প্রকাশ : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০
মানবাধিকার :
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, গুরুত্বপ্রাপ্ত এবং ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত একটি প্রত্যয় মানবাধিকার। ‘মানুষ’ ও ‘অধিকার’ হচ্ছে এ প্রত্যয়টির অন্তর্নিহিত বিষয়। শব্দ দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত। মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা, সহজাত ক্ষমতার সৃজনশীল বিকাশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় কতিপয় অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার। অধিকারগুলো মানুষের মূল্য ও মর্যাদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং মানুষরূপে জন্মলাভ করার কারণে তার জন্মগত অধিকার। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আর এ শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠতে দরকার মানবাধিকার। এ অধিকার ছাড়া মানুষের পূর্ণতা আসে না, মানুষ পরিপূর্ণরূপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবন-মৃত্যু যেমন মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য, তেমনি তার জন্য কতিপয় এ মৌলিক অধিকারও অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। নিম্নে মানবাধিকারের পরিচয়, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
মানবাধিকারের সংজ্ঞা :
মানবাধিকার হলো মানবের অধিকার। মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সহজাত, সর্বজনীন, অহস্তান্তরযোগ্য ও অলঙ্ঘনীয় অধিকারই হলো মানবাধিকার। সহজভাবে ‘মানবাধিকার’ বলতে আমরা সেই সব অধিকারকে বুঝি যা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং যা তাকে পরিপূর্ণ মানুষে বিকশিত হতে সাহায্য করে এবং যা হরণ করলে মানুষ আর মানুষ থাকে না এবং যে অধিকার থেকে প্রকৃতপক্ষে মানুষকে আলাদা করার কোন উপায় নেই। মানবাধিকার, এটি একটি ধারণা, একে সহজে বোঝা যায় কিন্তু বোধগম্য করে সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় না। ড. ডি. পি. খান্না বলেন, “The most starling feature of the concept of human reights is that it is so easy to understand. So difficult to define and impossible to ignor.' (Reforming Human Rights, P-16) তা সত্ত্বেও মানবাধিকারকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গাজী শামসুর রহমান বলেছেন, “সকল দেশের, সকল কালের, সকল মানুষের ন্যূনতম যে অধিকারগুচ্ছ সর্বজনীন স্বীকৃতস্বরূপ তারই নাম মানবাধিকার।” (মানবাধিকারের ভাষ্য, পৃ-৩৩)। ড. শফিক আহমেদ বলেছেন, “মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা, সহজাত ক্ষমতার বিকাশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের জন্য একান্তভাবে প্রয়োজনীয় অধিকার হচ্ছে মানবাধিকার।” (ইসলামে মানবাধিকার : নাগরিক ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ-১৫৪) জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের মতে, “মানুষের অস্তিত্ব ও পারস্পরিক সহ-অবস্থানের ভিত্তি হলো মানবাধিকার। মানবাধিকার সর্বজনীন, অবিভাজ্য ও পরস্পর সম্পর্কিত। শান্তি ও উন্নয়ন অর্জনের জন্য জাতিসংঘের যে আকাঙ্ক্ষা, এর হৃদপি- হচ্ছে মানবাধিকার।” (মানবাধিকার : ৫০ বছরের অগ্রযাত্রা, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি, পৃ-৫) জাতিসংঘের Universal Declaration of Human Rights এর অনুচ্ছেদ-১ এ বলা হয়েছে : All the human beings are born free and equal in dignity and rights. They are endowed with reason and conscience and should act towards one another in a spirit of brotherhood. (সকল মানুষ স্বাধীনভাবে এবং সমমর্যাদা ও সমান অধিকার নিয়ে জন্মে। তাদের উচিত বিচারবুদ্ধি ও বিবেকের অধিকার এবং ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে পরস্পরের সাথে আচরণ করা।)
বস্তুত যে সব মৌলিক অধিকার ছাড়া কোন মানুষ পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে মানবিক মর্যাদাসহ বাঁচতে পারে না এবং মানবিক ও স্বাভাবিক গুণাবলি ও বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে পারে না, সাধারণভাবে এ মৌলিক অধিকারগুলোই মানবাধিকার। ব্যক্তিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি নানা প্রেক্ষিতে এর বিবেচনা হয়ে থাকে। যেমন ব্যক্তি হিসেবে বাক-স্বাধীনতা, বেঁচে থাকার ও বসবাসের স্বাধীনতা মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক হিসেবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমণ্ডঅধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা মানবাধিকারের অঙ্গ। অর্থনৈতিক হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, জীবিকা উপার্জন, সম্পদের অধিকার তথা জীবন ধারণের জন্য যে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ও যোগ্যতা অনুসারে কর্মসংস্থানের অবাধ অধিকার এক্ষেত্রে তা মানবাধিকার বলে গণ্য হয়। রাজনৈতিক হিসেবে মানবাধিকারের মধ্যে আসে নাগরিক অধিকার, দাবি আদায় ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার ইত্যাদি। মানবাধিকারের ধর্মীয় অংশে স্বাধীনভাবে নিজ ধর্ম পালন করা এবং অন্যকে পালন করতে দেওয়া প্রবলভাবে অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকারের নৈতিক দিক হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা, অশ্লীলতার প্রসার ও প্রচার বন্ধ করে শ্লীলতার প্রসারে ভূমিকা রাখা, সৎ কাজের আহ্বান জানানো, অসৎ ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখা, মাতাণ্ডপিতা ও বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, ছোটদের স্নেহ ও শাসন এবং যথাযথভাবে লালন-পালনের ব্যবস্থাকরণ, সমাজের দরিদ্র, অসহায়, বিধবা, ইয়াতিম প্রমুখদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো ইত্যাদি। মানবাধিকারের সাংস্কৃতিক দিক হলো শিক্ষা গ্রহণের অধিকার, নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধ অনুসারে জীবন-যাপনে মার্জিত ও সহনীয় নীতি অবলম্বন, সুস্থ বিনোদন ইত্যাদি।
মানবাধিকারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ:
ক্ল্যাসিক্যাল যুগ, মধ্যযুগ ও রেনেসাঁ যুগে শাসক ও সবলদের হাতে প্রজা ও দুর্বলেরা অত্যাচার ও নির্যাতনে শিকার হতে থাকলে দার্শনিকগণ মনে করেন যে, প্রত্যেক মানুষ ন্যূনতম মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জন্মগত কিছু প্রাকৃতিক অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এ অধিকার রক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে Charters, Bills, Petitions ও Declarations প্রণয়ন করে। এসব দলিলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দে ব্যাবিলনের রাজা হাম্বুরাবি কর্তৃক Babylonia Code, খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে পারস্যের রাজা দ্বিতীয় সাইরাস কর্তৃক সাইরাস সিলিন্ডার, ইংল্যান্ডে ১২১৫ সালে প্রণিত Magna Carta, ১৬২৮ সালে প্রণীত Petition of Rights, ১৬৮৯ সালে Bill of Rights, ১৭৭৬ সালে উত্তর আমেরিকার ১৩টি ঔপনিবেশিক দেশের প্রতিনিধিগণ কর্তৃক প্রণিত Declaration of Independence ও ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে প্রণীত Declaration of the rights of Man and of Citizen প্রভৃতি। সাধারণভাবে মনে করা হয়, ১২১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ব্রিটেনের ম্যাগনাকার্টা হলো মানবাধিকারের প্রথম সনদ। প্রকৃতপক্ষে উৎসগতভাবে এটি কেবলমাত্র বৃটেনের রাজা ও জমিদার শ্রেণি ব্যারনদের (ব্যারন হচ্ছে বৃটেনের ভূমি মালিকদের সর্বনিম্ন খেতাব) মধ্যকার একটি চুক্তি, যাতে রাজা ব্যারনদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা লাভের পর মানবাধিকার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত হয় ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে গৃহীত জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণায়। এ ঘোষণা যে দর্শনের ওপর নির্ভরশীল তা হলো, সকল মানুষই বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সম-মর্যাদা ও সম-অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাদেরকে বুদ্ধি ও বিবেক দেয়া হয়েছে এবং তাদের উচিত ভ্রাতৃসুলভ মনোভাব নিয়ে একে অন্যের প্রতি আচরণ করা।
মূলত মানবাধিকার বিষয়ে সাম্প্রতিককালের গৃহীত এসব পদক্ষেপের বহু পূর্বে সপ্তম শতকের শুরুতে ইসলাম মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সম্পর্কিত এক ফলপ্রসূ দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার প্রায় ১৩৩৮ বছর পূর্বেই আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনা সনদের মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার বিস্তারিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। ইসলামে মানবাধিকারের বিষয়টি জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত। ইসলাম মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবময় অধিকার ও মর্যাদা প্রদান করেছে। মানুষকে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মর্মবাণী শুনিয়ে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, বংশীয় মর্যাদা, শ্রেণিবৈষম্য ও বর্ণপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেছে। অধীনদের প্রতি সদাচারী ও ন্যায়পরায়ণ হতে শিক্ষা দিয়েছে। আরব-অনারব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ সবাই একই পিতাণ্ডমাতা হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ)-এর সন্তান; এজন্য মানুষের মর্যাদার পার্থক্য একমাত্র তাদের রবের ভীতির মধ্যে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাত ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার, তবে তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই সম্মানিত যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে।” (সূরা হুজুরাত-১৩) সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানবজাতির সম্মান ও মর্যাদার অধিকার, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি জীবনযাত্রার মৌলিক অধিকার, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার, জীবনরক্ষণ ও সম্পদের নিরাপত্তার অধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, একতা, সংঘবদ্ধ ও সাম্যের অধিকার, হালাল উপার্জনের অধিকার, এতিম, মিসকিন, অসহায়, নারী ও শিশুর অধিকার, প্রতিবেশির অধিকার, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুদের অধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রভৃতি সব ব্যাপারেই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ও কালজয়ী চিরন্তন আদর্শ হিসেবে ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সুস্পষ্ট নীতিমালা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। পৃথিবীর সব দেশ, সব সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের চিন্তায় মানবাধিকার যেখানে একটি নিছক আদর্শবাদী ধারণা ও প্রত্যয়মাত্র ছিল, সেখানে ইসলামে মানবাধিকার ছিল বাস্তবতা। সুতরাং ইহা স্পষ্ট বলা যায় যে, মানবজাতি সমকালীন মানবাধিকার মতবাদের উন্নয়ন এবং এর এ সম্পর্কিত উৎস ইসলামের ধারণা থেকেই প্রাপ্ত হয়েছে। আর ইসলামণ্ডই একমাত্র মানবাধিকারের ফলপ্রসূ দিক-নির্দেশনা উপস্থাপন করেছে।
নূর মোহাম্মদ, প্রভাষক (ইসলাম শিক্ষা), বলাখাল মকবুল আহমেদ ডিগ্রি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।