প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় ইতিহাসবিদ Jacob F. Field সম্পাদিত গ্রন্থ ‘We Shall Fight on the Beaches : The Speeches That Inspired History’’। এ গ্রন্থে মানবসভ্যতার গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ৪১টি ভাষণের অন্যতম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণটি। একাত্তরের মার্চের ৭ তারিখে দেয়া রাজনীতির সেই মহাকাব্যটি ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ জন্যে আমরা গর্বিত, ইউনেস্কোকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
প্রাচীনকাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে মানবসভ্যতার ৪২৭টি ঐতিহ্যকে তালিকাভুক্ত করেছে। এই ঐতিহ্যের অন্যতম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। আমি যতটুকু দেখেছি, ৪২৭টি দালিলিক ঐতিহ্যের মধ্যে ভাষণ মাত্র একটি, তা বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ। শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরের অনায়াস নিয়ন্ত্রণে ১৮ মিনিটের ১১শ’ ৫ শব্দের এই ভাষণটি সবকিছু নিয়ে অনবদ্য।
স্পষ্ট-শাণিত-ক্ষুরধার বক্তব্য, আবেগ, যৌক্তিকতা এবং বক্তা ও শ্রোতার মাঝে অসম্ভব শক্তিশালী যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়তন্ত্রীকে আন্দোলিত করেছে এই ভাষণ। তাই অমর এই মহাকাব্যটি শ্রোতাকে আজও শিহরিত করে। পৃথিবীতে আর কোনো ভাষণ কখনো কোথাও এতবার শোনা হয়নি। এ ভাষণে স্পষ্ট মুজিব জনগণের, আর জনগণ মুজিবের। তিনি বাঙালির একমাত্র এবং অবিসংবাদিত নেতা। এ ভাষণ শুধু ঐতিহাসিক নয়, ইতিহাস সৃষ্টিকারীও। এ ভাষণ কালজয়ী, অবিস্মরণীয়-অবিনশ্বর। ভাষণটি যেন বিন্দুতে সিন্ধু।
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংগ্রাম ও তার প্রেক্ষাপট ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন বাঙালির বঞ্চিত হবার ইতিহাস। বলেছেন মানুষের আশা-স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার কথা। তাদের ক্ষোভকে যথার্থভাবে ব্যক্ত ও ধারণ করেছেন। তিনি ন্যায্যতা ও মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে অবিচল থেকেছেন। বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমরা মানুষের অধিকার চাই’। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে বাঙালিকে পথ প্রদর্শন করে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে আপামর জনগণকে তিনি জনযুদ্ধের সকল প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’। তিনি বাঙালিকে সর্বোচ্চ ত্যাগের জন্যে প্রস্তুত করেছেন-‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো’।
দীপ্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘বাঙালিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না’। একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণার জন্যে উন্মুখ জাতি, আরেকদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদিতার দায় চাপিয়ে দিয়ে অত্যাচারী শাসকের নির্মম নৃশংসতা এবং বিশ্বের সহমর্মিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে সংগ্রামে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর অসীম সাহস, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, ২৩ বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, বাংলা আর বাংলার জনগণের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর প্রগাঢ় ভালোবাসা নিয়ে ত্রিকালদর্শী মহানায়কের মতো ডাক দিয়েছেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
নিপীড়িত পরাধীন বাঙালি জাতিকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষার জন্যে সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। হাজার বছরে কোনো সংগ্রাম কোনো নেতাই সফল করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের সেই কাক্সিক্ষত নেতা, যিনি বৈষম্যের নির্মম শিকার পরাধীন বাঙালি জাতিকে সশস্ত্রযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র-বাংলাদেশ। তাই তিনি বাঙালির মহানায়ক, জাতির পিতা।
পৃথিবীখ্যাত আরো অনেক ভাষণ রয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সৃষ্টিকারী ৭ মার্চের ভাষণটি পৃথিবীতে একমাত্র ভাষণ, যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তাই ৭ মার্চের ভাষণ অমর মহাকাব্য, আর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সেই মহাকাব্যের অমর কবি।
বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে তাঁর প্রতি রইলো অতল শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও অশেষ ভালোবাসা। যতই মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা থাকুক, আমি বলি ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন সূর্যের মতন’। ঠিক তা-ই হচ্ছে। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।