প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নগরে যেসব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক, জলবায়ু ও দুর্যোগ সহনশীল নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ফলপ্রসূ অভিযোজন কৌশল নির্ধারণে স্থানীয় ভৌগোলিক জ্ঞানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক ও জনমিতিক বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় প্রয়োজন, বিশেষ করে দরকার স্থানীয় উদ্ভাবন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে স্থানীয় সরকারের কৌশলগত পরিকল্পনাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু ও দুর্যোগ সহনশীল কর্মকৌশল সম্পৃক্তকরণ একান্ত জরুরি। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনকে (কপ-২৬) সামনে রেখে রাজধানীতে এক জাতীয় পর্যায়ের সংলাপে নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। বক্তারা জলবায়ু উদ্বাস্তু বান্ধব শহর গড়ে তোলার পাশাপাশি জলবায়ু সুশাসন বিশেষ করে জলবায়ু তহবিলের সঠিক ব্যবহারের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
বৃহস্পতিবার (১৪ অক্টোবর) দুপুরে দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ ও প্রতীকী যুব সংসদের যৌথ উদ্যোগে ‘কপ-২৬-এর জন্য বাংলাদেশের শহুরে সমাজের কণ্ঠস্বর’ বিষয়ক জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আকমল শরীফ। নভেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিতব্য কপ-২৬ ঘিরে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ ও অংশীজন বিশেষ করে শহরে বসবাসরতদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত এবং জীবিকার প্রভাব এবং মানিয়ে নেয়ার পদ্ধতিগুলোকে নিরূপণ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।
সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মোঃ শামসুদ্দোহার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. শওকত বেগম, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ একেএম মামুনুর রশিদ, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্টের উপ-পরিচালক মিজান আর খান, নগর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সরদার শফিকুল ইসলাম, ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহার নঈম ওয়ারা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সূচিতা শারমিন, সেভ দ্য চিলড্রেনের উপ-পরিচালক ড. নাজমুন নাহার, প্রতীকী যুব সংসদের নির্বাহী প্রধান সোহানুর রহমান, অ্যাকশন এইডের অমিত দে প্রমুখ। অনলাইন আলোচনায় যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান, ব্র্যাকের ক্লাইমেট ব্রিজ ফান্ডের হেড গোলাম রব্বানী এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ধরিত্রী কুমার সরকার।
সংলাপে বক্তারা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন পৃথিবী ও মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এ সংকটের বিরূপ প্রভাব পড়ছে গ্রাম ও শহরের মানুষের জীবন ও জীবিকায়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে বাড়ি-ঘর, জীবিকা হারিয়ে ভিড় জমাচ্ছে শহরগুলোতে। এতে শহরে জলবায়ু বাস্তুচ্যুত মানুষদের বসবাস বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রভাব পড়ছে নাগরিক জীবনে, মান কমছে নাগরিক পরিসেবার। এই পরিস্থিতি এখন সংকটে রূপ নিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী দু’দশকের মধ্যে এক কোটি মানুষ রাজধানীতে চলে আসবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ঢাকা বা বড় নগরগুলোতে আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে যে উদ্বাস্তুরা আসবে তা গ্রহণ করার মত কোনো সক্ষমতা নেই। এজন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে কার্যকর যুগোপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। এটা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারি ও বেসরকারি খাতে যৌথ মনিটরিং দক্ষতা বাড়াতে হবে।
প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. শওকত বেগম বলেন, নগরে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নগরকেন্দ্রিক জলবায়ু পরিকল্পনা থেকে নারী, শিশু, যুব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কাউকে বাদ দেয়া বা পিছিয়ে রাখা যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর জলবায়ু বিশেষজ্ঞ একেএম মামুনুর রশিদ স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন, পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়নের প্রাপ্যতা এবং মানবাধিকার ইস্যুতে গুরুত্বারোপ করেন। তবে তিনি মনে করেন, সবকিছুতে জলবায়ু পরিবর্তনকে দোষারোপ না করে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজ হবে। শুধু জলবায়ু তহবিল দিয়ে সব সমস্যার সমাধান মিলবে না।
ডিজাস্টার ফোরামের সদস্যসচিব গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, আমরা নদী ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তন এখন প্রাণের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে ডায়রিয়ার মত পানিবাহিত রোগ দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপও বাড়ছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ নাগরিকদের ব্যক্তিগত পর্যায়েও দায়িত্ববান হতে হবে। জলবায়ু ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। জলবায়ু তহবিলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা টাকা খরচ করতে জানি না। সামনের দিকের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। আমাদের সদিচ্ছার সঙ্গে দরকার স্থানীয় সমস্যার স্থানীয় সমাধান।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড ডেভেলপমেন্টের উপ-পরিচালক মিজান আর খান বলেন, নগর জীবনে সুপেয় পানির সমস্যা সমাধানে কার্যকর সুশাসন ব্যবস্থার বিকল্প নেই। নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ‘মিনি পার্লামেন্টে’র মত কাজ করতে পারে। তাই স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। বড় নগরগুলোর পাশাপাশি শহরগুলোকে জলবায়ু উদ্বাস্তু বান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশেন প্রোগ্রাম ম্যানেজার মইনউদ্দীন আহমেদ এবং ১০টি শহর পর্যায়ে পরিচালিত নাগরিক পরামর্শ সভা ও দলীয় আলোচনার তথ্য উপাত্ত তুলে ধরেন মহিউদ্দীন আহমেদ। এই পরামর্শ সভাগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু বিপদাপন্ন এলাকাগুলোর বিশেষত শহর অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থান, জলবায়ুজনিত ঝুঁকি ও বিপদাপন্নতাসমূহ, স্থানীয় সমাজ ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিযোজন সক্ষমতা নিরূপণের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি, জলবায়ু স্থানাস্তর ব্যবস্থাপনা এবং অভিযোজন তহবিলের বরাদ্দ ও যথার্থ ব্যবহার বিষয়ে নাগরিক সমাজ ও অংশীজনদের অগ্রাধিকারসমূহ মূল্যায়ন করা হয়, যা জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের সময়ে প্রচার করা হবে। রাজধানী ঢাকাসহ মোট ১০টি মহানগর ও শহর এলাকায় (চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, কক্সবাজার, জামালপুর, সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী ও সাতক্ষীরা) একটি করে দলীয় আলোচনা (ফোকাসড গ্রুপ ডিসকাসন) এবং ৪টি অংশীজন সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। ১০টি দলীয় আলোচনা এবং ৪০টি সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য সমন্বিত করে জাতীয় সংলাপে উপস্থাপন করা হয়।
সংলাপে নির্বাচিত কাউন্সিলর এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত নাগরিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আকমল শরীফ বলেন, তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। কপ-২৬ সম্মেলনে শুধু কথা নয়, জরুরি ভিত্তিতে কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। অভিযোজনের সীমা পার হয়ে গেলে যে সংকট তৈরি হবে তা মোকাবিলা করা সম্ভব নয় এবং অনেক ব্যয়সাপেক্ষ হবে। তাই এখনই কার্বন নির্গমণ হ্রাস করা এবং জলবায়ু জনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পর্যাপ্ত আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা প্রদানে বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে তিনি আহ্বান জানান।
প্রতীকী যুব সংসদের নির্বাহী প্রধান সোহানুর রহমান বলেন, শহুরে জীবনে তরুণরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানাভাবে বিপদাপন্ন। বাড়ছে নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, পানীয় জলের অধিকার। বঞ্চিত হচ্ছে বিকাশ ও শোভন কর্মসংস্থান থেকে। অনেক তরুণ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। তাদের সহনশীলতা বৃদ্ধিতে যৌথভাবে সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।