প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আজ ৫ অক্টোবর ডঙজখউ ঞঊঅঈঐঊজঝ উঅণ. ১৯৪৬ সালে ইউনেস্কো শিক্ষকদের পেশাগত স্বাধীনতা, অধিকার এবং আর্থ-সামাজিক ও নৈতিক ভিত্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্ব শিক্ষক সনদ নামক একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করে। এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ই অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃসরকার সম্মেলনে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সংক্রান্ত বিশেষ সুপারিশমালা গ্রহণ করা হয়। সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখটি অর্থবহ ও স্মরণীয় করে তোলার লক্ষ্যে ইউনেস্কোর সাধারণ সভার ২৬তম অধিবেশনে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে টঘঊঝঈঙ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রচলন করে। এরপর ১৯৯৫ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ১০০টি দেশের সাথে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে যথাযথ মর্যাদা, তাৎপর্য ও গুরুত্ব সহকারে শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দিবসটি পালন করে আসছে।
ঊউটঈঅঞওঙঘ ওঘঞঊজঘঅঞওঙঘঅখ বা ঊও তার সহযোগী ৪০১টি সদস্য সংগঠন এ দিবসটি পালনে মূল ভূমিকা রাখে। দিবসটি উপলক্ষ্যে ই.আই. প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে থাকে যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকদের ধ্যান, ব্রত, সাধনা বা মহান পেশার অবদানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য ঞবধপযবৎং’ ধঃ ঃযব যবধৎঃ ড়ভ বফঁপধঃরড়হ ৎবপড়াবৎু-সৃষ্টির সেরা মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি বা বিবেক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিক্ষার আলো ছাত্রদের মাঝে বিতরণ করেন সম্মানিত শিক্ষক সমাজ বা মহান শিক্ষকেরা। আমরা সাধারণ কিন্তু তৈরি করি অসাধারণ। ধুপের মত গন্ধ বিলিয়ে, মোমবাতির মত নিজেকে জ্বালিয়ে এবং সিঁড়ির মতো বুক পেতে দিয়ে আমরা তৃপ্তি পাই। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রায় ৯০ শতাংশ তথা ছাত্র সমাজের শিক্ষার জন্য যে স্কুলের দরজা খোলা থাকে তা হলো এমপিওভুক্ত স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা। দীর্ঘসময় ধরে এমপিওভুক্ত না হলে, কমিটি দ্বারা হয়রানির শিকার হলে বা কর্মরত অবস্থায় অসুস্থ, মৃত্যুবরণ করলে বা অবসর গ্রহণের পরে দীর্ঘদিন যাবৎ অবসর ভাতা ও কল্যাণ তহবিলের অর্থ না পেলে একজন শিক্ষকের পরিবারে যে চরম আর্থিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তা মনে পড়ে যায় বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক, খ্যাতনামা লোকসাহিত্য গবেষক ও জীবনবাদী কবি আশরাফ সিদ্দিকী রচিত ‘তালেব মাস্টার’ কবিতার সারমর্মখানা উপলব্ধি করলে।
“তালসোনাপুর গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক তালেব মাস্টার। দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি শিক্ষকতা করছেন পাড়ার পাঠশালায়। অসংখ্য কচিমুখ ছাত্রের কথা আজ তার মনে পড়ে। গর্ব হয় তখন, যখন দেখেন তার ছাত্রদের অনেকেই আজ নানা ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। যাদের নাম শুনলে সবাই চিনতে পারে। অথচ তাদেরই শিক্ষক তালেব মাস্টারকে কেউ চিনবে না। বয়সের ভারে পিঠ বেঁকে গেছে। তিনি চোখেও দেখেন না ভালো করে। তাই তিনি এখনই আত্মজীবনী লিখে যেতে চান। পরে হয়তো সময় আর পাবেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেক কবি-সাহিত্যিক কত কাহিনীই না লিখে গেছেন। তাঁদের লেখায় জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা তেমন আসে নি। যেমনটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পেরেছেন। তাই মানিক বাবুকে তালেব মাস্টার তার জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার কথা শোনান।
যে জীবন এ বাংলাদেশের নির্মম চিত্র। বাল্যকালে ছাত্র হিসেবে তালেব মাস্টার খুব ভালো ছিলেন। তবু পড়ালেখা অষ্টম শ্রেণীর পর আর এগোয় নি। পিতামাতার অভাবের কারণে তার পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। জমিদার বাবু দয়া করে ছেলেমেয়েদের পড়াবার কাজ দিয়েছিলেন। বেতন মাসিক মাত্র সাড়ে তিন টাকা। এরপর তিনি নিজেই পাড়ায় স্কুল খুলেছেন। তিনি জ্ঞানের প্রদীপকে জ্বালিয়ে রেখেছেন অম্লান করে। সময় গেল জলধারার মতো। অনেক ছাত্র এলো, অনেকেই উত্তীর্ণ হয়ে চলে গেলো। অথচ তার বেতন দশ টাকাতেই দাঁড়িয়ে আছে। জীবনে সর্বপ্রথম মাথায় কষাঘাত করে বিলাপে ফেটে পড়েছিলেন তালেব মাস্টার সেদিন, যেদিন পয়সার অভাবে একমাত্র পুত্রের পড়ালেখা বন্ধ করাতে হয়েছিল তাকে। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা যখন জ্বরে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল, তখন আল্লাহর কাছে শুধু তার দারিদ্র্যের অনুযোগ তুলেছিলেন তালেব মাস্টার। তারপরেও ছাত্রদের তিনি নিরন্তর বুঝিয়ে চলেছেন, পথিবীতে সবচেয়ে বড় ধন হলো বিদ্যা। পড়ালেখা ছেড়ে তালেব মাস্টারের ছেলেটি এখন পাঁচ টাকা বেতনে মহাজনী কারবারে চাকরি করে। পুত্রের এ রোজগার বেঁচে থাকার জন্য তাকে সাহায্য করে।
পঞ্চাশ সালে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ। ঘরে-বাইরে নিত্যদিন উপবাস চলে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যায় কলেরায়। এ কলেরা তালেব মাস্টারের ঘরেও আঘাত হানে। কলেরায় তার পুত্রটি মারা যায়, পায় না চিকিৎসা কিংবা শুশ্রুষা। বাইশ বছরের পুত্রকে অর্র্থাভাবে তিনি কাফনের কাপড় পর্যন্ত দিতে পারেন নি। এখানেই তালেব মাস্টারের দুঃখের ইতিকথার শেষ নয়। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন পলাশতলী গ্রামে। সেখানেও দুর্ভিক্ষ হানা দেয়। অবস্থাটা মানুষে মানুষ খায় পর্যায়ের। মেয়েটি অনাহার যাতনা এবং বস্ত্রের অভাবে সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে গলায় কলসি বেঁধে পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করে। তালেব মাস্টার মনে করেন, মানিক বাবুর যে দয়ার্দ্র মন তাতে তার দুঃখগাঁথা শুনে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন নি নিশ্চয়ই। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলো। কিন্তু তালেব মাস্টারের ভাগ্য রইল অপরিবর্তিতই। ছয় মাস ধরে স্ত্রী অসুস্থ। শরীরের অবস্থা ভালো নেই। পাঁচ মাস ধরে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ বেতন দিচ্ছে না। মৃত্যুর আগে এবার টাকা আসবে কি-না তা নিয়ে তিনি সংশয়াচ্ছন্ন। তারপরেও ছেঁড়া জামাটা পরে প্রতিদিন স্কুলে যান, ছাত্রদের পড়ান।
তালেব মাস্টারের কথা ইতিহাস হয়তো লিখে রাখবে না। তালেব মাস্টার যেন সে-ই বাতিওয়ালা, যে পথে পথে আলো জ্বালায় কিন্তু নিজের ঘরে আলো জ্বালাবার কেউ নেই। মানিক বাবুকে স্মরণ করে তিনি বলেন, তিনি তাঁর অনেক বই পড়েছেন। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস পড়ে তিনি ব্যথায় কেঁদেছেন অনেক। খোদা মানিক বাবুকে দীর্ঘজীবী করুন এ প্রার্থনা তালেব মাস্টারের। তালেব মাস্টার মানিক বাবুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন আরো একটা বই লিখেন। তাঁর দরদসিক্ত সে বইয়ের নায়ক হবে এই তালেব মাস্টার। সে বইয়ের কোথাও রোমান্সের ছোঁয়া থাকবে না। থাকবে খাঁটি বাস্তবতার কথা এবং বাংলাদেশেরই জীবন বাস্তবতা।”
সময়ের ব্যাপক পরিবর্তন হলেও আজ এদেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা বহুজাতিক কোম্পানির কেরানি হতে চায় কিন্তু শিক্ষক হতে চায় না। বহুজাতিক কোম্পানিতে বহুমুখী যে আর্থিক সুবিধা দেয়া হয়, তা শিক্ষকের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যায় না। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন সরকার শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলভুক্ত করে বেতনের ৫০ ভাগ সরকারি কোষাগার থেকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ধাপে ধাপে মূল বেতনের শতকরা ১০০ ভাগ, বাড়ি ভাড়া পাঁচগুণ, চিকিৎসা ভাতা দ্বিগুণ, উৎসব ভাতা (শিক্ষক ২৫% ও কর্মচারী ৫০%), ১লা জুলাই ২০১৮ থেকে ৫% ইনক্রিমেন্ট চালু এবং অবসরে আর্থিক সুবিধা বর্তমানে শিক্ষকেরা বিলম্বে পেয়ে থাকেন।
বর্তমান সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে ব্যাপক যুগোপযোগী বা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বর্তমান সরকার। এতে পরীক্ষার পরিবর্তে মূল্যায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্যের স্বর্ণোজ্জল ইতিহাস না লিখলে আজ বড় অন্যায় হবে, ভুল হবে আর তা হলো ২৬১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে গত ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারীতে বর্তমান সরকার জাতীয়করণ করে হাজার হাজার সোনার হরিণ (সরকারি চাকুরি সোনার হরিণের মত) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজকে প্রদান করার কথা না লিখলে। তাই বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ, শুভেচ্ছা, কৃতজ্ঞতা ও আন্তরিক অভিনন্দন তাদের পরিবারের সামাজিক ও আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য। বর্তমান সরকার প্রধান অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের সাথে ২০২১-২২ সালে ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট প্রণয়ন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের নতুন পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছেন। গত ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে প্রকাশিত ‘শিক্ষকের সম্মানে লাল গালিচা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে সংবাদে জানতে পারলাম, ১লা ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন করতে যান শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান। তিনি শেখ হাসিনার শিক্ষক। আর সে অনুষ্ঠানেই ছাত্র-শিক্ষকের চির অমলিন শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ককে সম্মান দেখিয়ে নিজ শিক্ষকের জন্য লাল গালিচা ছেড়ে হাঁটার অনন্য নজির স্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই সম্মান প্রদর্শন দৃশ্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃষ্টান্তকে অনুকরণীয় বলে মত সবার। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হয়ে নিজের শিক্ষাগুরুকে সামনে পেয়ে সম্মান দিতে ভুলে যাননি শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বলেই হয়তো এমন বিরল দৃশ্যের মুখোমুখি হতে পারলো গোটা জাতি। পরিশেষে সাড়ে ছয় কোটি শিক্ষা পরিবারের একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি (অনুরোধ বা দাবি একটা চলমান প্রক্রিয়া)। নিকট অতীতের মত যত দ্রুত সম্ভব বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ (স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা) জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে আপনার নাম ইতিহাসের পাতায় (প্রাথমিকের মত) স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করবেন। তখন আমরা সারা দেশের শিক্ষক সমাজ কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার কালজয়ী শেষ উক্তি খানা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বলতেই থাকব (কবিতার ভাষায় লিখছি) ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, শধরংধৎফরহধলঢ়ঁৎ@ুধযড়ড়.পড়স