প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
যাঁর আগমনে দুনিয়া মাতোয়ারা
এসএম আনওয়ারুল করীম
আজ হতে প্রায় দেড়হাজার বছর আগে আরব দেশের মক্কা নগরের কোরাইশ বংশে এক আলোর দ্যুতি ঠিকরে পড়ে। যে আলোকরশ্মি প্রত্যক্ষ করতে সমগ্র সৃষ্টি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষ্যমাণ ছিল। সপ্ত আকাশ, সাত জমিন, নক্ষত্ররাজি, আকাশ, পাতাল, বায়ু তথা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সব মাখলুকাত সেই মহান অতিথির আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল। শুভ্র আকাশের মেঘপুঞ্জ নেচে নেচে যার প্রশংসাগাঁথা গাইছিল, বাতাসের হিল্লোল যার শুভাগমন আনন্দে পাতাগুলোকে দুলিয়ে নৃত্য প্রদর্শনে বাধ্য করছিল, মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের নাচন আনন্দের আতিশয্যে যার কদমবুচির আগ্রহে নিক্কণধ্বনি তুলছিল, পা-ুর বৃক্ষরাজি বিচিত্র পত্রপল্লবে সৃজিত পাখা নিয়ে যাকে বাতাস করে ধন্য হবার স্বপ্নে বিভোর ছিল- তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত উম্মতের কাণ্ডারি বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)। হাদিসে কুদসিতে খোদ আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : আমি মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাতের কিছুই সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং অতি সহজেই অনুমেয় যে, যাকে সৃষ্টি না করলে বিশ্ব জাহানের কিছুই অস্তিত্বে আসত না, যার বদৌলতে সমগ্র মাখলুকাত সৃষ্টি- তার আগমনে সেদিন সৃষ্টিজগৎ কতোটা উল্লাসে মেতেছিল, হুর-পরি কতটা সাজে সেজেছিল।
|আরো খবর
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদিকের নির্মল প্রকৃতিতে ধরাধামে আগমন করেন বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সাঃ)। তবে ঐতিহাসিকগণ তার আগমন তারিখ নিয়ে মতভেদের দোলাচলে দোল খেয়েছেন। অধিকাংশের মতে, তার জন্মতারিখ ৯ রবিউল আউয়াল। এছাড়া ৭, ৮, ১১, ১২ রবিউল আউয়াল সম্পর্কেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল হতেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সাঃ)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সাঃ)-এর মৃত্যুদিবস- এতে সব ঐতিহাসিকেরই ঐকমত্য রয়েছে।
মোহাম্মদ (সাঃ) বিশ্বনবী। পৃথিবী সৃষ্টির পর হতে মানুষকে হেদায়াতের রাজপথে আনতে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসুল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তন্মধ্যে মাত্র একশ’ চারজন রাসুলের ওপর আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়। এ একশ’ চারজন কিতাবপ্রাপ্ত নবী ছাড়াও লক্ষাধিক নবী-রাসুলই মহানবী (সাঃ)-এর উম্মত হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন। অন্যান্য নবী-রাসুল আগে পৃথিবীতে আগমন করলেও মহানবী (সাঃ)-কে আকর্ষণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ হিসেবে বিশ্ব-মাঝে প্রেরণ করেন। তাইতো তিনি শেষ নবী। তিনি খাতামুন্নাবিয়্যিন।
মোহাম্মদ (সাঃ) এক আদর্শ মহামানব। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন- নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুল-এর জীবনে রয়েছে অনুপম আদর্শ। তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ। শিশু, যুবা, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বীশেষে তিনি সবার জন্যই আদর্শ। ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, পেশাজীবী- সবার জীবনেই তিনি আদর্শ। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে মহানবী (সাঃ)-এর আগমন মুহূর্ত সম্পর্কে বলা হয়েছে- তিনি মা আমেনার পবিত্র গর্ভ হতে অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর ন্যায় ভূমিষ্ট হননি; বরং শুভ্র বসনের এক প্যাকেটজাত প্রক্রিয়ায় তিনি ধরাধামে আগমন করেন। একই সাথে অন্যান্য শিশুর ন্যায় তিনি চিৎ হয়ে ভূমিষ্ট হননি। তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন উপুড় হয়ে। অর্থাৎ লজ্জাস্থান যে মানুষের দৃষ্টি হতে চরম হেফাজতের বস্তু, তা’ শিশুনবীর জন্মের মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছে।
মহানবী (সাঃ) তখন শৈশবের গণ্ডি পেরিয়ে সতেরো বছরের বালক। তিনি দেখলেন, আরব দেশে বংশানুক্রমে গোত্রবিভেদ চরম আকার ধারণ করে আছে। একে কেন্দ্র করে ক’দিন পরপরই মারামারি হানাহানি হয়। বালক মোহাম্মদের অন্তরাত্মায় ব্যাপারটি দারুণভাবে বেদনার শলাকাবিদ্ধ করল। তিনি ভাবলেন- যে করেই হোক মানবতাকে এ দুর্বিষহ জীবন হতে মুক্তি দিতেই হবে। কিন্তু প্রক্রিয়া কী? আরববাসীর অস্তিমজ্জায় বংশ পরম্পরায় যে প্রতিশোধের দাবানল জ্বলে আছে, তা’ হতে অতো সহজেই কি তাদেরকে মুক্তবিহঙ্গে নিয়ে আসা যাবে? তিনি নিজ বয়সি তেরোজন বালককে তার ব্যাথাটি বোঝাতে সক্ষম হন। তারা বালক মোহাম্মদকে এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রত্যয়দীপ্ত হলো। তাদেরকে নিয়েই তিনি মাত্র সতেরো বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করলেন সেবামূলক সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’। এ হিলফুল ফুজুলের পরশে এসে সে যুগের যুবসমাজ এক বেহেশতি পরিবেশ খুঁজে পায়। ক্রমেই গোত্রবিদ্বেষ ছাইচাপা পড়তে শুরু করে। যৌবনের তারণায় যুবসমাজ যেসব অপকর্মে লিপ্ত হয়, বালক মোহাম্মদের পাশে এসে তারা হয়ে উঠল সোনার মানুষ। উলঙ্গপনা, বখাটেপনা, ইভটিজিং, মাদকাসক্তি যে বয়সি যুবকের নিত্যদিনের কর্ম, তারা মোহাম্মদের মিশনে যোগ দিয়ে হয়ে উঠল এর প্রতিরোধ আন্দোলনের জানবাজ সৈনিক। তাইতো বালক মোহাম্মদ এক অতুলনীয় আদর্শ। আজকের সমাজ যদি বালক মোহাম্মদের এ নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা হতে শিক্ষা নিত, তাহলে অবশ্যই আমরা এক সোনালি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হতাম।
আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর তুলনা দুষ্প্রাপ্য। সেই জাহেলি যুগের পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলো পর্যন্ত মহানবী (সাঃ)-কে শ্রেষ্ঠ আমানতদার বলে বিশ্বাস করত। তাইতো তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে ‘আল-আমিন’ বা ‘মহাবিশ্বাসী’ বলে উপাধি দিয়েছিল। অতএব, আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সাঃ)-এর মতো দ্বিতীয় কাউকে বিশ্ব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া সাদা কাকের ন্যায়ই বিরল।
শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সাঃ) অনুপম আদর্শ। ‘শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও’- বলে বিশ্বনবী (সাঃ) যেই চিরন্তন উক্তি উচ্চারণ করে গেছেন, তা’ কালের আবর্তে গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমের সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণেই আমাদের দেশে ক’দিন পর পর আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যে আট শ্রমিক জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তাদের স্মরণ করতে আজ বিশ্বপরিমণ্ডলে আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার দিবস পালিত হয়ে থাকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শ্রমিকদরদি মোহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রদত্ত উপর্যুক্ত উক্তি যদি আজকের মালিকসমাজ সঠিকভাবে গ্রহণ করে, তাহলে মানুষ সত্যিই এক অনুপম পরিবেশ খুঁজে পেত। একইভাবে মহানবী (সাঃ) নিজে উটের লাগাম ধরে পালাক্রমে শ্রমিককে উপরে বসিয়ে টেনে নেওয়ার নজির গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়টি আছে কি?
নারীর অধিকার বাস্তবায়নে মহানবী (সাঃ)-এর অনুপম আদর্শ বিশ্বনন্দিত। যেই যুগে কন্যাসন্তান জন্মানোকে কৌলীন্যের চাবিকাঠি মনে করা হতো। মেয়েসন্তান জন্মালে তাকে জীবিত গর্তে প্রোথন করে হত্যা করা হতো। এহেন অমানবীক ও জঘন্য অপরাধ আরব সমাজকে বিশ্ব দরবারে আজও নিন্দিত ও ধিক্কার দিয়ে আসছে। বিশ্বনবী (সাঃ) জাহেলি যুগের সেই কলুষিত অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আরব জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন। যেই সমাজে নারীকে অসুর মনে করা হতো, নারীর অধিকার বলতে যে সমাজে কিছুই ছিল না- সেই যুগে বিশ্বনবী (সাঃ) ঘোষণা করলেন : ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বললেন, পুরুষের যেমন অধিকার রয়েছে, মহিলারও সমান অধিকার রয়েছে। তিনি আরও বললেন, ‘সে-ই সবচে’ ভালো পুরুষ, যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো’। নারীমুক্তির অগ্রদূত মহানবী (সাঃ)-এর এসব বাণী হতে নারীজাতি পেল তাদের বেঁচে থাকার অধিকার। পেল প্রকৃত স্বাধীনতা। তাইতো তিনি নারীমুক্তি আন্দোলনের আদর্শ।
একজন ব্যবসায়ী হিসেবে মহানবী (সাঃ) বিশ্ববাজারে আদর্শ। তিনি নিজেই ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসার ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে তিনি নিষেধ করেছেন। একবার তিনি নিজেই এক বণিক কাফেলার কাছে কাপড় বিক্রি করেন। ঘটনাক্রমে ঐ কাপড়ের গাঁটের এক স্থানে কিছুটা খুঁত ছিল। তিনি ভুলক্রমে বিষয়টি তাদেরকে বলেননি। বণিক কাফেলা বহুদূর যাওয়ার পর ব্যাপারটি প্রিয়নবী (সাঃ)-এর মনে পড়ে। তিনি তৎক্ষণাৎ ঘোড়া হাঁকিয়ে তাদের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি তাদেরকে অবহিত করে খুঁতের কারণে অতিরিক্ত মূল্য তাদেরকে ফিরিয়ে দেন।
আরেকবারের ঘটনা। তিনি বাজারে গিয়ে এক খেজুর বিক্রেতার ঝুড়িতে নিজ হাত ঢুকিয়ে দেখেন খেজুরের ঝুড়ির নিচের অংশে ভেজা খেজুর ও উপরে শুকনো খেজুর। তিনি বিক্রেতাকে ভর্ৎসনা করে এমন প্রতারণার ব্যবসা হতে বিরত থাকতে নির্দেশ দিলেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা সঠিক ওজনে পরিমাপ করো’। বিশ্বনবী (সাঃ)-এর এ সুন্দর আদর্শ আজ যদি আমাদের সমাজে বলবৎ থাকত, তাহলে সত্যিই এক সোনালি সমাজ অবলোকন করা সম্ভব হতো।
এক কথায় বলা যায়, দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তথা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি যে বিভাগেই হোক না কেন, সর্বত্রই রাসুল (সাঃ)-এর অনুপম আদর্শ রয়েছে। বর্তমান দুনিয়ার সর্বত্র মহানবী (সাঃ)-এর প্রদর্শিত আদর্শ অনুসরণ করলে সত্যিকারের কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণ সম্ভব।
প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাস এলেই আমাদের মাঝে মহানবী সা.-এর আলোচনা হিড়িক পড়ে। কিন্তু মাসটি শেষ হয়ে গেলেই যেন আমরা যেইসেই হয়ে যাই। আমরা মনে করি, মহানবী (সাঃ) শুধু এক মাসের জন্যই আমাদের নবী নন, তিনি আমাদের জীবনের সার্বক্ষণিক নবী। অতএব, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে চলতে হবে। তবেই পরিলক্ষিত হবে শান্তিময় হানাহানিমুক্ত এক সোনালি বসুন্ধরা।
লেখক : মুহাদ্দিস, গবেষক ও প্রাবন্ধিক; আলোচক, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস), আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স।