প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৩
ঝরনার ধারে ধলাটুপি
পাখিটির চাঁদি সাদা। দেখলে মনে হয় মাথায় সাদা টুপি পরে আছে। এ জন্য পাখিটির বাংলা নামের আগে ধলাটুপি বসানো হয়েছে। পুরো নাম ধলাটুপি- পানগির্দি। আর এ পাখি দেখার জন্য ডিসেম্বরের একদিন খুব সকালে হাজির হই পরিকুণ্ড ঝরনার তলদেশে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের গহিন বনে এ ঝরনার অবস্থান। সঙ্গে আরও আছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের দুই সদস্য শফিক ভাই ও ফেরদৌস ভাই।
পাখিটির সম্ভাব্য থাকার জায়গায় ঝিরির পাশে আমরা বসি। ঝরনায় পানি কম। তবুও নির্জন বনে ঝরনার ধারে সময়টা অন্য রকমই বটে। অনেকক্ষণ বসার পরও পাখিটির দেখা নেই। তবে চমক হিসেবে অন্য একটি পাখি দেখি, নাম- লম্বাঠোঁট- দামা। চমকই বটে। কারণ, এটা আমাদের দেশের অনিয়মিত পাখি। ফলে একে দেখা যায় না বললেই চলে। অবশ্য আমরা একনজরই দেখি। তাই ছবিও তোলা হয়নি।
আকারে কবুতরের চেয়ে কিছুটা ছোট এ পাখির ঠোঁট লম্বা। সে জন্য এর বাংলা নামের আগে লম্বাঠোঁট বসানো হয়েছে। ইংরেজিতে লং-বিল থ্রাশ। ভূচর এ পাখির শরীর অনেকটা বাদামি। পিঠের দিক স্লেট-বাদামি। শরীরের নিচের দিকে জলপাই-বাদামি থেকে কালচে-সাদা। কান-ঢাকনি ও গালে ফিকে ডোরা। গলার পাশ, বুক ও বগল কালচে বাদামি এবং তিলাসহ গলা সাদাটে। ওড়ার সময় এর ডানার নিচের সাদা পট্টি দেখা যায়। চোখ ও ঠোঁট কালচে বাদামি। পা, পায়ের পাতা শিঙ-বাদামি। ছেলে ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম।
পাখিটি চিরসবুজ বনে স্যাঁতসেঁতে গুল্মতলে বিচরণ করে। তবে নদীর কিনার ওর পছন্দ। নিঃসঙ্গ ও লাজুক এ পাখি খুবই সতর্ক থাকে। শীতে একা একাই ঘুরে বেড়ায়। পাতাঝরা বনে ও নদীর তীরে পাতা উল্টিয়ে খাবার খুঁজে খায়। খাবারের তালিকায় আছে পোকা, লার্ভা, শামুকজাতীয় প্রাণী ও রসালো ফল। এরা ভোরে ও সন্ধ্যায় বেশি কর্মচঞ্চল থাকে। মে থেকে জুলাই প্রজননকাল। ঘন বনের মাঝে বা নদীর তীরে গাছের ডালে শেওলা পাতা ও মূলে কাদা মিশিয়ে বাটির মতো করে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ৩ থেকে ৪টি ডিম দেয়। ডিমের রঙ ধূসর-সবুজ।
কিন্তু যে ধলাটুপির জন্য এ গহিন বনে, তার দেখা এখনো পাইনি। তাই আরও অনেকক্ষণ বসে থাকি। না, দেখা হয়নি। এরপর আসি মাধবকুণ্ড ঝরনার সামনে। ভাগ্যক্রমে এখানে এসেই তার দেখা পাই এবং বেশ আয়েশ করেই ছবি তুলি আমরা। পাখিটির ইংরেজি নাম- হোয়াইট ক্যাপড রেডস্টার্ট।
বিরল প্রজাতির পরিযায়ী এ পাখির বসবাস সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের বনাঞ্চলে। তবে খুবই কম দেখা যায়। সে জন্য আমরা ভাগ্যবান বটে একে দেখে। আকারে দোয়েল পাখির সমান এ পাখির শরীর প্রধানত লাল ও কালো। মুখ, গলা, বুক ও ডানা কালো। মাথার চাঁদি সাদা। পেট, পিঠ ও লেজ লাল। লম্বা লেজের শেষপ্রান্তে কালো বর্ডার। চোখ কালচে-বাদামি। ঠোঁট কালো। পা কালচে-বাদামি। ছেলেপাখি ও মেয়েপাখি দেখতে একই রকম।
পাখিটি সাধারণত পর্বতের জলধারা, নদী, খাল, উঁচু পর্বতের তৃণভূমি, শিলাময় অঞ্চল কিংবা আংশিক বরফে ঢাকা অঞ্চলে বিচরণ করে। এরা একা বা জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। পানির ধারা বা উঁচু পর্বতের তৃণভূমিতে খাবার খুঁজে খায়। খাবারের তালিকায় আছে পোকা ও রসালো ফল। হিমালয়ে মার্চ থেকে আগস্টে প্রজননকাল। সাধারণত শিলার নিচে বা শিলামুখের গর্তে শেওলা পাতা, ঘাস, পশম বা চুল দিয়ে বিশাল বাটির মতো বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ লালচে বাদামি তিলাসহ ফিকে-নীল ধূসর। মেয়েপাখি একা ডিমে তা দেয়। ছেলেপাখি ও মেয়েপাখি মিলে ছানা পালে।
ধলাটুপি-পানগির্দি দেখে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ঝরনার সামনে থাকি। সকাল হওয়ায় দর্শনার্থীদের আগমন এখনো শুরু হয়নি। তাই দর্শনার্থী বলতে কেবল আমরাই। বেলা একটু বাড়তে থাকলে দুই-একজন দর্শনার্থী আসতে শুরু করেন। আমরা ঝরনার আশপাশে আরও পাখির খোঁজ করি।
পাখিটি দেখার জন্য আগের দিন রাতে এসে উঠি ইকোপার্কসংলগ্ন জেলা পরিষদের রেস্ট হাউসে। বেশ পুরোনো রেস্ট হাউস। পরিবেশ মোটামুটি। তবে পাশে আরেকটি নতুন ভবন করা হয়েছে। সেটিও বেশ ভালো। রাতে আমরা এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে খাই।
অনিন্দ্য সুন্দর এ ঝরনা দেখতে এর আগেও বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকবার আসি। তবে প্রথম যখন এ ঝরনা দেখতে আসি, তখন এখানে প্রবেশ ফি ছিল না। এরপর এ ঝরনাসংলগ্ন বন-পাহাড় ঘিরে এখানে ইকোপার্ক ঘোষণা করা হয়। প্রবেশ ফি ধরাসহ নানা উন্নয়নও হয়। এখন ইকোপার্কের ভেতরে তৈরি হয়েছে শিশু বিনোদন কর্নার, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পর্যটন করপোরেশনের রেস্টুরেন্ট, ওয়াশ রুম, চেঞ্জিং রুম, বিশ্রামের জন্য বেঞ্চ। এ ছাড়া পার্কের গেটের পাশে গড়ে উঠেছে থাকার হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান। এখন প্রবেশ ফি প্রতিজন ২০ টাকা। ২০০১ সালে ঘোষিত এ ইকোপার্কের আয়তন ২৬৫ দশমিক ৬৮ একর।
পাথারিয়া পাহাড় থেকে এ ঝরনার উৎপত্তি। এটি প্রায় ১৬২ ফুট উঁচু। ঝরনাটির আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে বর্ষার সময়। পাথুরে পাথারিয়া থেকে খাঁড়াভাবে পানি নিচে পড়ে। অবিরাম পানি পড়তে পড়তে নিচে কুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে। এ কুণ্ডের পানি মাধবছড়া দিয়ে বেরিয়ে যায়। কুণ্ডটির গভীরতা অনেক। আগে এ কুণ্ডে গোসল করা যেত। এখন নিষেধ। ঝরনার পাশে একটা সাইনবোর্ডে সতর্কবাণী আছে। এতে লেখা, এ ঝরনার কুণ্ডে বা পানিতে গোসল করতে গিয়ে ১৩ জন মারা গেছেন। এ ছাড়া ঝরনার ওপর থেকে লাফালাফি করতে গিয়ে ১০ জন এবং ঝরনার ওপরে ঘুরতে গিয়ে ২ জন মারা গেছেন। সে জন্য এখন ঝরনার কুণ্ডে গোসল করা নিষেধ।
এক সময় এটাই ছিল দেশের অন্যতম দর্শনীয় ঝরনা বা জলপ্রপাত। এরপর নানা সময়ে দেশের নানাপ্রান্তে আরও অনেক ঝরনার খোঁজ মিলেছে। তবে এ ঝরনার সৌন্দর্য বা এখানে আসা দর্শনার্থীদের সংখ্যা কমেনি। অবশ্য এর অন্যতম কারণ হলো, অন্য অনেক ঝরনা দেখতে হলে বন-পাহাড় ট্রেকিং করে বা অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়। সে তুলনায় এ ঝরনা দেখতে তেমন কষ্ট করতে হয় না। ইকোপার্কের গেট থেকে ঝরনা পর্যন্ত সুন্দর পথ। এ পথ ধরে কয়েক মিনিট হাঁটলেই ঝরনার দেখা মেলে। এ ছাড়া এখানকার পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে ঝরনাসহ এর আশপাশের বন-পাহাড় দেখা যায় পাখির চোখে। অন্যদিকে মাধবকুণ্ডের ঝিরি ধরে ১০ থেকে ১৫ মিনিট হাঁটলেই পরিকুণ্ড ঝরনার দেখা মেলে। এ ছাড়া মাধবকুণ্ড ঝরনার পাশেই আছে শ্রীশ্রী মাধবেশ্বরের তীর্থস্থান। আর পার্কের আশপাশে আছে খাসিয়া নৃগোষ্ঠীর বসবাস এবং চা-বাগান।ঝরনার আশপাশে আরও যেসব পাখি দেখি, এর মধ্যে আছে পাতি-হুদহুদ, দাগি-বসন্ত, পাতি-ফটিকজল, ব্রঞ্জ-ফিঙে, কালা-ফিঙে, উদয়ী-ধলাচোখ, খয়রালেজ-কাঠশালিক, ঝুঁটি-শালিক, খয়রা-হাঁড়িচাচা, ছোট-সাহেলি, বাংলা-বুলবুল, সিপাহি-বুলবুল, কালাঝুঁটি-বুলবুল, গলাফোলা-ছাতারে, দাগি-তিতছাতারে, তাইগা-চুটকি, ধলাভ্রু-চুটকি, কালাঘাড়-রাজন, ধলাকোমর-শামা, পাতি-টুনটুনি, ছোট-মাকরমাড় ও পাতি-শিকরে।
বেশ কিছুক্ষণ পাখির খোঁজ করে পার্ক থেকে বের হয়ে এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে নাশতা খাই। এরপর ঘুরে দেখি এখানকার দোকানগুলো। বিশেষ করে আদিবাসী খাসিয়া ও মনিপুরিদের দোকানগুলোতে তাদের হাতে বোনা শাল, শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় দেখি। কালারফুল এসব কাপড়ের রঙে ও নকশায় আছে আলাদা বৈচিত্র্য। এরপর এক কাপ রঙ-চা খেয়ে রওনা হই হাকালুকি হাওড়ের উদ্দেশে।
হাকালুকি হাওরে এর আগে একাধিকবার আসি পাখিবিশারদ ইনাম আল হকের সঙ্গে জলচর পাখিশুমারি করতে। প্রতিবারই আসি শীতে ফেব্রুয়ারিতে। তখন এ হাওড় অসংখ্য প্রজাতির অসংখ্য জলচর পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও হাকালুকি একাধিকবার ঘুরতে আসি এখানকার বন্ধু আবুল কাসেম, নাজমুল হাসান (সাজেদ), ফুজায়েল, ইকবালের আমন্ত্রণে। শীতের আগমুহূর্তে এখানে পাখি কেমন আছে তা দেখার জন্য। আমরা হাকালুকি হাওড়ের জিরো পয়েন্টে আসি বেলা আড়াইটার দিকে। ফাঁকা বিলের জলাশয়ে তেমন কোনো পাখি নেই, কেবল কয়েক প্রজাতির বক আর পানকৌড়ি বসে আছে। আসলে এ হাওরে পরিযায়ী পাখি আসে আরও পরে।
কিছুক্ষণ বিলে থেকে আসি হাওড়সংলগ্ন কানুনগো বাজারে। এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে খাই দুপুরের খাবার। খিচুড়ির মতো ভাত, হলদে রঙের। সঙ্গে আলাদাভাবে ছোলা দেওয়া। স্থানীয়দের ভাষায় এ খাবারের নাম ‘চানা বিরানি’। অর্থাৎ চানা বিরিয়ানি। আমি সঙ্গে একটা ডিমভাজা নিই। ভিন্ন স্বাদের বিরিয়ানি। খাবার শেষে একটা চায়ের দোকানে খাই রঙ-চা। এরপর ফিরতে শুরু করি।