প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৮:২২
দু মাসের অভয়াশ্রম শেষ : মাছ ধরতে নদীতে নামছে জেলেরা

ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মার্চ-এপ্রিল দু মাস মেঘনা-পদ্মায় অভয়াশ্রমে সকল প্রকার মাছ ধরা বন্ধ থাকার পর বৃহস্পতিবার (১ মে ২০২৫) থেকে মাছ ধরা শুরু হচ্ছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নদীতে মাছ ধরতে পারবে বলে প্রকৃত ইলিশ ছেলেদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
নিষেধাজ্ঞা শেষে নদীতে মাছ ধরতে যাবেন বা যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বড়ো জাল ও নৌকার জেলেরা তেমন মাছ না পাবার আশংকা করছেন ।একমাত্র নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলে ভর বর্ষাতে ইলিশ পাবার আশা তাদের।
সরজমিনে দেখা যায়, এতোদিন যেসব আড়তে ছিলো সুনসান নীরবতা, সেসব আড়ত জেলে, মৎস্যজীবী ও আড়তদারদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে উঠছে নিষেধাজ্ঞা তুলে যাবার একদিন আগ থেকেই।
মাছ ধরে বিগত দিনের ধার-দেনা শোধ করে ঘুরে দাঁড়াতে চান জেলেরা। তবে চাঁদপুরের নদীতে মাছ পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। এবার জাটকা রক্ষা মওসুমে চাঁদপুরের নদ নদীতে প্রচুর জাটকা নিধন হয়েছে। ছোট ছোট জেলে নৌকার জেলেরা স্থানীয় প্রশাসনের অভিযানকে আড়াল করে ঠিকই নদীতে গেছেন এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নদীতে মাছ ধরেছেন বলে অভিযোগ পর্যবেক্ষক মহল এবং বড়ো জাল নৌকার ইলিশ জেলেদের।
জাটকা সংরক্ষণের লক্ষে মার্চ-এপ্রিল দু মাস চাঁদপুরের ৭০ কিলোমিটারব্যাপী পদ্মা মেঘনায় অভয়াশ্রম ঘোষণা করে সরকার। এ সময় অনেকটা বেকার জীবন কাটান চাঁদপুরের ছান্দি, গুলতি জাল- নৌকার জেলেরা। তারা সরকারের আইন মেনে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে দু মাস নদীতে যায়নি। তাদের নৌকা জাল উপরে তুলে ফেলা হয়। আর ছোট নৌকাগুলো কারেন্ট জালসহ অন্য জাল ব্যবহার করে নদীতে নেমে জাটকা সহ সব ধরনের নদীর মাছ ধরেছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
৪৪ হাজার ৩৫ জন নিবন্ধিতসহ চাঁদপুর জেলায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার জেলে রয়েছে। গত দু মাস অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকা নৌকার জরা দূর করছেন তারা। পুরোনো নৌকা সংস্কার ও নতুন নৌকা তৈরি করে তাতে আলকাতরা মাখাচ্ছেন। নতুন আলকাতরা নৌকায় মাখানোর সময় এর ঝাঁজালো গন্ধ জেলে পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জেলে পুরোনো জাল বুনছেন তথা সংস্কার করছেন। জালের পুরোনো ছেঁড়া অংশ ফেলে নতুন সুতায় শক্তপোক্ত করে তুলছেন জাল। জালের কিনারে মোটা সুতা, পোড়ামাটির কাঠি ও চাড়া জুড়ে দিচ্ছেন।
চাঁদপুরের প্রকৃত ইলিশ জেলেরা জানান, ১ মে থেকে জেলেদের নাম আড়তদারের নতুন খাতায় উঠবে। ওই দিন ইলিশের ভরা মৌসুমের শুরু। অনেকে ওই দিন নতুন নৌকা, জাল নিয়ে নদীতে নামবেন, যাকে জেলেরা বলেন জাল সাভার। জাল সাভারে জেলেরা লাগাচ্ছেন নানা রকম রঙিন বাতি, সোলার। আড়তদারেরা জেলেদের রঙিন পতাকা দেবেন। এসব পতাকায় নিজ নিজ মার্কাজুড়ে দেবেন আড়তদারেরা। ছবিঘরে আর্ট হচ্ছে সেসব মার্কা।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বড় মাছঘাট এলাকা বহরিয়া, হরিনা, আখনের হাট গিয়ে দেখা যায়, মেঘনা নদীর সাথে সংযোগ রক্ষাকারী সেখানকার খালগুলোর মুখে জেলেরা জাল মেরামত করছেন। অন্যদিকে তাদের নৌকায় আলকাতরা মাখানো হচ্ছে। যারা জাল মেরামত করছেন তারা জানান, ১ মে'র আগে তাদের সবকিছু ঠিক করতে হবে। অভিযান না থাকায় এখন মাছ ধরতে যাবেন নদীতে। আল্লাহর উপর ভরসা, যদি কিছু মাছ পাওয়ার আশা।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে দুমাস অভয়াশ্রম এলাকায় সকল ধরনের মাছ ধরা থেকে আমরা জেলেদেরকে বিরত রেখেছি। নদীতে কঠোর নজরদারি ছিলো। এ বছর জাটকা রক্ষায় শক্তভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং তা সফল হয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। আর ইলিশ উৎপাদন বাড়লে জেলে যারা আছেন তারাই মূলত স্বাবলম্বী হতে পারবেন।
চাঁদপুরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, জাতীয় সম্পদ ইলিশ রক্ষায় সরকার দুমাসের যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নে জেলা ও উপজেলা টাস্কফোর্সের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত ছিলো। অভিযানকালে জেলেদের খাদ্য সহায়তা হিসেবে জনপ্রতি ৪০ কেজি করে ৪ কিস্তিতে মোট ১৬০ কেজি চাল সঠিক সময়ে প্রদান করা হয়েছে। তবে ইলিশ সম্পদ রক্ষা প্রকল্প থেকে দ্রুতগামী ১০টি স্পীড বোট বরাদ্দ থাকায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, কোস্টগার্ড ও জেলা উপজেলা টাস্কফোর্স এবার অনবরত যৌথ অভিযানে নেমেছে। তাই জেলেরা নদীতে নামার তেমন একটা সুযোগ পায়নি। ফলে নদীতে এবার ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলেই আশা করছি। তাছাড়া অসাধু জেলেদের আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, এবারের অভিযানে ৩৮টি মোবাইল কোর্ট, ৭শ' ৯৫টি অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তিন শতাধিক জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। প্রায় ১০ দশমিক ৮৯৫ লাখ মিটার কারেন্টজাল জব্দ ও ৬ দশমিক ৪৬৩ টন জাটকা আটক করে গরিব-দুঃস্থ ও এতিমদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। আর জরিমানা আদায় করা হয়েছে ৩ লাখ ৫০৫ টাকা।
মতলব উত্তর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজয় কুমার দাস বলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় জেলেরা সব মাছ ধরতে পারবেন। তবে জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা আগামী জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। এ ছাড়া মেঘনায় অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহারও নিষিদ্ধ থাকছে।
এই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানান,
মতলব উত্তর উপজেলার সীমানায় গত ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৮০টি অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে ১৭ টন জাটকা, ১৪ লাখ মিটার কারেন্ট জাল ও ৭টি নৌকা জব্দ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা করা হয় ১৭ জেলের। নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জাটকা রক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রত্যেক জেলেকে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত তারা এ সহায়তা পাবেন।