প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
মানুষে-পশুতে কোনো কোনো বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে ভিন্ন মাত্রার এক গল্পের প্রতিচ্ছবি। তেমনই একটি গল্পের সাক্ষী কঙ্গোতে অবস্থিত গরিলাদের অনাথাশ্রম ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। এই পার্কেই ২৬ সেপ্টেম্বর মারা যায় এনদাকাসি নামে একটি গরিলা। এনদাকাসির এই মৃত্যু নিছক একটি পশুর মৃত্যু নয়। কারণ তার জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে মানুষের সঙ্গে প্রেমের, বন্ধুত্বের অনন্য এক দৃষ্টান্ত।
এনদাকাসির জীবনের পুরোটা সময় তার খেয়াল রেখেছেন ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের বনরক্ষী আন্দ্রে বাউমা। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস আর আর দুঃখের অতলে হারাতে বসা চাহনি নিয়ে বসে থাকা বাউমার বুকে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে গরিলা এনদাকাসি।
এনদাকাসিকে একেবারে ছোট থেকে চিনতেন ফটোগ্রাফার ব্রেন্ট স্ট্রিটন। এনদাকাসির মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে ব্রেন্টের স্মৃতি তুলে ধরেছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।
গল্পের শুরু ২০০৭ সালে। ওই বছর ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে একটি অ্যাসাইনমেন্টে গিয়েছিলেন ব্রেন্ট স্ট্রিটন। সেখানে তিনি এমন বনরক্ষীদের সাথে কাজ করছিলেন, যাদের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে রীতিমতো লড়াই করে টিকে থাকতে হতো।
এরমধ্যে তারা একদিন খবর পান যে বিপন্নপ্রায় বেশ ক’'টি পার্বত্য গরিলা বা মাউন্টেন গরিলাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটি যান ব্রেন্ট স্ট্রিটন। সেখানে গিয়ে প্রথমবার এনদাকাসির সাথে দেখা হয় তার।
তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। দুই, চার বা ছয় মাস বয়সী ছোট্ট এনদাকাসি তার মায়ের মরদেহটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে। একে-৪৭-এর গুলিতে ঝাঁঝরা তার মায়ের শরীর থেকে তখনো তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছে। রক্তমাখা বৃষ্টির পানির মধ্যে শুইয়ে তখনো মরা মায়ের বুকে মুখ গুঁজে দুধ খাওয়ার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এনদাকাসি।
এনদাকাসিই তার পরিবারের একমাত্র সদস্য যে তখনো পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
বৃথা এ হত্যাকা- ওই সময়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা ছিল। তখন পৃথিবীতে মাউন্টেন গরিলার সংখ্যা ছিল মাত্র ৪০০-এর আশপাশে। এখন সে সংখ্যা বেড়ে হাজারের কিছু বেশি।
রোগা-দুর্বল ছিপছিপে গড়নের এনদাকাসিকে দেখে মনে হচ্ছিল বোধহয় খুব বেশিক্ষণ তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তারপরও তাকে বাঁচিয়ে রাখার শেষ আশা নিয়ে নিজের উষ্ণ হাতে তাকে কোলে তুলে নেন বনরক্ষী আন্দ্রে বাউমা। লক্ষ্য- সকাল পর্যন্ত যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। কিন্তু কে জানত এখান থেকেই শুরু নতুন এক অধ্যায়ের; দেখতে দেখতে যা ১৪ বছরের অসামান্য এক সম্পর্কের গল্পে পরিণত হয়েছে।
ভিরুঙ্গার সেনকোয়েক সেন্টারের হেড কেয়ারগিভার ছিলেন আন্দ্রে। এনদাকাসিকেও নেওয়া হয় সেখানে। সেখানে অনাথ অন্যান্য মাউন্টেন গরিলাদের সাথে রাখা হয় তাকে। প্রতিটা মুহূর্তে সেখানে তাদের যত্ন করে যেতেন ওই সেন্টারের কর্মীরা। গরিলা চিকিৎসক ছাড়াও অন্যান্য চিকিৎসক সেখানে একদম প্রথম দিন থেকে সাক্ষী হয়েছেন অসম্ভব একেকটা গল্পের।
মাউন্টেন গরিলারা খুব সংবেদনশীল হয়। দেখে মনে না হলেও আসলে তারা সহজেই রোগেশোকে আক্রান্ত হয়। আর নিরীহ প্রকৃতির তো আছেই। তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও স্বকীয়তা থাকে। ঠিক মানুষের মতো তাদের মনও কখনো আনন্দে নেচে ওঠে, আবার কখনো দুঃখের অনুভূতি বিচলিত করে তাদের। এনদাকাসির যারা দেখাশোনা করতেন তারা সবাই দেখেছেন তার মানুষের মতোই সব অনুভূতি। তাকে যারা দেখাশোনা করতেন, তারা আসলে নিজের পরিবারের চেয়েও বেশি সময় দিতেন এই এনদাকাসিকে। বাবা-মা হারানো এই গরিলাগুলো যেন আশ্রমে ফিরে পেয়েছিল তাদের বাবা-মা। আবার কেয়ারগিভাররাও গরিলাগুলোকে কখনো কখনো নিজের সন্তান বলেই পরিচয় দিতেন।
শুরু থেকে এনদাকাসির যত্নে কোথাও কোনো ত্রুটি না থাকলেও মাস ছয়েক আগে অজানা কোনো কারণে অসুস্থ হতে শুরু করে সে। প্রথমবার কোলে তুলে নেওয়ার ১৪ বছর পর, গেল সেপ্টেম্বরে সেই আন্দ্রের কোলে মুখ গুঁজেই এ জন্মের গল্পে ইতি টানে এনদাকাসি। জীবনের শেষ সময়টাতে এনদাকাসির অবস্থাটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এনদাকাসি যখন মারা যায়, ব্রেন্ট স্ট্রিটন তখন ভিরুঙ্গারই অন্য একটি স্থানে ছিলেন পার্কের শীর্ষনেতাদের সাথে। একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত পেতে সবাই বেশ বড় একটা আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু খবরটা যখন পৌঁছাল সবার মুখ থেকে ভাষা হারিয়ে যায়, নেমে আসে নীরবতা। আচমকা এমন একটা খবরের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না।
২০০৭ সাল থেকে অনেকবার ভিরুঙ্গাতে অ্যাসাইনমেন্টে গেছেন ব্রেন্ট স্ট্রিটন। ধরতে গেলে প্রতি দেড় বছরে একবার করে গেছেন তিনি। এবং এনদাকাসিকে বড় হতেও দেখেছেন। এই এনদাকাসি এবং সেখানে থাকা আরও তিনটি গরিলার যত্ন বাউমা ও অন্যরা যেভাবে নিয়েছেন তা অবাক করত স্ট্রিটনকে। এখানকার এই গরিলাগুলোই ছিল পৃথিবীর একমাত্র মাউন্টেন গরিলা, যারা বন্য নয়।
সেখানে তাদের যত্নে নিয়োজিত ছিলেন চারজন। তাদের চিকিৎসাবিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি ছিল না। কেতাবি কোনো জ্ঞানও ছিল না তাদের। কিন্তু তারা গরিলাগুলোকে পৃথিবীর যেকোনো অ্যাকাডেমিকের চেয়ে ভালোভাবে চিনতেন। এর সঠিক মূল্যায়নও কখনো তারা পাননি।
মাউন্টেন গরিলাদের সাথে মানুষের অনেক মিল রয়েছে। মানুষের মতো তারাও কখনো কখনো কোনো কারণে হতাশও হয়। ব্রেন্ট স্ট্রিটন মনে করেন, এরকম কিছু একটা হয়েছিল এনদাকাসির। তার হয়তো মনে হতো, কী যেন নেই, কিছু একটা নেই। যত সাহস ও আন্তরিকতা দিয়েই চেষ্টা করা হোক না কেন, জঙ্গলে স্বাধীনভাবে থাকার যে অনুভূতি সেটা তাদের দেওয়া সম্ভব হয়নি। আবার তাদের একেবারে ছেড়ে দেওয়াটাও মুশকিল, কারণ তারা না বনের না মানুষের। তাই তাদের যদি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানকার প্রাণীরা তাদের মেনে নেবে না। ঠিকঠাক কখনো সেটা করা যায়নি।
ব্রেন্ট স্ট্রিটন বিশ্বাস করেন যে, এনদাকাসিদের ভালো রাখার চেষ্টায় কোনো কমতি ছিল না। ভিরুঙ্গার ওই আশ্রমটিতে যারা কাজ করছিলেন তারা ছিলেন বিশ্বসেরা। তারপরও তার মৃত্যুর জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না, ঠিক একজন মানুষের মৃত্যু যেমন অনাকাক্সিক্ষত হয়। তবে, এনদাকাসি যখন মারা যায় তার পাশে তার ভালোবাসার মানুষগুলো ছিল।
স্ট্রিটনের ভাষায়, আমি একে অতিরঞ্জিত করতে চাই না। কিন্তু আমি এটাই দেখলাম।
গরিলাদের সমাজকাঠামোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের সমাজ মানুষের সমাজের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক। সেখানে শৃঙ্খলা রয়েছে, ভালোবাসা রয়েছে। একটি গরিলা তার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের দেখাশোনা করে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের হয়ে কাজ করতে গিয়ে স্ট্রিটনকে অনেক ক্ষেত্রেই বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য বা মানুষের সঙ্গে প্রাণীদের সম্পর্কের নেতিবাচক অংশের দিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। কিন্তু তিনি মনে করেন যে, হোক সে গ-ার বা বনরুই, অথবা সিংহ বা হাতি, এদের সঙ্গে যদি আন্তরিকতার সাথে মেশা যায়, সময় দেওয়া যায়, যদি তাদের হৃদয় জেতা যায় তবে তাদের সাথে অদ্ভূত একটি সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। সম্পর্কের মাত্রা সেই উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব যেখানে প্রতিদিন সকালে একটি হাতি আপনাকে তার মতো করে শুভেচ্ছা জানাবে, চোখের সামনে আপনাকে না দেখলে খুঁজবে বা শিকারি কোথায় লুকিয়ে আছে তা আপনাকে দেখিয়ে দেবে।
কুকুরের সাথে ইতোমধ্যে আমরা মানুষকে যে সম্পর্ক গড়তে দেখেছি তা আরও অনেক প্রাণীর সঙ্গেই সম্ভব। আর যদি গরিলার কথা বলা হয় তাহলে এ সম্পর্ক আরও বেশি গভীরে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে। এই গরিলাদের যতœ নেওয়ার দায়িত্ব যাদের কাঁধে ছিল তাদের জন্য গরিলাগুলো একেবারে মানুষের মতোই ছিল, তারাও একটা পরিবার ছিল।
স্ট্রিটন একটা ছোট্ট উদাহরণও দিয়েছেন। বাউমা যখন একটু বিরতি নিতে চাইত, এনদাকাসি গিয়ে তার পাশে দাঁড়াত। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো করে তার হাতটা ধরত। এখানে অবশ্যই এমন কিছু একটা আছে যা আমরা এখনো জানি না। এই পৃথিবীতে আমরা মানুষ ও প্রাণী আলাদা করে রেখেছি।
স্ট্রিটন মনে করেন, মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীর আরও ভালো বোঝাপড়ার সুযোগ আছে। যতটা সম্ভব, আমরা কেবল তার শুরুতে হাত দিয়েছি। এনদাকাসি সেটারই একটা উদাহরণ ছিল মাত্র।
অনুবাদ : নাঈম ফেরদৌস রিতম।
সূত্র : ঢাকা পোস্ট।