প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
‘উৎসব কথাটির অর্থ যা ‘সুখ প্রসব করে’। সুখ ও আনন্দ তো বটেই, সেই সুখ যেনো সর্বজনের কাছে পৌঁছায়, সেজন্যেই যেনো উৎসব শব্দটির মধ্যে ‘সব’ শব্দটি রয়েছে।
আর শরৎ মানেই বাঙালির স্বপ্ন প্রণোদিত হওয়ার, মন রঙে রঙে রাঙিয়ে উৎসবে ভেসে যাওয়ার ঋতু। সকালের সোনাঝরা রোদ, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, খোলা মাঠে- নদীর চরে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘নব আনন্দে জাগো’। শরৎ মানেই উৎসব। নিকোনে উঠোনে ভোরের আলো না ফুটতেই শিশিরকে সঙ্গে নিয়ে ঝরে পড়ে রাতে ফোঁটা শিউলি ফুল। মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে চারিদিক, আমাদের মনে করিয়ে দেয় এসেছে ‘শারদীয় দুর্গা উৎসব’। গেয়ে উঠে মন-
মাতলোরে ভূবন
বাজলো তোমার আলোর বেনু।
আজ প্রভাতে যে সুর শুনে
খুলে দিনু মন
বাজলো তোমার আলোর বেনু।
আমাদের কুমোরেরা অর্থাৎ মাটির শিল্পীরা ব্যস্ত হয়ে উঠে প্রতিমা গড়ার কাজে। আর ঢাকিরা ঢাক নিয়ে তৈরি। পূজোর অনেক আগে ঢাকের তালে তালে দেবীদুর্গার আগমনী বারতা নিয়ে হাজির হয় বাড়িতে বাড়িতে। ঘরে ঘরে বাড়িতে বাড়িতে মেয়েদের-মায়েদের-বউদের চোখের পাতায় ঘুম যেনো কেড়ে নেয়। কাজের ব্যস্ততায় খুব দ্রুত সময় গড়িয়ে যায়। বাড়িঘর ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, ঘর-বাড়িতে আবার একটু নতুন রঙের ছোঁয়া, নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে তোলা। ঘরের আঙ্গিনায়, বারান্দায় আল্পনা দিয়ে ভরিয়ে তোলা। আর এগুলো করার জন্যে আলাদা করে শিল্পীর দরকার হয় না, আমাদের প্রত্যেকের ভেতর যে শিল্পী-মন আছে তার প্রতিফলন ঘটে এই পূজোতে। এই উৎসবে নারিকেলের নাড়ু, মোয়া, সন্দেশ তৈরি করার প্রচ- রকমের ধুম পড়ে যায়। একেক বাড়িতে ২৫/৩০ জোড়া নারিকেল সংগ্রহ করা হয়। সে নারিকেলগুলো ছোলা, ভাঙ্গা, ঠনা খোলা, কুচা তৈরি করা, চিড়া কুটা- তারপর কাককে সামলে সেইসব নারিকেল রৌদে শুকিয়ে ঘরে আনা; খণ্ড তৈরি করা, সন্দেশের নারিকেল বাটা, সন্দেশ তৈরি করা। দিন-রাত জেগে ঘরে ঘরে আনন্দযোগ চলে। আত্মীয়স্বজন দ্বারা মুখরিত হয় বাড়িঘর। মুখে কষ্ট-বেদনার ছোঁয়াটি নেই এ আনন্দযোগ্যে। বাইরের আঙ্গিনায় অথবা মন্দিরে প্রতিমা গড়ার ধুম, তার মাঝে মাঝে ঢাকির ঢাক বেজে উঠে। সে সময় বাঙালির হৃদয়ে ‘মনময়ূরি নেচে উঠে’। যাপিতজীবনের ছোট-খাট দুঃখণ্ডকষ্ট মনোমানিল্যের কথা ভুলে গিয়ে সবাই মিলে সব কাজের সারথী হয়ে নাড়ু, মোয়া, সন্দেশ বেঁধে বড় বড় টিনের কৌটায় রাখা হয়। দেবীদুর্গার দশ হাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘরে ঘরে কাজের আনন্দে মেতে উঠে মেয়েরা, বৌরা, মায়েরা। আর নতুন জামা-কাপড়, নতুন শাড়ি, চুড়ি, গহনা আর জুতোতো আছেই।
আসে মহালয়া। যখন ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না, তখন রাতের অন্ধকার শেষ হওয়ার আগেই আকাশবাণী কোলকাতা থেকে শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চ-ীপাঠের মাধ্যমে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামক বেতার সংগীতালেখ্য অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হতো। গান গাইতেন তৎসময়ের সমস্ত নামীদামী শিল্পীরা। সেই গান আজও মনকে আন্দোলিত করে শিহরিত করে-চিত্তশুদ্ধি করার আনন্দে। মন ঘনীভূত হয় এক অর্বাচীন আনন্দে।
আসে পঞ্চমী। মাহেন্দ্রক্ষণ। ততোদিনে রঙের কাজ প্রায়ই শেষ, গভীর রাতে শিল্পী আঁকবে দেবীদুর্গার তৃতীয় নয়ন। সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কখন দেবীর তৃতীয় নয়ন আঁকা হবে। কখন দেবী দুর্গার ঢাকা মুখ খুলে দেয়া হবে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বিছানায় যেতে চায় না। বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়মের মধ্যে শেষ হয় প্রতিমা গড়ার কাজ। শাশ্বতরূপ নিয়ে মা আসে। শুরু হয় পূজো। বিশাল আয়োজন। এ পূজোতে ১০৮টি পদ্মসহ শত পদের উপকরণ যেমন লাগে তেমনি লাগে বিশেষ পাড়ার মাটি। ভোগের আয়োজন হয় হাজার হাজার মানুষের জন্যে। একেকটি বনেদি বাড়ির পূজোতে পঞ্চাশ থেকে ষাট পদের উপকরণ রান্না করা হয়।
আসলে পূজোর আরেক নাম সৃজনশীলতা। যে সৃজনশীলতার মাধ্যমে সমাজের সুবিধার জন্যে সৃষ্ট বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত মানুষকে একেই মঞ্চে একত্রিত করে পৃথিবীর সকল মানুষের সকল প্রাণীর মঙ্গল কামনা করা হয়। ধুপ, চন্দন, ফুল, বেলপাতা আর তুলসিপাতার মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মমত্ববোধ, প্রেম, ভালোবাসা জাগ্রত করাই পূজোর অন্যতম উদ্দেশ্য।
পূজোর মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাক-ঢোল শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে উচ্চারিত হয়...
যা দেবী সর্ব্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমঃ নমঃ