রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২২, ০০:০০

আপনার মায়ের সেবা-যত্ন-দেখাশোনা কে করেন?
অনলাইন ডেস্ক

মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক চিরদিনের। প্রত্যেকেই মাকে ভালোবাসেন। এমন একটি বাক্য আমরা সবাই বিশ্বাস করি। মাকে কতটুকু ভালোবাসি এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে বৃদ্ধ মাকে কেমন ভালোবাসেন এ প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে এ প্রশ্নটি বারবার আসে। আমি যখন কোনো বিখ্যাত ক্ষমতাবান মানুষকে দেখি, তখনই জানতে ইচ্ছা করে, তার মা কার সঙ্গে থাকেন? এ প্রশ্নটি সরাসরি করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আমি ড্রাইভার, দারোয়ান, পিয়নকে জিজ্ঞেস করি, স্যারের মা কোথায় থাকেন? তারা আমাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একই ধরনের উত্তর দেন, স্যারের মা বাড়িতে থাকেন। অর্থাৎ স্যারের মা স্যারের বাসায় থাকেন না। আরেকটু গভীরে খোঁজ নিলে জানা যায়, স্যারের মা অন্য সন্তানের সঙ্গে থাকেন। আমাদের সমাজে ক্ষমতাবান ‘স্যার’ মাঝে মধ্যে মাকে নিয়ে গল্প করেন। আবেগপূর্ণ স্মৃতিচারণ করেন।

আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাকে নিজের কাছে রাখার অনেক চেষ্টা করি; কিন্তু তিনি থাকতে চান না। তার নাকি ভালো লাগে না। আসলে মার মন টেকে না।’ এসব কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন এমন অবস্থা হয়? যারা সামর্থ্যবান, তারা কেন মায়ের সেবা-যতœ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন? চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, মাকে পাশে নিয়ে দুপুর কিংবা রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয় না।

গবেষণায় দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারী দীর্ঘায়ু হন। বৃদ্ধ নারীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিধবা হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক নারী সবাই বিধবা। ৬০ বছর বয়সী নারীর অর্ধেকই বিধবা। এ বিধবাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই আবার বিয়ে করেন। আমাদের সমাজ বৃদ্ধের বিয়ে মেনে নিলেও বৃদ্ধার বিয়ে মানতে পারে না। বিধবা নারী প্রথম দিকে স্বামীর গৃহে বসবাস করতে চান। কারণ এখানে তার জীবনের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি রয়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। প্রায়ই নিজের পরিচিত স্থান থেকে সরে আসতে হয়। পরিচিত স্থান ছেড়ে আসার যাতনা কখনও কখনও তীব্র হতে পারে। রোগ-শোক আস্তে আস্তে কাবু করে ফেলে। আবেগময় আচরণের পরিবর্তন শুরু হয়। অল্পতেই চিৎকার, বকাবকি, হৈ-চৈ, অভিশাপ, নালিশ করেন। নিজেকে সংসারের অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তি মনে করেন। সংসারের বোঝা মনে করতে থাকেন। মৃত্যুর চিন্তা আসে। কীভাবে কখন মৃত্যু হতে পারে তা নিয়ে ভাবেন। নিজেকে নিয়ে অনেক সময় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সমাজের অনেকেই বিশ্বাস করেন, যৌবনে একজন মানুষ যত সুন্দর গুণাবলি অর্জন করুক না কেন বৃদ্ধকালে কলহপ্রিয়, নীচুমনা, সন্দেহপ্রবণ, স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিতে পরিণত হন।

ছেলেবেলায় গ্রামে মা-চাচিদের মুখে শুনতাম, ‘চাল নষ্ট মুড়ি, পাড়া নষ্ট বুড়ি’। অর্থাৎ যারা বুড়ি তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে। বুড়ি শাশুড়ির ভূমিকায় থাকে। সদ্য ক্ষমতা হারানোর যাতনা তাকে আক্রমণাত্মক করে তোলে। ক্ষমতার পালাবদল, শারীরিক পরিবর্তন, মানসিক যাতনা সবকিছু মিলিয়ে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এ অবস্থায় ছেলেমেয়েরাই বিধবা নারীর আশ্রয় হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়েরা বার্ধক্যের এ সংকট সম্পর্কে সচেতন না হলে মাকে বুঝতে পারবে না। বৃদ্ধ বয়সের হতাশা, অসন্তোষ, ব্যক্তিকে মনে করিয়ে দেয় জীবন ব্যর্থ। মায়ের এ সংকটকালে সন্তানের উপস্থিতি, ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, কর্তব্য পালন খুবই জরুরি।

আমাদের দেশের ১ কোটি প্রবাসী শ্রমিক এবং শহরে চাকরি-ব্যবসায় নিয়োজিত অধিকাংশের মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। তারা মাকে প্রত্যক্ষভাবে সেবা-যতœ করতে পারেন না। মায়ের বার্ধক্য স্বস্তিময়, শান্তিপূর্ণ, কর্মক্ষম রাখতে সন্তানসন্ততি, নিকটাত্মীয়ের সঠিক ভূমিকা পালন জরুরি। নারীর বার্ধক্য শান্তিপূর্ণ, আনন্দদায়ক না হলে জন্মদান হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে বলে আমার ধারণা। মাকে ভালোবাসি মানে মাকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করি, যাতে তিনি স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারেন। মাকে সহযোগিতা করি মানে মাকে অতিরিক্ত পরিশ্রম ছাড়া দৈনন্দিন কাজকর্ম আনন্দের সঙ্গে করার ক্ষমতা অর্জন করতে পারায় সহায়তা। মাকে খুব মনে পড়ে মানে মার সঙ্গে ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ নিশ্চিত করা। যিনি বৃদ্ধা হবেন তাকেও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হতে হবে, যাতে করে নিজ সম্পর্কে কম উদ্বিগ্ন হয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম উপভোগ করতে পারেন।

সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন মেলা, বিয়ে, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে বিভিন্ন বয়সী লোকের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ রাখা সহজ হয়। বর্তমান কর্মকা- উপভোগ করার মতো মানসিক ক্ষমতা অর্জন করা। যেসব বৃদ্ধ নারী অলস, কল্পনার জগতে বসবাস করেন, সব সময় সমালোচনামুখর, প্রতিনিয়ত স্মৃতিচারণ করেন, তারা তুলনামূলক বেশি কষ্ট পান। বৃদ্ধ বয়সে সুখী হওয়ার জন্য স্বীকৃতি, কৃতিত্ব, স্নেহ-ভালোবাসা অবশ্যই প্রয়োজন। যুব বয়সে যারা এসব অর্জন করেছেন, তারা সহজেই বৃদ্ধ বয়সে তা অর্জন করতে পারেন। মাকে তার পছন্দের জায়গায় বসবাস করতে সহায়তা করুন। তার ওষুধপথ্য, খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, বিনোদনের প্রতি সজাগ থাকুন। এসব না করলে আইনের চোখে আপনি একজন অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

প্রতিদিন অথবা সপ্তাহে একদিন মায়ের সঙ্গে কিছু সময় গল্প করে কাটান। যারা দূরে থাকেন, তারা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মায়ের সঙ্গে দেখা করুন। মায়ের হাতখানি ধরে পাশে বসুন। তাঁকে বলুন, ‘মা আমি তোমায় ভালোবাসি। এ সুন্দর পৃথিবী তুমি আমাকে দেখালে। আমার জন্য জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছ।’

বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা এক দুঃসহ যন্ত্রণা

নিঃসঙ্গতা সবসময়ই কষ্টের। কারণ মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষ প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করেছিল এক হয়ে। দল বেঁধে শিকার, পরে কৃষিনির্ভর জীবন মানুষকে দলবদ্ধ হতে বাধ্য করেছে। সমাজ পরিবর্তনের প্রতিটি ধাপেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে উন্নততর জীবনের প্রত্যাশায়। মানুষ নিজের প্রয়োজনে গড়ে তুলেছে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অর্জিত সম্পদ জমা হয়েছে ব্যক্তির হাতে। ব্যক্তি হয়ে উঠেছে প্রভু। অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতেছে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ণ সাফল্য, চিকিৎসায় প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে অনেক। মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সম্পদ অর্জনে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে, নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ নিতে। ফলে তৈরি হচ্ছে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর অশান্ত পরিবেশ। ফলে কষ্টে পড়ে শিশু, নারী, বৃদ্ধ। জীবিকার জন্য মানুষ সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। কাঁটাতার, গুলি উপেক্ষা করে সীমান্ত অতিক্রম করছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কাছে বলি হচ্ছে মানবতা। উপেক্ষা করছে আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। ফলে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষণœতা, দুশ্চিন্তার হাতে মানুষ বন্দি।

ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠনের নাম পরিবার। পরিবারে আমরা জন্মলাভ করি। পরিবারে বড় হয়ে উঠি। যৌবনে নিজেরা পরিবার গড়ি। বার্ধক্যে নির্ভরশীল হয়ে অন্য কোনো পরিবার নতুবা ‘শূন্য বাসায়’ বসবাস। প্রবীণ বয়সে নিঃসঙ্গতা দুধরনের। একটি হলো স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনের অভাব। অপরটি হলো সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। সাধারণত পুরুষের তুলনায় নারীদেরই অধিক হারে বৈধব্যবরণ করতে হয়। কারণ বিয়ের ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে পুরুষের বয়স বেশি থাকে। আবার নারীর গড় আয়ু বেশি অর্থাৎ নারী বেশিদিন বাঁচে। কে বেশি নিঃসঙ্গতায় ভোগে বিপতœীক নাকি বিধবা? একদল সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, বৈধব্যে একজন প্রবীণ নারী সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ে। সমাজ প্রবীণ বিধবার পুনঃ বিবাহকে সমর্থন করে না। একজন বৃদ্ধা তার চেয়ে কমবয়সী কাউকে বিয়ে করার সুযোগ পায় না বললেই চলে। অন্যদিকে বিপতœীক বৃদ্ধ সহজেই তার চেয়ে কমবয়সী কোনো বিধবাকে বিয়ে করার সুযোগ পান। কখনও আবার কমবয়সী অবিবাহিত নারীকে বিয়ে করেন। বিপতœীক প্রবীণ পুনঃবিবাহের মাধ্যমে নিঃসঙ্গতাকে মোকাবিলার চেষ্টা করেন। নতুন স্ত্রীর সঙ্গে বেশিরভাগ সময় সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা, নির্ভরশীলতা, আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। অনেক সময় সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজনের অসহযোগিতায় দাম্পত্য জীবন গভীর সংকটের মুখে পড়ে। ফলে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা দিন দিন বাড়তে থাকে। ছেলেমেয়েরা নিজেদের জীবন-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অথবা কর্মস্থলে দূরে থাকায় মা-বাবাকে তেমন একটা সময় দিতে পারে না। বিপতœীক ও বিধবা দুজনের জন্য বিরাট সমস্যা একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতা। শূন্য বাসায় বন্দি জীবন কাটানো সত্যিই দুঃসহ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। বিধবা প্রবীণ অন্য বিধবা প্রবীণকে সমব্যথী হিসেবে গ্রহণ করে কিছুটা স্বস্তি পায়। বিবাহ বিচ্ছেদ হলে নারী-পুরুষ উভয়ই ভয়ানক সংকটে পড়ে। সামাজিক-পারিবারিক সংকট প্রবীণদের নাজেহাল করে তোলে। বিবাহবিচ্ছেদের জন্য কে দায়ী এর চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু হয়। বিপর্যয় ঘটে বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক। প্রবীণ বয়সে বৈবাহিক সূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতা সমর্থন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়ে।

বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার ফলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। ছেলেমেয়ে না থাকলে প্রবীণদের সঙ্কট আরও বেশি। আর্থিক সহযোগিতা, ভরণপোষণ, চিকিৎসা, সেবা-যতœ পাওয়া কঠিন ব্যাপার। তালাকপ্রাপ্ত প্রবীণরা জীবনের শেষ দিনগুলোতে চরম নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। চিরকুমার-চিরকুমারী জীবনের ওপর গবেষণা হয়েছে, তারা বিবাহিত নারী-পুরুষের চেয়ে বেশি অসুখী হয়ে থাকেন। তারা চাকরি থেকে অবসর নিলে মনোবল হারিয়ে ফেলেন। কোথায় কার সঙ্গে থাকবেন এ হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বৃদ্ধ বয়সে সঠিক পরিচর্যা, সেবা-যতেœর অভাবে শরীর ভেঙে পড়ে। নিকটতমদের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ কমতে থাকে। ফলে নিষ্ঠুর একাকিত্ব তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় চিরকুমার বা চিরকুমারী অথবা বিবাহবিচ্ছেদপ্রাপ্তরা পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হন। শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণদের জীবন ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা-একাকিত্ব গ্রাস করে রেখেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ ঘর থেকে কারও সাহায্য ছাড়া বাইরে বেরুতে পারেন না। স্বাধীনভাবে ইচ্ছামতো কোথাও যাওয়া অসম্ভব বলে বাইরের জগৎ থেকে নিজেকে ক্রমেই সরিয়ে নিয়ে আসে। মনোবল আস্তে আস্তে কমে যায়। এক সময় নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আর যেসব প্রবীণ বিছানায় পড়ে আছেন তাদের একাকিত্ব অকল্পনীয়। যেসব প্রবীণ চোখে দেখেন না, কানে শোনেন না তারা সামাজিক জীবন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রবীণের সেবাযতœ ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর। আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রবীণ যথাযথ সেবা-যতেœর অভাবে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হন। সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই কমে যায়। আত্মীয়স্বজন তেমন একটা খোঁজ-খবর নেয় না।

সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ হলো মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ। শিশুকালে, যৌবনকালে মা-বাবা, ভাইবোনরা সেবা-যতœ, খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব পালন করে। এক সময় মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটি প্রবীণ বয়সে উপনীত হন। তখন মা-বাবা জীবিত থাকেন না। ভাইবোন থাকলে তারাও প্রবীণ হন। আর্থিকভাবে সচ্ছল হলে আত্মীয়স্বজন সেবাদানকারী নিয়োগ দেন। আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানসিক প্রতিবন্ধী প্রবীণ সীমাহীন দুর্ভোগ আর নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। প্রবীণ জীবনের শেষের দিনগুলো অর্থাৎ ৭০ বছরের পর থেকেই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ আসতে শুরু করে। প্রথম আসে আর্থিক চ্যালেঞ্জ, এরপরই আসে নিঃসঙ্গতা। নিঃসঙ্গতা থেকে প্রবীণ শারীরিক মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারও সঙ্গে দুদ- কথা বলার সুযোগ নেই। সুখ-দুঃখের কথা শুনতে চায় না। নানা অজুহাতে প্রায় সবাই এড়িয়ে যান। বয়সের ও অভিজ্ঞতার কারণে প্রবীণ ব্যক্তিরা কিছুটা বেশি বলেন। এটাকে অনেকেই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেন না। তারা প্রবীণ প্যাঁচাল শুনতে বিরক্তবোধ করে এবং অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে। প্রবীণ জীবনের শেষ দিনগুলোতে আর্থিক, সামাজিক, শারীরিক, মানসিক শক্তি অনেক বেশি দুর্বল থাকে। ফলে সংসারে-সমাজে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। প্রবীণ বয়সে দুটি বিষয়ে বেশি নিঃসঙ্গতা সৃষ্টি হয়। একটি হলো স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হওয়া, আরেকটি হলো ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। ডিমেনশিয়া হলো স্মৃতি ক্ষয়জনিত রোগ অর্থাৎ নিকট অতীতের অনেক কিছু ভুলে যাওয়া, যেমন চেনা পথ হারিয়ে ফেলা, ছেলেমেয়েদের নাম ভুলে যাওয়া, উদ্যম হারিয়ে ফেলা ইত্যাদি। তাদের সঙ্গে সঙ্গ দিতে অনেকেই আগ্রহবোধ করেন না।

তারা সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন। ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বৃদ্ধবয়সের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য প্রবীণরা নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প করা, সেবাযতœ করা, অভিযোগ শোনা, দাবি-দাওয়া মেটানোর চেষ্টা করেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতে চেষ্টা করেন। যাদের এ সুযোগ থাকে না তারা ধর্মীয় কাজ, সামাজিক কাজ করে নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করেন। এখন সময় এসেছে প্রবীণ জীবনের নিঃসঙ্গতা কাটাতে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া। প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে ডে-কেয়ার সেন্টার, প্রবীণ ক্লাব, প্রবীণ হোটেল, বিনোদন ক্লাব তৈরি করতে হবে। প্রবীণের কর্মদক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা, সামাজিক অনাচার প্রতিরোধে প্রবীণদের সামনের কাতারে অংশ নেয়ার সুযোগ দান, ঝগড়া-বিবাদ, সম্পদের মালিকানা বণ্টন, বৈবাহিক সংকট নিরসনে প্রবীণদের দায়িত্ব প্রদানের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। প্রবীণ যত বেশি কাজেকর্মে থাকবে নিঃসঙ্গতা তত দূরে থাকবে। শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীদের উপযোগী বিনোদন অনুষ্ঠান, গান-বাজনা, ছায়াছবি তৈরি করতে হবে। এ বিশেষ প্রবীণদের সঙ্গদানে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক : সভাপতি, এজিং সাপোর্ট ফোরাম; ট্রেজারার, বাংলাদেশ জেরাটলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএ)।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়