বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   কচুয়ায় ওসির অপসারণের দাবিতে সড়ক অবরোধ
  •   ভারত-মিয়ানমার থেকে ৮৯৮ কোটি টাকার চাল কিনবে সরকার
  •   মেয়াদোত্তীর্ণ বীজ ও কীটনাশক পাওয়ায় দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
  •   মশার উপদ্রবে চাঁদপুর পৌরবাসী ॥ বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী
  •   শাহরাস্তিতে সিএনজি অটোরিকশা মালিক ও চালকদের সাথে পুলিশের মতবিনিময়

প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫১

শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার দায় ও দাওয়াই

মাহফুজুর রহমান মানিক
শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার দায় ও দাওয়াই

রাজধানীতে অবস্থিত কয়েকটি প্রতিবেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ আমরা দেখেছি। গত ২০ নভেম্বর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের মধ্যকার সংঘর্ষের পর উভয় কলেজ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। এর পর রোববার ও সোমবার পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

সেখানে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের নাম উচ্চারিত হলেও অন্তত ৩৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংঘর্ষে জড়ায়। কলেজগুলোতে ব্যাপক ভাঙচুর হয়। এমনকি তিনজনের মৃত্যুর গুজবও ওঠে। অবশ্য কেউ নিহত না হলেও গুরুতর আহত অনেককে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ ঘটনায় কবি নজরুল সরকারি কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ নির্দিষ্ট সময়ের বন্ধ ঘোষণা করা হলেও তাদের প্রতিবেশী সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল ও কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ ক্যাম্পাসে হামলায় অবকাঠামো ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় ইতোমধ্যে সাত কলেজের দুটো পরীক্ষা স্থগিত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কিছু একটা ঘটলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রবণতা নতুন নয়। এর আগে বিশেষত রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শিক্ষাঙ্গন বন্ধ করা হতো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণেও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়, যেমন গত মাসের ২৮ অক্টোবর ঢাকা সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ মোট ৭ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে ওই দিন রাতেই কলেজটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০ দিন পর ১৯ নভেম্বর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় ঢাকা সিটি কলেজে। যদিও খোলার পরদিনই ২০ নভেম্বর কলেজটির শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়; পুনরায় কলেজটি বন্ধ হয়ে যায় এবং ২৬ নভেম্বর থেকে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়।

এদিকে ২৭ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণা করা হয় বরিশাল সরকারি ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি)। মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়ে বুধবার দুপুরের মধ্যে আবাসিক শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস-ছাত্রীনিবাস ত্যাগ করার নির্দেশ দেয় প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ। সেখানে একদিকে শিক্ষার্থীদের ছয় দফার আন্দোলন, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষে সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই আইএইচটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এভাবে আন্দোলন ও সংঘাতে শিক্ষা কার্যক্রমের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এমনিতেই জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান ঘিরে অন্তত এক মাস আনুষ্ঠানিক বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন সরকার। গত ১৮ আগস্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও পূর্ণ মাত্রায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় তারও পরে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপে অনেক প্রতিষ্ঠান-প্রধানের পদত্যাগের হিড়িক পড়ে।

গণঅভ্যুত্থানের পর পুরোদমে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর পুনরায় অস্থিরতা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়া ভালো লক্ষণ নয়। এই সময়ে যেভাবে তুচ্ছ কারণে শিক্ষার্থীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে, সেটি দুঃখজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখনই সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়, তখনই শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তবে বর্তমান সময়ে তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে বলে একটি সংবাদমাধ্যমে এসেছে যৌক্তিকভাবেই।

প্রথমত, জুলাই অভ্যুত্থানের ট্রমা থেকে শিক্ষার্থীরা বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। যে কোনো ঘটনায় কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ না হয়ে নিজেরাই ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার চেষ্টা করছে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানি কিংবা তাতে ঢুকে পড়া। অন্তত পুরান ঢাকার কলেজগুলোর সংঘর্ষে তার কিছু আলামত স্পষ্ট। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের খোদ শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, তাদের আন্দোলনের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের উস্কানি ও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। কলেজগুলোতে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়; যেভাবে কলেজের ভেতর থেকে সম্পদ লোপাট করা হয়, তা সত্যিই শিক্ষার্থীদের কাজ কিনাÑএ নিয়ে সন্দেহ আছে।

তৃতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রতিষ্ঠান-প্রধানদের গাফিলতির বিষয়ও অস্বীকার করা যাবে না। পুরান ঢাকার কলেজগুলোয় কীভাবে ‘সুপার সানডে’ বা ‘মেগা মানডে’র মতো সংঘাতমূলক কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীরা এত বড় সংঘর্ষ বাধাল? পূর্বঘোষণার পরও কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কিংবা শিক্ষকরাই বা কেন তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে বা পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন?

গত সপ্তাহে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের সংঘাতের পর সমকালে লিখেছি, ‘ভালো কাজের পথপ্রদর্শক হিসেবে শিক্ষকরাই প্রধান ভূমিকা পালন করবেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি বিবেচনা করি, এই সময়ে শিক্ষাঙ্গন শিক্ষা প্রশাসনই নিয়ন্ত্রণ করছে; যেহেতু লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নেই।’ (২৩ নভেম্বর, সমকাল)। তাই শিক্ষকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে প্রতিবেশী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঐক্য সহজেই সৃষ্টি করতে পারেন। শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রবণতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

আমরা দেখেছি, সংঘাত-অস্থিরতার বাইরেও কভিডের সময় অযৌক্তিকভাবে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যখন শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে গড়ার সময়, তখন ভুলের পুনরাবৃত্তি ও ঠুনকো কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা অগ্রহণযোগ্য। শিক্ষার্থীদেরও এ ক্ষেত্রে করণীয় রয়েছে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হলে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জন্য তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হওয়া কিংবা তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে পা দেওয়া যাবে না। কোনো বিষয়ে বিক্ষুব্ধ হলে প্রশাসনের মাধ্যমেই তার সমাধানের চেষ্টা করা আশু কর্তব্য। তা ছাড়া প্রতিবেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও ঐক্য থাকা দরকার। শিক্ষার্থীদের ঐক্য কতটা জরুরি ও কার্যকরÑ৫ আগস্টই তার প্রমাণ।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়