মনে মনে ভাবে ওই কাকুর কথা শোনা ঠিক হয়নি। আবার ভাবে যদি অরুন স্যারকে পাই যদি কিছু একটা হয় তাহলে। এসব ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালো। কোর্টে শত শত মানুষ ওদের সবাইকে দেখছি আর ভাবছে এরা শিক্ষিত মানুষ আমি গরীব মূর্খ এদের সাথে কি আর আমাকে মানায় এখানে। গরিব মূর্খ বলেই এরা আমাকে গ্রাহ্য করছে না।

এসব ভাবতে পারতে আবারও একটা খালি বেঞ্চে বসে পড়লো। সামনে দিয়ে একটা কালো কোর্ট পড়া মেয়ে যাচ্ছিলো । সাহস নিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলো ম্যাডাম অরুন স্যার কোথায়?

উনি মিটিংয়ে আছেন দু ঘন্টা পর দেখা করতে পারবেন আর না হয় কাল আসবেন।

অভি : না না ম্যাডাম। আমাকে আজকেই দেখা করতে হবে যে।

তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন। একটা কাজ করেন আপনি আমার সাথে আসেন আমি আপনাকে অরুন স্যারের চেম্বারের সামনে নিয়ে যায়।

অভি : ঠিক আছে ম্যাডাম।

আচ্ছা আপনি কি ওনাকে চিনেন?

অভি : না ম্যাডাম।

আচ্ছা ঠিক আছে আপনি এখানে বসুন এটাই অরুণ স্যারের চেম্বার। আর আমি দারোয়ানকে বলে যাচ্ছি অরুন স্যারের সাথে আপনাকে দেখা করে দেওয়ার জন্য।

অভি : আচ্ছা ম্যাডাম ঠিক আছে।

অনেকক্ষণ পর অরুণ সেনগুপ্ত মিটিং শেষ হলো। অরুন স্যার তখন বেরিয়ে যাওয়ার সময়। দারোয়ান স্যার কে বলল; স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে চায়।

অরুন স্যার: কে আসছে?

দারোয়ান : স্যার ওই তো ওখানে বসে আছে। স্যার আপনি এখানে একটু ওয়েট করুন আমি ওনাকে বলছি আপনার কথা।

দারোয়ান অভিকে অরুন স্যারকে দেখিয়ে দিল।

অভি ভয়ে ভয়ে অরুণ স্যারের সামনে আসলো। সামনে এসেই অরুণ স্যারকে সালাম দিল।

অরুন স্যার : কে তুমি? আর কি চাই?

অভি কথাটা শুনেই ভয়ে ভয়ে ওর কাছে থাকা কাগজটা অরুন স্যারকে দিল।

অরুণ স্যার : এটা কি? বলতে বলতে কাগজটা খুলে দেখেন।

খুলে দেখা মাত্রই অরুণ স্যার অভির হাত ধরে উনার রুমে নিয়ে গেল । আশেপাশের সবাই এটা দেখে খুব অবাক হলো! একটা সাদামাটা মানুষকে উনি এভাবে হাত ধরে কেন নিয়ে গেলেন? রুমে নিয়েই অভিকে বসতে দিলেন।

চিঠিটা পড়ে অরুণ স্যার অভিকে জিজ্ঞাসা করে;

অরুন স্যার : উনি কে হন তোমার?

অভি : কেউ হয় না স্যার ।কালকে রাতে ওনার ছেলে আমার দোকানের সামনে রেখে চলে যান। সকালে যে গন্ডগোল হয় তারপর ওই কাকু আপনার কাছে পাঠান বলেন এতে কাজ হবে।

অরুণ স্যার : উনি কে তা কি তুমি জানো?

অভি : না স্যার। সেভাবে তো কিছুই বলে নাই কে উনি? (ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে)

অরুণ স্যার : তুমি শুনে অবাক হবে যে, উনি কয়েক বছর আগে এই কোর্টের জজ সাহেব ছিলেন কিন্তু আজ ভাগ্য দেখো।

অভি : কি বলেন স্যার উনি জজ সাহেব ছিলেন?

অরুন স্যার : হুম ,তুমি ঠিকই শুনেছ।

অভি : উনার ছেলে মেয়ে নেই?

অরুণ স্যার : আছে, একটা ছেলে আছে।

অভি : ছেলের বউ নিশ্চয়ই আছে । আচ্ছা স্যার উনার ছেলে কি করে?

অরুণ স্যার : সেও মস্ত বড় জজ। তবে দু'বাবা ছেলের মতের মিল ছিল না।

অভি : কেন স্যার? (খুব কৌতূহল বসত বলল)

অরুণ স্যার : সে বিশাল ঘটনা ।তোমায় কিছু বলেনি?

অভি : না স্যার , তবে ওনার সাথে কথা বলে বুঝলাম ছেলে সম্বন্ধে কিছুই বলবে না ।ছেলে না আসা পর্যন্ত রাস্তার ধারে পড়ে থাকবেন ।একা বা কারো সাথে ফিরবেন না তবে আমি চেষ্টা করব যেন আমার কাছে থাকেন।

অরুণ স্যার : হ্যাঁ অভি তোমার কাছেই রাখো । উনার যা খরচ পাতি তা আমি তোমাকে দেব। তুমি নিজেও জানো না কি অমূল্য রতন পেয়েছ। উনার মত সৎ মানুষ আমি জীবনে আর দ্বিতীয় দেখি নাই । কখনো কারো কাছে এক পয়সাও ঘুসি নেন নাই। বরং তার নিজের রোজগার করা টাকা কোর্টে আশা দরিদ্র মানুষগুলো পিছনে খরচ করতেন।

(অনুসার একটু নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন)

শুধু কি তাই যখন তখন গরীব দুঃখী মানুষদের কাছে গিয়ে সাহায্য করতেন। সত্যি বলতে এরকম কাজ আমিও করতে চাই অন্তত মরার পর কেউ তো আমাকে মনে রাখুক। তুমি তো মনে হয় উনার নামও জানো না। উনার নাম অয়ন হোসেন। কি মিষ্টি নাম । এখানে যত দিন-মজুরি আসতেন সকলে উনার কাছে আসতেন সাহায্যের জন্য।

একদিন মজা করে বলেছিলাম অবসর নেওয়ার পর ভক্তদের কি হবে স্যার?

অয়ন স্যার বলেন, আমি নাইবা থাকলাম, আপনি তো থাকবেন । না হয় এ কাজটি আপনি সামলাবেন। একবার কাউকে সাহায্য করে দেখুন কি যে শান্তি পাবেন যা সবকিছু থেকে আলাদা।

সত্যি মাঝে মাঝে সাহায্য করি যে খুব শান্তি পাই।

অভি : (স্যারের নিরবতা দেখে প্রশ্ন করে)আচ্ছা স্যার উনার ছেলের নাম কি ?গন্ডগোল হয় কি কারনে?

অরুণ স্যার : ওনার একমাত্র ছেলে সাদ। সাদ যে কোন কাজ করতে গেলে আগে পারিশ্রমিকের হিসাব করে। টাকা কম যদি মনে হয় গরীব দুঃখী তা চিন্তা করে না ।চেম্বার থেকে বের করে দিত পিছুপা হয় না।

অয়ন স্যার শত বুঝিয়ে কোন কাজ হয় নাই। তাই মাঝে মধ্যে ঝগড়াঝাটিও করতেন। তিনি মনে করেন তার ছেলে ও তার মতই হবে। আদর্শবান হবে, সৎ পথে চলবে। স্যার তার বাবাকে একদিন বলে, লোকেরা আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসে কিন্তু আমার মধ্যে তোমাকে খোঁজে ।তোমার মত কম পয়সায় বাঁচা সম্ভব নয়। সারা জীবন গাদার মতো খাটলে তবে কতটা জমিয়েছো?

যা জমিয়েছিলে সবটাই মার অসুস্থতার পিছনে খরচ হয়ে গেছে। এখন যা পেনসিয়ান পাও তা তো তোমার ঔষধ এর পেছনেই চলে যায় ।এরকম অশান্তি প্রায় চলতো ।তবে যেটা শুনেছি যে সাদা থানায় গিয়েছিল বাবা কোথায় জানি চলে গেছে এটা অভিযোগ জানাতে।

অভি : সাদ ভাইয়ার স্ত্রী কখনো আপত্তি করেনি এ বিষয়ে? উনিতো স্বামীকে বোঝাতে পারতেন যে ওর বাবার আদর্শকে ছেলে হিসেবে মেনে নেওয়া কর্তব্য। আপনাকে উনিও তার মতই।

অরুণ স্যার: ওটা আমার বোন। তাই ওদের ভিতরে খবর আমি জানতে পারি। আমার বোন হলে কি হবে ? ও ও তার মতোই।

অভি : ক্ষমা করবেন স্যার ।না জেনে বলে ফেলেছি।

অরুণ স্যার: না না ,কোন সমস্যা নেই। সত্যি শোনার অভ্যাস আমার আছে । শোনো তোমার সাথে যে এত কথা হয়েছে তা তুমি একবারে বলবে না কেমন।

অভি : আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না। টাকা নেই পয়সা নেই শিক্ষা নেই খুব শান্তিতে আছি। চলি স্যার আশা করি আপনি আমার কথা একটু মাথায় রাখবেন।

অভি সাইকেল চালিয়ে ফিরে আসে । আসার পথে স্ত্রীকে কল করে সব কথা জানায়। এবং আসার পথে বৃদ্ধ অয়নের আসল পরিচয় জানতে পেরে খুব দুঃখ পেল। যারা রাস্তা ভরে কাঁদতে কাঁদতে আসলো। বাবা-মা বুড়ো হয়ে গেলে কেন ছেলে মেয়েরা তাড়িয়ে দেয় । বা মিথ্যা বলে রাতের অন্ধকারে ফেলে দেয় কোন পথের ধারে।

এসব ভাবতে ভাবতে অভি দোকানে কাছে প্রায় চলে আসে। তখনই মনে হয় যে আজ মনে হয় দোকান টা বন্ধই রাখতে হবে। কিন্তু দূর থেকে দেখে আজ অন্যদিনের তুলনায় আজ দোকানে ভিড় বেশি । বৃদ্ধ অয়ন দোকান সামলিয়েছে আছ। অভির বউ ভাত নিয়ে আসছে। অভি দোকানে ঢুকেই বলে;

অভি : বাবা তুমি ভাত খেয়েছ?

বৃদ্ধ অয়ন: একটু চুপ করে থেকে বলেন, ছেলে না খেয়ে আছে বুড়ো বাপ খায় কি করে?

একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। মনে পড়লো তার ছেলের ব্যবহারের কথা।

অভির বইয়ের নাম মানিয়া। সবাই ওকে মানি বলে ডাকে। অভির আপন বলতে কেউ নেই ।ছোটবেলায় অভির বাবা-মা মারা যান ।কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। ছোটবেলাতেই অভি ঢাকা থাকে ।ওদের দেশের বাড়ি কোথায় তাও জানে না। তাই ছোটবেলা থেকেই এই ঢাকা শহরেই বেড়ে ওঠা ।মানিয়ার সাথে পরিচয় হবার পর অভির বন্ধুরা মিলে অভি আর মানিয়ার বিয়ে দেয়। তবে তাদের কোন বাচ্চা নেই। অয়ন কাকুকে পেয়ে অভি মানিয়া ভীষণ খুশি। দুপুরে সবাই একসাথে খাবার খেলো। ভাত আর ডাল অভির খুব খারাপ লাগলো ডাল দিয়ে ভাত খাওয়াতে ।তবে বৃদ্ধ অয়নের খাবার খেতে কোন অসুবিধা হলো না।

বৃদ্ধ অয়ন: খাবার টা আজ খুব ভালো ছিল।

অভি : লজ্জা দিবেন না কাকু। আপনারা হয়তো অনেক ভালো ভালো খাবার খান আমি গরিব মানুষ তাই এর চেয়ে বেশি যোগাড় করতে পারি না।

বৃদ্ধ অয়ন: শরীর খারাপ হবে বলে ছেলের বউ কখনো সুস্বাদু খাবার খেতে দিত না। তার উপর মানসিক যন্ত্রণা । মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হলে ছেলের বউ এর মুখ জামটা শুনতে হতো। ছেলে একদিন শহরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে আসলো ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরা আর হলো না।

অভি : আমার বাবা মা কেউ নেই। বাবা-মার মুখটাও মনে নেই। তবে এতদিন পর আপনাকে দেখেছি। আমি আপনাকে বাবা বলি আপনার কোন অসুবিধা নেই তো বাবা?

বৃদ্ধ অয়ন: না না বোকা ছেলে এতে বাবার কি সুবিধা হবে?

মানিয়া: ধন্যবাদ বাবা।

বৃদ্ধ অয়ন: বাবাকে ধন্যবাদ দিতে নেই।

বৃত্ত অয়নকে পেয়ে সবাই খুশি। এখন সবাই এখানে বাবা বাবা বলে ডাকে ।আগে ছেলে দিনের পর দিন বাবা বলা তো দূরের কথা ঘুরে তাকিয়ে দেখত না পর্যন্ত । এখন খুব খুশি তবুও মনের কোণে এখনো ধূ ধূ করে । বৃদ্ধ বাবা যা খেতে পছন্দ করে মাদিয়া সাধ্যমত রান্না করার চেষ্টা করে।

একদিন চায়ের দোকানে এক ভদ্রলোক অভি কে জিজ্ঞাসা করেন।

কিরে অভি, তোর দোকানে যে গন্ডগোল ছিল তার সমাধান কি করে হলো?

অভি : আমি কিছু করিনি যা করার আমার বাবা করেছে।

তখন ওই ভদ্রলোক তার সমস্যা অভির বাবাকে বলেন।

সব কথা শুনে বৃদ্ধ অয়ন কিছু বুদ্ধি দেন। আর বলেন এভাবে চললে কাজ হবে এরপর তার সমস্যা খুব সুন্দরভাবে শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে যার যে সমস্যা হয় যে যেভাবে চাইতেন সেভাবেই সাহায্য করতেন। এইভাবে তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সকলে ওদের বাবা বলে ডাকতো। আর এই সাহায্য করার ফলে যে যা পারতো তাই দিত। এভাবেই কিছুদিনের মধ্যে কিছু টাকা হল। চায়ের দোকানটা একটু বড় করে তুললো। এখন চায়ের পাশাপাশি ভাতও বিক্রি করা শুরু করল। এখন অনেকটা ভালো হয়েছে। বৃদ্ধ অয়ন হাসিখুশিতে দিন কাটায়।

চায়ের দোকানটা একটু বড় করে চায়ের পাশাপাশি ভাতও বিক্রি করা শুরু করে। ছেলে বৌমার সংসারের বোঝা হয়নি।

এইভাবে বেশ কয়েক মাস কেটে গেল ।সারাদিন দোকান আর এত মানুষের মধ্যে ব্যস্ত থাকেন ।যে কোন কিছুর চিন্তা করার সময় পায় না।

কিন্তু সন্ধ্যার পর লোকের আনাগোনা কম হলেই বারবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এটা অভি খেয়াল করে তবে বাবাকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না ।তবে তারও খুব খারাপ লাগে বাবার জন্য।

অভি : বাবা চলো বাসায় যাই ।

বাবা : না বাবা তুমি যাও । যদি খোকা আসে।

অভি : ও আসবে না আর। (অভি মনে মনে ভাবে আমি এত ভালবাসি তাও ওর অপেক্ষায় আছে । বাপ তো কিবা করবে এমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো)

বাবা : আচ্ছা অভি, খোকা কি আসবেনা? কবে আসবে খোকা?

অভি : আসবে। ঠিক আসবে দেখো । আমি গেলাম তুমি শুয়ে পড়ো।

বাবা : আচ্ছা।

অভি একদিন সকালে বলে আজ দোকান বন্ধ থাকবে আজ আমরা ঘুরতে যাব।

বাবা : দোকান কেন বন্ধ থাকবে ?আমি আছি না , তোমরা ঘুরে আসো ।আমি দোকান সামলাতে পারবো।

অভি অয়ন স্যারের কাছে ঠিকানা নিয়ে সাদের বাড়ি যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পায় না। সব বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে । কোথায় গেছে তা কেউ জানে না। মন খারাপ করে অভি ফিরে আসলো।

বাবা : অভি, বাবা সারাদিন কোথায় ছিলে? খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে যাও বাড়ি চলে যাও খেয়ে বিশ্রাম নাও। (একটু থেমে আবার বলে) একটা কথা বলবো খোকা?

অভি চমকে গিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। আজ প্রথম তাকে কেউ খোকা বলে ডেকেছে।

অভি : হ্যাঁ, বলো না, কি বলবে বাবা?

বাবা : আমার খোকা বৌমা কেমন আছে?

অভি : তুমি কি করে জানো ?আমি ওখানে গিয়েছি?

বাবা : বাপ ছেলে কে চিনবে না বুঝি?

অভি : বাবা তুমি শুনলে কষ্ট পাবে।

বাবা : আমার কষ্ট লাগে না বল তুই।

অভি : বাবা উনারা আর ওখানে থাকে না। সব বিক্রি করে দিয়ে চলে গেছে । আশেপাশে কেউ জানে না কোথায় গেছে?

অয়ন হোসেন বুঝতে পারলেন ছেলে আর বাবাকে চায়না। তাই মৃত্যুর আগেই মেরে ফেললো। এভাবেই একদিন দুদিন করে দিনের পর দিন কাঁটতে লাগলো । এভাবে মিলেমিশে সুখে-দুখে যাচ্ছে দিনগুলো।

অয়ন হোসেন এখন দোকানের পাশাপাশি কিছু কাজ করে। লোকদের অনেক ভাবে সাহায্য করে যার ফলে ভালই ইনকাম হয়। মাসে অনেক টাকায় হয়ে যায়। আর এইদিয়ে দোকানটা ভালোই কাটতে লাগলো ।তাদের দিনগুলো ভালই কাটতে লাগলো। আজও যেদিনও ভালো কাটতে লাগলো বাবাকে পেয়ে। আর খোকার পথ চেয়ে বাবা দিনের পর দিন খোকার অপেক্ষাতে রয়ে গেল।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়