শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৫ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৯ জুন ২০২১, ০৯:৫৯

প্রযুক্তিগত বৈষম্য ও শিক্ষা বাজেট

ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার
প্রযুক্তিগত বৈষম্য ও শিক্ষা বাজেট

প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বারে বারে নানা উদ্যোগ নিয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো খোলা সম্ভব হয়নি। ছুটি আরও বেড়েছে। স্থগিত হয়ে আছে এসএসসি, এইচএসসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষাগুলো। বলা চলে সার্বিকভাবে শিক্ষাব্যবস্থা মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ৫০ বছরেও শিক্ষাক্ষেত্রে এতো বড় বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি দেশ। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে শিক্ষার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যে ইতিমধ্যে চলমান অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি এখন অনলাইনে পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু অনলাইনে ক্লাস এবং পরীক্ষা পরিচালনা করার জন্যে প্রথমেই দরকার দ্রুতগতির ইন্টারনেট। যা শহরাঞ্চলে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নেই। শহরাঞ্চলে ৫০০-৬০০ টাকার বিনিময়ে ব্রডব্যান্ড লাইনের কানেকশন নিয়ে আনলিমিটেড টাইম এবং আনলিমিটেড ডাটা অ্যাক্সেস করা যায়। শহরের একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে ৫০০ টাকা খরচ করার মতো সাধ্য হয়তো আছে এবং সে খুব সহজেই অনলাইন ক্লাসে এবং পরীক্ষায় যুক্ত হতে পারে। কেননা শহরাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীরই সম্ভবত ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের মতো প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস আছে। কিন্তু গ্রাম কিংবা দ্বীপাঞ্চলে এখনো ব্রডব্যান্ড কানেকশন নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের মোবাইল ডাটার ওপর নির্ভর করতে হয় যা খুবই ব্যয়বহুল। আবার গ্রামাঞ্চলের সব শিক্ষার্থীরও ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনের মতো প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস নেই। যাদের ডিভাইস আছে তারাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য মোবাইল ডাটা ক্রয় করে থাকে। যা খুবই অল্প সময়ের জন্যে বা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা অনেক সময় মুক্ত আকাশের নিচে, গাছের ওপর বসে কিংবা দূরবর্তী কোনো টাওয়ারের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাজটি সেরে থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এক ঘণ্টার একটি ভিডিও ক্লাসের জন্য প্রায় ৭০০-১০০০ মেগাবাইট ডাটা প্রয়োজন হয় যা একজন সাধারণ ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই ব্যয়বহুল। ফলে আর্থিক সংকটে থাকা গ্রামের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছে না। সরকার গত এক বছর যাবৎ অনলাইনে ক্লাস পরিচালনায় নানা উদ্যোগ নিলেও আর্থিক সংকট ও প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্মের অভাবে ৬৯.৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে তা পৌঁছেনি। তবুও অনলাইন ক্লাসের বিকল্প কিছু নেই এই মুহূর্তে। কারণ সব শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা নাও হতে পারে।

দেশে বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তরে চার কোটি পাঁচ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া সাড়ে তিন লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে কতজন শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন দরকার বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে সে তথ্যও আছে।

বিটিআরসির হিসাবে দেশে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ১৬ কোটি ১৫ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা ১০ কোটি ২১ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে ৯ কোটি ৪০ লাখেরও বেশি মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আইএসপিএবি’র হিসাবে দেশে বর্তমানে ৮০ লাখের বেশি ব্রডব্যান্ড সংযোগ রয়েছে । অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) এক জরিপে দেখা গেছে যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তারা এতটাই দরিদ্র যে প্রাইভেট টিউশনি বা অন্য কোনো কাজ (আউটসোর্সিং) করে তাদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে থাকে। অনেকে তাদের দরিদ্র পিতা-মাতাকেও সাহায্য করে থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তারা এখন দরিদ্র পিতা-মাতার বোঝা হয়ে গ্রামেই আছে, যেখানে নেই কোনো কাজকর্ম, নেই কোনো আয়-রোজগার। উপরন্তু করোনার কারণে অনেক অভিভাবক চাকরি হারিয়েছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি থাকলেও অনেকের বেতন কমেছে, গ্রামে ফিরে গেছেন অনেকে, পুঁজি হারিয়েছেন অনেক ব্যবসায়ী অভিভাবক। ফলে অভিভাবকরাও সাংঘাতিক আর্থিক কষ্টে আছেন। এমতাবস্থায় শিক্ষার্থী তো বটেই, তাদের অভিভাবকদের কাছেও ইন্টারনেট, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন না থাকায় সবাইকে অনলাইন ক্লাসে আনা যাচ্ছে না।

তাই অনলাইন ক্লাসের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষা শুরু করার আগে প্রথমেই নজর দিতে হবে গ্রামাঞ্চলের ইন্টারনেট অবকাঠামোর দিকে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের হাতে সহজে ইন্টারনেট সংযোগ কিংবা স্বল্পমূল্যে মোবাইল ডাটার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকায় তাদের টিউশনি কিংবা অন্যান্য সোর্স থেকে আয় করার সুযোগও বন্ধ আছে। এমতাবস্থায় করোনাকালে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন প্রণোদনার অংশ হিসেবে এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের উপবৃত্তির আদলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের করোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মাসিক হারে বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিনা সুদে এবং সম্ভব হলে অফেরতযোগ্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান দেওয়া যেতে পারে। এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া সব শিক্ষার্থী যাতে ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন কিনতে পারে।

বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন নেই তাদের সবার জন্য এমন ডিজিটাল ডিভাইস নিশ্চিত করতে আসলে কত টাকা প্রয়োজন? এজন্য প্রয়োজনীয় টাকার অঙ্কটা কি এতই বেশি যে, আমরা সেটা নিশ্চিত করার জন্য কোনো উদ্যোগ নিতে পারি না? এমনটা নিশ্চিত করা গেলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা, ফলে দূর হবে শহর ও গ্রামের মধ্যকার ‘ডিজিটাইল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তির বৈষম্য। শহর ও গ্রামের মধ্যে বিত্তবান ও দরিদ্র শিক্ষার্থীর মধ্যে এই প্রাযুক্তিক বৈষম্য দূর করার জন্য সরকার আসন্ন বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে পারে। সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভব না হলে আরও অর্থ জোগানের জন্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাংক মালিক, সমাজের বিত্তশালী এবং দাতাগোষ্ঠীর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।

করোনাকালে শিক্ষাক্ষেত্রে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং এই সমস্যাটির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে গরিব শিক্ষার্থীদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটি জাতীয় তহবিল গঠনেরও উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেখানে চাকরিজীবী, কর্মজীবী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী ও সামর্থ্যবান সবার কাছ থেকে ১০০ টাকা, ৫০০ টাকা, ১০০০ টাকা করে অনুদান নেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এগিয়ে আসতে পারে এই মহৎ কাজে। উদ্যোগ নিতে পারে সামর্থ্যবান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অ্যালামনাই সংগঠনগুলোও। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য এমন একটি মহৎ উদ্যোগ নেওয়া হলে সেখানে সমাজের সব স্তরের মানুষই স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়।

২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশন বসছে আগামী ৩ জুন। এদিকে করোনার সর্বগ্রাসী থাবা বেড়েই চলছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। ইন্ডিয়া ও আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত, আতঙ্কিত আমজনতা। কাজেই গত বছরের মতো এ বছরও বাজেটে চিকিৎসা খাতে বিশেষ নজর দেওয়া হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে এমন নজিরবিহীন অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য গ্রাম-শহর, হাওর, পাহাড় ও বিচ্ছিন্ন এলাকাসহ সব শিক্ষার্থী যাতে সমহারে ইন্টারনেট এক্সেস, মোবাইল ডেটা এবং ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন কেনার একটি সুযোগ পায় সেজন্য আসন্ন শিক্ষা বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।

লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, অধ্যাপক ও পরিচালক, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়