রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য

সংগ্রামে জাগরণে পিতা ও দুহিতা

জাফর ওয়াজেদ

সংগ্রামে জাগরণে পিতা ও দুহিতা
অনলাইন ডেস্ক

জাগিয়ে তুলেছিলেন তিনি ঘুমন্ত বাঙালিকে। জাগরণের গান শুধু নয়, মুক্ত স্বাধীন মানুষের মতো বেঁচে থাকার মন্ত্র শুনিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন বজ্রকণ্ঠে ডাক মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার। প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তোলা, শত্রু হননে অস্ত্র তুলে নেবার আহ্বান করেছিলেন। ঘুমন্ত বাঙালি জেগে উঠে হুংকারে। রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুমন্ত বাঙালি মহাজাগরণের মন্ত্রে শত্রু হননে লড়েছে বীরের বেশে। দিয়েছে প্রাণ গণহত্যার বীভৎসতায়। তবু পরাভব মানেনি। বিজয়ের পতাকা দু’হাতে নিয়েছে তুলে বীর বাঙালি। সেই বীর জাতির মহান নেতা তিনি। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের নেতা পরিণত হন জাতির পিতায়। বাঙালির সহস্র বছরের আরাধ্য পুরুষ। কিন্তু সেই তিনি গ্রীক ট্রাজেডির মতোই বাঙালি জীবনের একমাত্র ট্রাজেডির মহাকাব্য হয়ে গেলেন। সপরিবারে শিকার হলেন কতিপয় দুর্বৃত্তের নৃৃশংস রক্তলোলুপতার। শুধু প্রবাসী দুই তনয়া বেঁচে গেলেন এই শোকের পাহাড় বয়ে বেড়াবার জন্য। শোকে মুহ্যমান তখন বাংলার মানুষ। কথা বলার ভাষাও ফেলেছিল হারিয়ে। মানুষের স্তব্ধতায় আতঙ্ক জাগিয়ে ঘাতকেরা হাসিল করে নিলো আরো হত্যাযজ্ঞের। যাদের শ্রমে মুক্ত স্বদেশ সেই চার নেতাও জেলখানার গরাদের ভেতর খুন হলেন হায়েনার নখরে। তারপর কোথায় হারিয়ে গেল দেশ। যে দেশের জন্য এতো যুদ্ধ, এতো রক্ত, এতো ক্ষয়, ধংসযজ্ঞ-সেই দেশ, সেই স্বাধীন মুক্ত বেঁচে থাকার প্রেরণা সবই লুণ্ঠিত ধূলায়-ইতিহাসের প্রহসন তৈরি হতে থাকে জান্তার রক্তচক্ষু শাসনে। যে শাসন ত্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করে মুক্ত স্বদেশ এনেছিলেন, হত্যার পর সেই শাসন ত্রাসন পুনর্বহাল হলো। প্রবাসী কন্যাদের দেশে ফেরার ওপর জারি হলো নিষেধাজ্ঞা। সংবিধান ছিন্নভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের প্রক্রিয়া শুরু। মহান নেতার আরাধ্য দেশ ছিন্নভিন্ন, অধিকারহীন মানুষ, জান্তার রক্তচক্ষু সর্বত্র, লেলিহান আগুনের ভেতর নাভিশ্বাস তোলে রাজনীতি, অবলুণ্ঠিত জাতিসত্তা, কুণ্ঠিত জীবন।

অবস্থা যখন এমন, দুহিতা নির্বাসন থেকেই পিতৃহত্যার বিচার দাবি করেন, বিশ্বমানবের কাছে। সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দুহিতা ফিরে এলেন নিজ মাতৃভূমে। যেখানে পিতা-মাতা-ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের রক্তে স্নাত ভূমি। হাত ধরলেন পিতার প্রতিষ্ঠিত দলের। জাতির ভাগ্যাকাশে সঞ্চারিত হতে থাকে আশার আলো। কিন্তু পদে পদে বাধা। জেল, জুলুম, নির্যাতন কেবল নয়, ‘প্রাণে বধের’ নানাজাত ঘৃণ্য প্রক্রিয়াও চলে। নিহত পিতার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিয়েছিলেন, কোনোভাবেই টলবেন না। বাঙালির অধিকার আদায়ে হবেন না পিছ পা। সেই শপথের পথ ধরে টানা প্রায় ত্রিশ বছর ধরে নিরলস শ্রমে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন বিশ্বনেত্রীর আসনে। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যেতে যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, তিনি সকল প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে গেছেন। এখনো শ্রমে, কর্মে, নিষ্ঠা, কুশলতায়, আন্তরিকতা, ঔদার্যে, একাগ্রতায় নিয়ত মানবমুক্তি ও কল্যাণে নিরলস। বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে অন্নে বস্ত্রে, প্রতিটি শিশুকে দিতে শিক্ষার আলো, চিকিৎসার সুযোগ আর প্রতি মানুষের বসবাসের নিশ্চয়তা দিতে কী অসাধ্য সাধনাই করে যাচ্ছেন এখনো।

পিতা এবং দুহিতা। পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একদিন এনে দিয়েছিলেন এই স্বাধীন বাংলাদেশ। সেই দেশ যেন আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম পঁচাত্তর ট্রাজেডির পর। হারানো দেশ ফিরিয়ে আনলেন বঙ্গবন্ধু দুহিতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। পিতা আড়াই দশকের এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এনেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। দুহিতা আর এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, একুশ বছর পরে হারানো দেশকে আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন। পাঁচ বছর পর সেই পুনরুদ্ধার করা দেশকে পশ্চাতে টেনে নিতে বাঙালি বিরোধী ঘাতকদের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা শাসকেরা এক মহাযজ্ঞ শুরু করেছিল। যার রেশ চলেছে টানা সাত বছর ধরে। আবারো সংগ্রাম, জেল, জুলুম, নির্যাতন। নির্বাসন সহ্য করে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশকে আবারো মূলধারায় ফিরিয়ে নেবার সমস্ত আয়োজনে ব্যস্ত থেকে মানুষের চাহিদাকে সামনে রেখে এক উজ্জ্বল দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলার নিয়ত সাধনারত। লক্ষ্য তাঁর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া।

বিপ্লবের-সংগ্রামের অগ্নিশিখা কখনো নিভে যায় না। হয়তো স্তিমিত হয়ে আসে শুধু। কিন্তু সম্পূর্ণ নির্বাপিত হয় না। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম-যুগ যুগে নেতৃত্ব থেকে নেতৃত্বে নিজকে বহন করে চলে। পিতা মুজিবের হাত থেকে সংগ্রামের শিখা কন্যা হাসিনার হাতে। পঁচাত্তরে ঘাতকের আঘাতে তা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিভে যায় নি। ছ’বছর পরে গত শতকের একাশিতে শেখ হাসিনা এসে সেই শিখাকে আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। নিভতে দেন নি। বাবা মা স্বজন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে গেছেন পিতা প্রদর্শিত পথে। পিতা সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁকে শেষ করতে দেয়া হয় নি। তাছাড়া সময়টা ছিল বড়ই দুঃসময়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটা দেশে ধংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে গড়ার কাজে এগিয়ে যাওয়া খুবই দুঃসাধ্য। বিশেষ করে দেশে ও দেশের বাইরে যখন স্বাধীনতার শত্রুরা হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসাপরায়ণ। এদেশকে কোনোমতেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়া যাবে না-এই হীন সংকল্প নিয়ে ছিল তৎপর।

পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করছেন পুত্রী। তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; দৃঢ় সংকল্প। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে নিরলস যে শ্রম-তা সাফল্যম-িত হবার সম্ভাবনাই অধিক-সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্তের পরও। এমন সিদ্ধান্ত আসে, গত চল্লিশ বছরে যে পথ পাড়ি দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, সে পথের বিশ্লেষণে তো এটাই প্রতীয়মান যে, কী তাঁর কাজ, কীভাবে সে কাজ তিনি সমাধা করবেন তা প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যাকে বুঝিয়ে বলার খুব একটা দরকার হয় নি। তিনি জানেন তাঁর কাজ, চিনেন তাঁর পথ। সোনার চামচ মুখে দিয়ে শেখ হাসিনা জন্মগ্রহণ করেন নি। তাঁর জন্ম হয়েছিল এ দেশেরই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। এদেশের দুঃখী মানুষের, মাটির মানুষের মাঝে, এক সংগ্রামী পিতার ঘরে। বুঝবার বয়স থেকে তিনি শুনে এসেছেন দেশের কথা, দেশের মানুষের অধিকারের সংগ্রামের কথা। জনজীবনকে দেখেছেন অতি কাছ থেকে। অনুভব করেছেন নিবিড়ভাবে। পিতাকে বারবার কারাগারে যেতে দেখেছেন। তাঁর অনুপস্থিতি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। একই সঙ্গে সংগ্রামী পিতার জন্য গর্ববোধ করেছেন। এদেশের মাটি ও মানুষের স্পর্শ নিয়েই তাঁর ধ্যান ধারণায়, দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে তাঁর মূল্যায়নে কোনো অস্পষ্টতা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সব কন্যার প্রতি সব পিতারই স্নেহাতিশয্য থাকে। বঙ্গবন্ধুও তাঁর প্রথমা কন্যাকে খুব বেশি স্নেহ-মমতা দিয়ে ঘিরে রাখতেন। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে একদিন তাঁর সংগ্রামী ঐতিহ্যকে কোনো অন্যায়কারী অত্যাচারী রাষ্ট্রশক্তির কাছে মাথা নত না করার আদর্শকে, তাঁর রাজনীতিকে বহন করে নিয়ে যাবে স্নেহধন্যা এই কন্যা? আলোকচিত্রে তাকালে এখন দেখা যায়, কন্যার মাথায় হাত রেখে বঙ্গবন্ধু আশীর্বাদ করছেন। তিনি তো জানতেন, তাঁর কন্যা ষাটের দশকে, যখন তিনি জেলে, পিতার মুক্তির দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছে, কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতির দায়িত্ব সুচারুভবে পালন করেছে। এমন কি গণঅভ্যুত্থানের সময় মিছিলে নেতৃত্ব শুধু নয়, শ্লোগানও তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর শিল্পসাহিত্য প্রীতির প্রভাবে তাঁর তনয়া সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাংলা সাহিত্য থেকে বিশ্ব সাহিত্য শুধু নয়, দর্শন, ধর্মতত্ত্বও তাঁর পাঠ্যসূচি থেকে বাদ নেই। শিক্ষার্থী জীবনে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গাও পাঠ করতেন, এমনটাই ছিল পাঠাভ্যাস। কোনো বিষয়কেই তুচ্ছ করে না দেখা, সব বিষয়ে জানা শোনার পরিধি যতই বেড়েছে রাষ্ট্র ও দল পরিচালনায় দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে। পিতা-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্তর কবিতা মুখস্থ আবৃত্তি করতেন ভরাট কণ্ঠে। কন্যার পাঠ্য তালিকার পরিধিতে এই একুশ শতকের সর্বশেষ ভাবনা, চিন্তা, বিশ্বমানবের উত্থানের গতি প্রকৃতি, দারিদ্র্য বিমোচনও রয়েছে।

সেই একদিন এসেছিলো আশি দশকের প্রারম্ভে। নির্বাসন জীবন ছেড়ে ফিরে এলেন কন্যা শেখ হাসিনা। নির্দ্বিধায়, নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে এলেন পিতার ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে যেতে। তাঁর সোনার বাংলার স্বপ্নকে সার্থক করে তুলতে। কী আশ্চর্য মিল, অভিন্নতা পিতা পুত্রীর সংগ্রামী কর্মধারায়। একাত্তরে স্বৈরাচারী সামরিক শক্তি যখন গণরায় মেনে নিতে চাইলো না তখন বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। জনগণ ছাড়া আর কোনো শক্তি কোনো বন্দুক কামান তাঁর ছিল না। এই গণশক্তির জোরেই সেদিনের স্বৈরশক্তিকে তিনি শাসিয়ে ছিলেন “আমরা তাদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো।” দেশের মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন “বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল- যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।” বলেছিলেন, “রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ!” একটা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা আর কী ভাবে হতে পারে?

পঁচিশ বছর পর এদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায় করতে গিয়ে কন্যা শেখ হাসিনাও অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে ‘গণকার্ফু’ ঘোষণা করেছিলেন। তবে তার ঘোষিত এই ‘কার্ফু’ কার্যকর করার জন্য কোনো পুলিশ বিডিআর আনসারের প্রয়োজন পড়েনি। জনগণ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভোট কেন্দ্রে যায়নি। শতকরা পাঁচজনও ভোট দেয়নি। অথচ তিন মাস পর ১২ জুনের নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৩ শতাংশ। পিতার মতোই তিনি জানেন গণজাগরণ কীভাবে ঘটাতে হয়। আন্দোলন শুরু করে কখন কোন্খানে এসে থামতে হয়, তা-ও জানেন। তবু তাঁকে মোকাবেলা করতে হয়েছে, এখনো হয় ঘাতকের গুপ্ত চক্রান্ত। প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপে হত্যা করার মতো জঘন্য নারকীয় ঘটনা ঘটে। গত ত্রিশ বছরে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের বহু চেষ্টা, অপচেষ্টা, ষড়যন্ত্র হয়েছে। যা থেকে মুক্ত নন এখনো, কখনো। যারা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে, তাঁদের বশংবদরা এখনো তৎপর। তাই ২০০১ সালে গণরায় বদলে যায়। নিপীড়ন, নির্যাতন যেন একাত্তরের পাক বাহিনীর বীভৎসতাকে ধারণ করে। অগণতান্ত্রিক পথ ও পন্থার বিস্তার ঘটে। কণ্ঠরোধ, হামলা, মামলা সবই চলে। হয়রানির নানা কৌশল নেবার পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যার চেষ্টা হয়। যে দুর্ঘটনায় জননেত্রী আইভি রহমানসহ বহু প্রাণহানি ঘটে। শেখ হাসিনার শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার চিকিৎসা এখনো চলছে। ১৫ আগস্ট, আর ২১ আগস্টের ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় এখনো।

ষড়যন্ত্রের ঘনঘটায় ২০০৭ সালে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করার গভীর ষড়যন্ত্র নানা কৌশলে ব্যর্থ হয়ে জেলবন্দী করে নির্জন সেলে রাখে। কিন্তু জেলবন্দী শেখ হাসিনা যেন আরো দ্বিগুণ শক্তি ও সমর্থন নিয়ে বাংলার মানুষের কাছে প্রতিভাত হলেন। শাসকেরা দেশে ফেরার পথ আবারো বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু গণরায় এবং শেখ হাসিনার সাহস দৃঢ়তা বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভেস্তে যায়। সকল ষড়যন্ত্র চক্রান্ত একাই মোকাবেলা করেছেন জনগণের সমর্থন নিয়ে। বাংলার মানুষ তাকিয়ে ছিল তাঁর অধিকার ফিরে পাবার আশায় তাঁর কারামুক্তির জন্য। অভিন্ন দৃশ্য পিতার জীবনেতিহাসেও। পাকহানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে নির্জন কারাগারে ফাঁসির প্রকোষ্ঠে রেখেছিলেন একাত্তরের পুরো নয় মাস। কবর পর্যন্ত খুঁড়েছিল। কিন্তু হত্যা করার দুঃসাধ্য হয় নি পাকজান্তার। বরং কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর নামে দ্বিগুণ শক্তিতে বাংলার মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

পিতা ও পুত্রী যে আদর্শের জন্য লড়াই সংগ্রাম জীবন উৎসর্গ করেছেন, সে আদর্শ তো সকল পরাধীনতা, দুঃখ দারিদ্র্য, অভাব, অশিক্ষা, কুসংস্কার থেকে জাতিকে মুক্ত করে সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা; বাংলার মানুষকে সচ্ছল করা। পিতা এ লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি নিলেও ঘাতকরা তা বাস্তবায়নের সুযোগ দেয় নি। পুত্রী বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পিতা যেমন জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালন করেছেন, পুত্রীও তাই। জাতির জনকের হত্যার বিচার চেয়েছিলেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সেই হত্যার বিচার হয়েছে, খুনিদের একাংশের ফাঁসি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তিনি দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতোই। সেই বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালও গঠন করেছেন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হয়েছে। এখন বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের নিরূপণে এগিয়ে এসেছেন। জনহিতকর চেতনায় কর্মসূচি নিয়েছেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। ‘বাংলার মাটি, বাংলার ফল, বাংলার বায়ু, বাংলার জল’-এ বেড়ে ওঠা শেখ হাসিনা মাটি ও মানুষের মধ্যে জীবনের উৎসারণ ঘটিয়েছেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কোনো সময়ই দূরের মনে হয় না। মনে হয় যে, আমাদের বোন, আমাদের অগ্রজা। সুশীতল বটবৃক্ষের মতো মাথার ওপরে, নিচে আশ্রিতজনেরা তাতে পরম শান্তি খুঁজে নেয়। বিধবা, বয়স্কা কিংবা দরিদ্র কৃষকের কাছে কিংবা এখনো খেয়াঘাটে নৌকো পারাপার করে যে মাঝি তাদের কাছেও তিনি অতি আপনজন ‘শেখের বেটি’। গ্রাম বাংলার মাঠ ঘাট প্রান্তর জুড়ে তাঁর দৃষ্টি অবিরল খোঁজে দরিদ্র বাঙালি কৃষক, মজুরের জীবন থেকে দারিদ্র্যের ছাপ মুছে দিতে। কিষাণ-কিষাণীর মুখে দু’মুঠো অন্ন দিতে। পিতা যেমনটি চেয়েছিলেন। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে তথ্য প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চান। পিতার সোনার বাংলা গড়ে তোলার এই প্রচেষ্টা মাইলফলক হয়ে বিস্তার ঘটাবে বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালি জাতির সাফল্য। জাতি হিসেবে উন্নততর চিন্তার অধিকারী হয়ে উঠুক বাঙালি-শেখ হাসিনার চাওয়া তো তা-ই।

১৯৮১ সাল থেকে নবতর যাত্রা শুরু করে চল্লিশ বছরের চলার পথে যে অভিজ্ঞতা লব্ধ হয়েছে, তা-ই তাঁকে দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনায়, দল সংগঠিত করায় শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছে। উত্তরণ ঘটেছে ক্রমান্বয়ে রাজনীতিবিদ থেকে প্রাজ্ঞজনে, পলিটিশিয়ান থেকে স্টেটসম্যানে। আর এই স্টেটসম্যাশীপ শেখ হাসিনাকে জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে পরিণত করেছে। পিতা ও দুহিতা-আমাদের কালে যে পথের নিশানা দিয়েছেন, সেই পথই তো চাওয়া হয়েছিল। সেই ষাটের দশক থেকে। আর সেই পথের দিশা নিয়েই তো ষাট, সত্তর দশক পেরিয়ে একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতি যখন ফিরে তাকায়, তখন ভেসে উঠে শুধু পিতা বঙ্গবন্ধু এবং দুহিতা শেখ হাসিনার অবয়ব।

বাংলাদেশকে তিনি উন্নয়নশীল দেশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববাসী অবাক তাকিয়ে, কী করে বাংলাদেশ হতশ্রীদরিদ্র দেশ থেকে আজ উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখায় তিনি পেয়েছেন অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও পদক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ সেপ্টেম্বর পঁচাত্তর বছরে পা দেবেন। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দৃঢ় নেতৃত্বে গত চল্লিশ বছরে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন। এবারের জন্মদিন বাঙালি জাতিকে বিকশিত হবার প্রেরণা যোগাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে, উন্নয়নশীল দেশের পথে উন্নীত করার দৃঢ়তায়। জন্মদিনে থাকুক অমলিন শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কামনা।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মহাপরিচালক, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়