প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থা
রহিমা আক্তার মৌ
(গত সংখ্যার পর)
এবার আসি অন্য এক বিষয়ে। এসএসসি টেস্ট পরীক্ষায় মেয়ের প্রশ্নের জবাব লেখার মান তেমন ভালো না। একজন স্যারের কাছে দুটা পরীক্ষা দেয়া হয়। তিনি বললেন, ও সবই পারে কিন্তু সাজাতে গিয়ে সমস্যা করে। অতঃপর স্যার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার দুটো খাতা ওকে দেখায়। ও সেগুলো দেখে, বুঝে, পরের পরীক্ষায় সে অনেক ভালো করে। এসএসসি পরীক্ষায়ও ভালো করে। আপনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নাকি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারের শিক্ষক সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হলো আপনি একজন শিক্ষক। আপনার কাছে ওরা শিখতে এসেছে।
আমি প্রায় প্রয়োজনে বা দায়িত্বে হোক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে যাই। শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সাথে কথা বলি, ওদের ওনাদের কথা শুনি। সেদিন বাসায় এসে হাজবেন্ডকে বলি, জানো কোন জায়গায় যদি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৩/৪ জন অভিভাবক থাকেন আর অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২/৩ জন অভিভাবক থাকেন। নামকরারা মনে করে তারা হাতি আর অন্যরা পিঁপড়ে। অনেক অভিভাবক বলেন, আপনাকে অনেক জায়গায় দেখি। আমি বলি, হ্যাঁ দেখেন কখনও অভিভাবক হিসেবে কখনও পেশাগত কারণে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে বা কী অবস্থায় আছে তা প্রায় সকলেরই জানা। কেনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার পরও প্রায় সব বিষয় বাইরে পড়তে হচ্ছে? এমনও অনেক আছে, এক একটা বিষয় দুজন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, কিন্তু কেনো? ২০০৮ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি হাতে পেয়ে আমরা খুশিতে গদগদ হয়েছিলাম। আজ ২০২২ সাথে এসে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে কতবার যে ঢুবাতে হলো, কতবার যে ভাসাতে হলো তা আমাদের গুণীজনেরাই ভালো জানেন। অতঃপর শুনলাম, সম্ভবত ২০২৪ সাল থেকে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বানিজ্যিক বিভাগ থাকবে না। কলেজে গিয়ে ভাগ হবে। বলতে হয়, যাহা লাউ তাহাই কদু। আবার এটাও বলা যায় মন্দের ভালো। যে যুদ্ধ ৮ম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষায় হতো সে যুদ্ধ দু বছর কমে এসএসসির পরে হবে।
সবাই চায় তার সন্তান ভালো করুক, তার সন্তান প্রথম দ্বিতীয় হোক। কিন্তু আমি তা কখনও চাইনি। আমি চেয়েছি আমার সন্তান তার মেধাকে বিকশিত করে কাজে লাগাক। বিজ্ঞান বিভাগে থাকলে উচ্চশিক্ষার জন্যে সে যে কোনো পথ বেছে নিতে পারে বলে, প্রায় অনেকেই চায় তার সন্তানকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে। কিন্তু আসনসংখ্যা বলে একটা কথা তো আছে। বিগত দিনে দেখে এসেছি দেখছি ৮ম শ্রেণীতে উঠলেই তথাকথিত নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মুখের হাসি চলে যায়। ওষুধ ছাড়াই চিনি রোগ কমে যায়। এর একটাই কারণ, সন্তানকে বিজ্ঞান বিভাগ পেতেই হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞান বিভাগের আসন সীমিত। অনেক অভিভাবক নিজেই বলেন, এবার আমাদের যুদ্ধের বছর। শুনি আর হাসি আমি।
আগেই বলেছি, আমি সন্তানদের প্রথম বা দ্বিতীয় হতে বলি না। পড়ার চাপ নেই, এটা বলা যাবে না। উচ্চশিক্ষার জন্যে ভালো কোথাও ভর্তি হতে হলে তাকে ভালো করতে হবে। ছোট মেয়ে এবার একাদশে পড়ে। ও এসে বলে, মা মেয়েরা প্রেম করার সময় কই পায় বুঝি না। কলেজ, কোচিং করে বাসায় এসে মনে হয় নিজের নাম ভুলে যাই। আর ওরা দেখি মোবাইল টিপে আর টিপে। আমি মেয়েদের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করি বলে ওরা আমায় সব বলে। ক্লাসের কোন্ মেয়ে কোচিংয়ের কোন্ মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে কার সাথে, কে কফি খেতে যায় সবই বলে। আমি গল্প করি ওদের সাথে।
আমাদের গতিপথ বদলে দেয়ার আরেক যন্ত্র হলো মোবাইল। অনেক অভিভাবক বুঝে বা না বুঝে সন্তানের হাতে তুলে দেন একটা স্মার্ট মোবাইল। সেদিন এক শিক্ষক বললেন, ‘এই এক মোবাইলে রয়েছে ধর্মীয় বাণী আবার এই একই মোবাইলে রয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী দেখার কিছু। মোবাইল হাতে নিয়ে চিন্তা কর তুমি কোন্ দিকে যাবে’।
করোনা আমাদের এই যন্ত্রের সাথে আরো অঙ্গাঙ্গি করে তুলেছে। শিক্ষা-কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের মোবাইলের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ছোট মেয়ে এসে বলে, ওর সব বান্ধবীর স্মার্ট মোবাইল আছে, শুধু ওর নেই। স্মার্ট মোবাইল এখন না থাকা মানেই...। আপনি সন্তানের হাতে একটা স্মার্ট মোবাইল ধরিয়ে দিয়ে চিন্তাহীনভাবে আছেন, আপনার কি জানা উচিত না সে মোবাইল দিয়ে কি করে। শিক্ষাব্যবস্থা আপনার সন্তানের ঘাড়ে ভারি বোঝা তুলে দিতে পারে সহজেই, সেই বোঝা বহনের ক্ষমতা আপনার সন্তানের কতটুকু আছে তা আপনাকেই দেখতে হবে।
পাঠ্যবই হিসেবে সব ক্লাসের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয় ডজন ডজন বই। অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো খুলেও দেখে না। বাইরের শিক্ষকদের লেখা মোটা মোটা বই শুধু ব্যাগের ওজন বাড়ায় না ওর মেরুদণ্ডকেও বাঁকা করে দিচ্ছে, যা আপনি বুঝেন না। আর মহামূল্যবান নোটবুক তো আছেই। নোটবুক আমিও কিনি সেটা ততটুকু ব্যবহারের জন্যে যতটুকু তার শরীরে ও মস্তিষ্কের নিতে পারবে।
শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করার বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বলেছেন, ‘পরপর দুই পরীক্ষায় খারাপ করায় অভিভাবক ডাকবেন বলেছেন’। এই ডাকা কথাটা কোন্ সুরে বের হয়েছিলো আপনার বা আপনাদের মুখ দিয়ে। ও ক্লাসের প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী ওকে তো আপনার অনেক ভালো বোঝার কথা। আসলে গড়া জিনিসের কদর অন্যরকম। টুপ করে পাওয়া ফলের মর্যাদা ক’জন দিতে পারে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মুখের একটা বাক্য, ‘অভিভাবক ডাকবেন’। নিশ্চই ডাকবেন, কারণ এক একটা প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার বাচ্চা, আপনার হাজার হাজার শিক্ষার্থী বা সন্তান। কিন্তু ওই অভিভাবকের হয়ত এটাই একমাত্র বুকের ধন। নিজের দায় এড়াতে অনেকেই পারি অন্যকে দোষারোপ করতে। এখনকার অনেক অভিভাবক সন্তানকে সময় দিতে পারেন না বা দেন না, সেটা বলার সময় কিন্তু অনেক ছিল বা আছে। তাই দায় না এড়িয়ে আসুন না আগামী প্রজন্মের জন্যে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলি।
শিক্ষক ও ডাঃ মোঃ রিপন বিশ্বাস ফার্মগেটে অবস্থিত একটা কোচিংয়ে বায়োলজি পড়ান। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা নিয়ে তিনি একটা ভিডিও দেন। নবম শ্রেণীর মেয়েটিকে যখন ভ্যানে করে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি রাস্তায় ছিলেন। তিনি শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যস্থাপনাকে দায়ী করছেন এমন তাজা প্রাণ নিভে যাওয়ার কারণ হিসেবে। তিনি আরো বলেন, যে একবার ১০০তে ১০০ পায় সে আর কখনও ৯৮ পেতে পারবে না। অভিভাবকদের এমন মানসিকতার জন্যে অনেক শিক্ষার্থী নিজের বোধবুদ্ধি হারায়। আর প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গিও এর জন্যে অনেক দায়ী।
গণমাধ্যমকর্মী ফারাবী হাফিজ ফেসবুকে একটি ভিডিও দেন নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা নিয়ে। সেখানে তিনি বলেন, ‘পরপর দুইবার একই বিষয়ে খারাপ করায় তার অভিভাবককে ডাকা হবে। এটা সে মেনে নিতে পারেনি। স্কুলে ভর্তির পর থেকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতির মতো সব সব শিখতে হবে বাচ্চাকে। প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় তাকে হতেই হবে, থাকতেই হবে। এই মানসিকতায় কেড়ে নিল মেয়েটিকে’। ফারাবী অন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলেন, ‘বাহিরের দেশের প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় ক্লাসে অক্ষরজ্ঞ্যান দেয়া হয় না। শারীরিক ও মানসিক ভাবে তৈরি করে বাচ্চাদের, আর আমাদের দেশে চলে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হওয়ার না থাকার লড়াই’।
২৫ আগস্ট ২০২২ দুপুর দুইটায় সময় নিউজে ছাত্রী আত্মহত্যা নিয়ে নিউজ করা হয়। সেখানে বলা হয় নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী উচ্চতর গণিতে খারাপ করে। স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়ার কারণও তুলে ধরা হয়, যা ছাত্রীর অভিভাবক ও অন্য শিক্ষার্থীদের তথ্যমতে। একই সময়ে দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন অভিযোগের কথা বলা হয়। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, একই প্রতিষ্ঠানে পড়ে সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়া নিষেধ বলার পর ও এমন অভিযোগ সত্যি মেনে নেয়ার নয়। (সমাপ্ত)