বুধবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৩ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কুমিল্লা সীমান্তে পুকুরে দেয়াল নির্মাণ করছে বিএসএফ, সতর্ক অবস্থানে বিজিবি
  •   টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের দাবির মধ্যে নতুন বিতর্ক
  •   স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে হাজীগঞ্জ রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের শীতকালীন ত্রাণসেবা
  •   খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য স্থিতিশীল, করা হবে বিশেষ কিছু পরীক্ষা
  •   সীমান্তে অস্থিরতা: পাগল বেশে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ কারা?

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৮

ঘুরে এলাম সম্ভাবনার চর ইয়ুথনেট

মোহাইমিনুল ইসলাম জিপাত
ঘুরে এলাম সম্ভাবনার চর ইয়ুথনেট

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের এ বাংলাদেশ। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শত শত নদ-নদীর কারণে একে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়। আর এ নদ-নদীগুলোর বুক চিরে জেগে ওঠা চরগুলো যেন বাংলাদেশের ভূগোল ও সংস্কৃতি আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। হাজারো চরের মাঝে এক বিশেষ চরের নাম ‘চর ইয়ুথনেট’।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে জেগে ওঠা এ চরটি প্রকৃতির বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। সম্প্রতি চর ইয়ুথনেট ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি, যেখানে চরের মানুষের জীবনযাপন, সংগ্রাম এবং নানা প্রতিকূলতা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়।

চর ইয়ুথনেট নামকরণের পেছনে রয়েছে এক অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প। চরের মানুষের নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, নদীভাঙন এবং নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই এখানকার মানুষের জীবনের অংশ। এমনই এক সংকটময় সময়ে জলবায়ু সুবিচার এবং পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস’-এর একদল যুবক চরের বানভাসী মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের মানবিক কাজ এবং অবদান চরের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়।

স্থানীয়দের ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতার প্রতীক হিসেবে চরের মানুষ এ জায়গাটির নামকরণ করেন ‘চর ইয়ুথনেট’।

আমাদের যাত্রা হয় ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের উদ্দেশে। ২৪ ডিসেম্বর রাত ১০টায় রওনা দিয়ে আমরা ভোরের আলো ফোটার আগেই সকাল সাড়ে ৬টায় কুড়িগ্রামে পৌঁছাই। যাত্রাপথের ক্লান্তি ম্লান হয়ে যায় কুড়িগ্রামের নির্মল পরিবেশে। আমাদের ভ্রমণ প্রথম দিনটিতে আমরা কুড়িগ্রাম শহর এবং আশপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার মাধ্যমে শুরু করি।

পরদিন ২৫ ডিসেম্বর খুব ভোরে কনকনে শীতের আমেজে আমরা বেরিয়ে পড়ি যাত্রাপুর বাজারের উদ্দেশে। বাজার থেকে ঘাটে যেতে হয় পায়ে হেঁটে কিংবা ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়িতে। এরপর আমরা পৌঁছাই যাত্রাপুর ঘাটে। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চেপে শুরু হয় আমাদের চর ইয়ুথনেটের উদ্দেশে যাত্রা। ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ভেসে চলা সেই ৩০ মিনিটের নৌকা ভ্রমণ যেন নতুন এক অভিজ্ঞতা। অবশেষে আমরা পৌঁছে যাই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য চর ইয়ুথনেটে। চরে পৌঁছানোর পরই আমাদের শস্য ফুল দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এখানকার সহজসরল মানুষজন। তাদের সাদামাটা অথচ আন্তরিক জীবনযাপন আমাদের মুগ্ধ করে। চরের পরিবেশে প্রথম নজর কাড়ে বিস্তৃত খোলা মাঠ।

চরের শিশুরা আমাদের ঘিরে আনন্দে মেতে ওঠে। তাদের খুশির উচ্ছ্বাস মুহূর্তটি আরও আনন্দঘন করে তোলে। তবে চরের সৌন্দর্যের মাঝে রয়েছে এক ভিন্ন বাস্তবতা। চরে নামার পর থেকেই চোখে পড়ে এখানকার মানুষের জীবনযাপনের প্রতিকূলতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে তারা গড়ে তুলেছেন তাদের জীবন। এখানকার মানুষের মূল জীবিকা কৃষি এবং মাছ শিকার। কেউ কেউ জীবিকার প্রয়োজনে শহরে গিয়ে কাজ করেন। এ ছাড়া অনেকে আবার নৌকা চালিয়েও জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু বর্ষাকালে তাদের কোনো আয়ের পথ থাকে না। চরের মাঠে-ঘাটে কাজ করতে দেখা যায় নারী-পুরুষ উভয়কেই। তাদের একসঙ্গে কাজ করার এ দৃশ্য কঠোর পরিশ্রম এবং পারস্পরিক সহযোগিতার উদাহরণ দেয়। চরে ইয়ুথনেটে ঘুরতে গিয়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চোখে পড়ল, যা পরিচালনা করে ফ্রেন্ডশিপ নামক একটি এনজিও। বিদ্যালয়টির কাজ প্রশংসনীয় হলেও, এখানে পড়াশোনার ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু সীমাবদ্ধতা। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি চার বছর পরপর এ স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। আশপাশে আর কোনো স্কুল না থাকায় পাশের চর থেকেও অনেক শিশু এখানে পড়তে আসে।

চরের শিশুদের মধ্যে শেখার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এ আগ্রহ পূরণের পথে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। চরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, প্রয়োজনীয় শিক্ষাসামগ্রীর সংকট এবং পর্যাপ্ত সুযোগসুবিধা না থাকায় শিশুদের পড়াশোনায় নিয়মিত হতে বেশ বেগ পেতে হয়। চরের শিশুরা সেখানে একটি উচ্চবিদ্যালয় চায়, যেখান থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। চরের মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো সঠিক সময়ে চিকিৎসাসেবা না পাওয়া। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে যেতে হয় কুড়িগ্রাম জেলা শহরে। তবে সেখানে পৌঁছানোই যেন এক বড় চ্যালেঞ্জ।

রোগীকে হাসপাতালে নিতে পথে প্রায়ই নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় নৌকা পাওয়া যায় না, আবার কখনও নৌকা পেলেও সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এ চিকিৎসার বিষয়ে চরের এক বাসিন্দা ফরিদা বেগমের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘চরে চিকিৎসার তেমন সুবিধা না থাকায় গর্ভবতী নারী ও শিশুদের নিয়ে সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়।’

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও চরের মানুষ তাদের অদম্য মনোবল আর দৃঢ়তা নিয়ে টিকে আছে। এ দুর্যোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিধ্বংসী হলো বন্যা। বন্যার সময় চরের মানুষের জীবন হয়ে ওঠে অসহনীয় এবং কষ্টকর। হাজারো কষ্ট এবং দুঃখের মাঝেও চরের মানুষ জীবিকার তাগিদে করে যাচ্ছে অক্লান্ত পরিশ্রম। চরের মাটিতে লুকিয়ে থাকা উর্বরতার সাক্ষী হতে চাইলে একবার সেখানে যেতে হবে। চরে গেলে আপনার চোখে পড়বে নানা ধরনের তাজা শাকসবজি। প্রতিটি ক্ষেত যেন প্রাণবন্ত এবং কর্মঠ মানুষের ঘামের ফসল। চরের মানুষ তাদের পরিশ্রম আর উদ্ভাবনী দক্ষতায় প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মাঝেও নিজেদের জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে নিচ্ছে। এ দৃশ্য যেন প্রতিটি দর্শনার্থীর মনে অনন্য অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তোলে। চরের মানুষ হাজারো প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও আতিথেয়তা ও আপ্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো কমতি রাখে না। এক বিশেষ আপা, শাহিনা আক্তার, যিনি আমাদের জন্য চরে খাবার রান্না করেছিলেন।

ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে প্রতিনিয়ত কাজ করছে। তারা চরের মানুষের জন্য নানা রকম প্রশিক্ষণের আয়োজন করে এবং মানুষ যাতে স্বাবলম্বী হতে পারে এমন নানা উপকরণ সরবরাহ করছে। কুড়িগ্রাম জেলার ৪২০টির অধিক চরে ৬ লাখের অধিক লোক বাস করে। চরের জীবন সংগ্রামের হলেও এ সংগ্রামের সঙ্গেই সেখানকার মানুষ গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে। তাদের চাহিদা বেশি কিছু নয়। তারা চায় একটি বিদ্যালয় যেখানে তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করবে, চায় একটি কমিউনিটি ক্লিনিক যেখান থেকে তারা চিকিৎসা নেবে। চর তাদের জন্য শুধু একটি স্থান নয়, বরং এটি তাদের জীবনের অংশ, যেখানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশে আছে এবং এখানেই তারা প্রকৃত প্রশান্তি অনুভব করে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়