শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২১, ১২:১১

একজন সবজিওয়ালা

মোহাম্মদ তাইয়্যেব হোসাইন
একজন সবজিওয়ালা

এই তরকারি! তরকারি! শব্দ পৌঁছুতেই এমনভাবে তাকায় যেনো তাদের উত্তপ্তটাকে তরকারি সাজিয়েছে শিশির। তবুও শিশির হাঁক ছাড়ে, তরকারি! এই লন তাজা তরকারি! শিশির পরিবারের বড়। বোন দুটো ছোট নিলুফা আর লাকী, নিলুফা শিশিরের এক বছরের ছোট। পড়াশোনা করলে শিশির ক্লাস এইটে থাকতো এই বছর। বোন দুটো কত সুন্দর করে হাসে, মন কাড়াহাসি, লাকীর বয়স চার বছর। এই বয়সেই পাকনা কথা বলা শিখে গেছে। ভাইয়া ভাইয়া বলেই সারাদিন পাগল করে দেয় শিশিরকে। শিশিরের মা সীমান্তদের বাসায় কাজ করতো। সীমান্ত যখন ছোট তখন সেখানে কাজে গিয়েছিলো শিশিরের মা। যাই হোক, শিশিরের মার বেশ কদিন কাজ ছিলো না। এমনিতেই টানাটানির সংসার তখন তো নূন আনতে পান্তার সঙ্কট। শিশির দিনরাত ফেরি করে যা পায় তিনবেলা না হলেও দুবেলা হয় তাদের। আবার কাজ পেলো শিশিরের মা। লোকের বাসায় বাসায় গিয়ে ময়লা আনার কাজ এবার। এ কাজে খাটনিটাও বেশি। এতো কষ্টের মধ্যেও রোজা রেখেছে। শিশিরও রোজা ভাঙে না, গলির পাশেই মসজিদ। আজান হলেই পলিথিন দিয়ে দোকান ঢেকে এক দৌড়ে নামাজে চলে যায়। একটা ট্রলি ওর, এটার ওপরই দোকানটা। ওর বাবা-মারা যাবার পর এক মহাজন থেকে ধার করে ট্রলিটা কিনে দিয়েছিলো ওর মা। ২৭ রমজান চলছে। ২৯ রমজান মহাজনকে টাকাটা ফেরত দেয়ার কথা। শিশিরের চোখ বুঁজে আসে চিন্তায়। টাকা না দিতে পারলে তো তার শেষ সম্বল এই ট্রলিটাও নিয়ে যাবে মহাজন। তাই ঈদ নিয়ে এতো ভাবনা নেই তার। তবুও লাল-নীল শপিং ব্যাগ হাতে সামর্থ্যবানদের চলাচল দেখে বুকের ভেতর টান লাগে শিশিরের। নিজের জন্যে না হোক, বোনগুলোর চোখের তারায় লাল-নীল জামা দেখার আনন্দ ওর বোধ হয় হবে না। মার জন্যে একটা শাড়িও হবে না হয়তো আর। এসব ভাবছে আর ওর ধূলোমাখা গাল বেয়ে বেয়ে পানির ফোঁটা পড়ছে। নিঃশব্দে কাঁদে সে, ভেতরে রক্তক্ষরণ হয় অনবরত। মা ময়লা তোলার কাজের টাকা পাবে শিশিরও তরকারি বিক্রি করছে কিন্তু এই টাকায় তো মহাজনের টাকা হবে না, কী হবে এবার! ভাবতে থাকে আর ব্যস্ত নগরীর মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকে ও। ফজরের নামাজ পড়েই আজ চলে আসে সে। সারাদিন ফেরি করেছে। দেখতে দেখতে ২৯ তারিখ এলো সব মিলিয়ে তখন এক হাজার টাকা কম আছে। এই টাকা কোথা হতে আনবে সে! আবার ফেরি করতে বের হয়। তেমন বিক্রি হয় না। হবে কেমন করে সেদিন কি কেউ তরকারি কিনে। সেমাই পোলাও কোরমা কিনে। তাই সারাদিন পরে দুশ’ টাকা হলো, বাকি টাকাটা কই পাবে সে। ভাবতেই কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে। এক মুঠোভাত কি মরিচ দিয়ে আর খাওয়া হবে না শিশিরদের। হায়রে শেষ সম্বলটাও বুঝি যেতে বসেছে এবার। ‘আল্লাহ মোগোরে বাঁচাও, বাঁচাও’ এই বলে আহাজারি করছে শিশিরের মা। নিলুফা কিছুটা বুঝে, চুপ করে আছে সে। আর লাকী তো খেলছে মার বানানো কাপড়ের পুতুলগুলো নিয়ে।

ঘরের বেড়ায় হেলান দিনে বসে পড়লো শিশির। মার গায়ে হাত দিলো, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মা। মার কান্না কি সহ্য হয়! কত কাঁদছে মা। এমন সময় মহাজনের আওয়াজ। শিশির আর ওর মা বেরিয়ে আসে। ওর মা বলে, ‘সাব পোলাডা বহুত খাটছে, টাহাও জোগাড় করছে তয় আটশ টাহা কম আছে।’ খেঁকিয়ে উঠে মহাজন, ‘এই জন্যেই কি তোগো টাকা দিছি আমি? এক টাকাও কম হইবো না, ওই কালাম ট্রলিটা নিয়া চল।’

ট্রলির ওপরে রাখা তরকারিগুলো ল-ভ- করলো কালাম। ট্রলিটা নিতে যাবে এমন সময়, শিশির মহাজনের পা ধরে ফেললো ‘সাব ও সাব নিয়েন না সাব ট্রলিডা, আমগো পেটে লাথি দিয়েন না সাব।’ মহাজন শুনলো না তরকারির ট্রলিটা নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে আসলো সে। বাক্হীন চোখে তাকিয়ে আছে শিশির, নিলুফা আর ওর মা। এমন সময় শিশির দৌড়ে গিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, মা মা গো, আমগো আর বাঁইচ্চা থাকা অইবো না মা। কি খাইয়া বাঁচুম মা? শিশিরের জন্যে কোনো সান্ত¡নার বাক্য হয়তো মায়ের জানা ছিলো না তাই চুপ করেই ছিলো সে। রাতটা পোহালো আহাজারিতে। আজ ঈদের দিন। বড় লোকদের ঈদ। পাশের বাড়ি হতে পোলাও-কোরমার ঘ্রাণ আসছে।

লাকী খাবে বলে কাঁদছে। বোঝানোর ভাষা নেই। শিশির লাকীকে কোলে নিলো, তার কান্নার আওয়াজ থেমে গেলো কিন্তু কান্না থামলো না তার। মা বসে আছে, চোখে তার হতাশার যোগ-বিয়োগের খেলা। কালের অন্ধকারে বারবার হারিয়ে যায় শিশিররা, লাকী নিলুফার লাল নীল জামা আর মায়ের নতুন শাড়ি। যুগ কেটে যায় ২০২০ গেলে ২০২১ আসবেই কিন্তু বদলাবে না শিশিরদের ভাগ্য। ঈদের খুশি শিশিরদের জন্যে খুশির দিন নয়, লাকীকে বোঝানোর দিন। ‘কান্দিস না বইন, দেহিস একদিন আমরাও আলোর মুখ দেখমু।’

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়