প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২২, ০০:০০
আদিকালে প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য গাছের ছাল, পশুর চামড়া দিয়ে মানুষ শরীর ঢেকে রাখতো। মানুষ কাপড় তৈরি করা শিখে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার প্রথা চালু করে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে পোশাকের ধরন পাল্টে যায়। পোশাককে আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন করতে রং এবং নকশার পরিবর্তন ঘটে। কর্মক্ষেত্রে ইউনিফর্ম, পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশে নানান রকমের পোশাক পরিধান করে থাকে। পোশাক মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলে এবং একজন মানুষকে স্বস্তি ও নিরাপত্তা দেয়। বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া, প্রথা, রুচি-সংস্কৃতি ভেদে পোশাকের তারতম্য ঘটে থাকে।
আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের চাহিদা রুচি, সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগেও অনেকেই এক-দুটো শার্ট-প্যান্ট বা পাজামা-পাঞ্জাবি দিয়ে স্কুল-কলেজ পার করে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে প্রচ- শীতে কাঁথা ও গায়ের চাদরই ছিলো ভরসা। আগুনের পাতিল, চুলার আগুন, খড়-কুটো দিয়ে উন্মুক্ত স্থানে আগুন জ্বালিয়ে সাধারণ মানুষ শীত নিবারণের চেষ্টা করতো। এখন পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। শীতকাল ছোট হয়েছে এবং বেশিরভাগ মানুষের শীত বস্ত্র রয়েছে।
মানুষের চাহিদাকে সামনে রেখে পোশাকের রং নকশা তৈরি করা হয়। বেশিরভাগ পোশাকের ক্রেতা শিশু কিশোর, যুবক, যুবতীরা। তাই তাদের সেই চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হয়। চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। পোশাকের সাথে গয়না-ঘাটি, চুল, ঘড়ি, জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, সাজগোজ সবকিছুকে একত্রে ফ্যাশন বলে।
সামাজিক বড় অনুষ্ঠানে যেমন ঈদ, পূজা, বড়দিন, নববর্ষে মানুষ হাল ফ্যাশনের পোশাক-পরিচ্ছদ কেনে। শিশু-কিশোর, যুবকদের পোশাক-পরিচ্ছদের ক্রেতা বেশি থাকায় বিক্রেতা চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হয়।
আমাদের সমাজ শুধুমাত্র শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
যখন মানুষ ষাট বছর অতিক্রম করে প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে তখন তার গুরুত্ব আস্তে আস্তে কমতে থাকে। কর্মক্ষেত্রে অনিয়মিত এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কম থাকায় পোশাক ও সাজগোজের প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষের হাতে পছন্দের পোশাক কেনার টাকা হাতে থাকে না। এতে করে অনেকে পোশাকের জন্য পরিবারের ওপর নির্ভর করে।
আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হলো প্রবীণরা হাল্কা রঙের কাপড় পরবেন। বিশেষ করে সাদা, হালকা গোলাপী, ক্রিম, অফ হোয়াইট, ছাই রঙের অনুজ্জ্বল কাপড় পরতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে মানুষ অনেক বেশি ধর্ম-কর্মে মন দেন। ফলে প্রবীণদের মধ্যে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করার মনোভাব বেশি করে তৈরি হয়।
আমাদের সমাজ ঠিক করে দিয়েছে কোন্ বয়সে কোন ধরনের কাপড়-চোপড় পরতে হয়। এই নিয়মের বাইরে গেলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। একজন বয়স্ক মানুষ যদি উজ্জ্বল রঙের কোন্ পোশাক পরিধান করেন তখন অন্যরা বলবে, আপনার এই বয়সে এসব মানায় না। রঙিন জামা, জুতা, ঘড়ি, স্যুট পরার ইচ্ছা হলেও সমাজের সমালোচনার ভয়ে চুপসে যায়।
মোট কথা প্রবীণের পোশাকের ক্ষেত্রে একটা মরাল পুলিশিং ব্যবস্থা স্বংক্রিয়ভাবে চালু রয়েছে। প্রবীণের পোশাক কেমন হবে তা সব পর্যায়ের মানুষের ধারণা রয়েছে। কেউ কাপড়ের দোকানে গিয়ে কাপড় চাইলে বিক্রেতা জিগ্যেস করে, কার জন্য নিবেন এবং বয়স কেমন?
ক্রেতা যদি বলে মায়ের জন্য কিংবা শাশুড়ির জন্য, তখনই বিক্রেতা হালকা রঙের কাপড়-চোপড় বের করতে শুরু করবে। যদি ক্রেতা বলে, আমার দাদা, দাদি, নানা, নানির জন্য কিনবো তখন বিক্রেতা ক্রেতার মুখের দিকে চেয়ে দাদা নানার বয়স আন্দাজ করতে চেষ্টা করে। তারপরেই সাদা, ক্রিম, অফহোয়াইট কালারের কাপড়-চোপড় দেখাতে শুরু করবে। রঙিন জামা কাপড় নিতে প্রবীণ নিজেও লোকলজ্জা এবং সমাজের ভয়ে চুপসে যান। নাতি, নাতনি, ছেলে, মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনের মুচকি হাসি, ঠাট্টা মসকরা প্রবীণকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে।
ফলে মনের মধ্যে রঙিন পোশাক কিংবা পছন্দের জুতা পরার শখ থাকলেও বাস্তবে রূপ দেয়া কঠিন হয়ে যায়।
ধর্মীয় দিক থেকে সাদা পোশাক পরিধান করার একটা মনোভাব কিংবা তাগিদ থেকেও অনেকে সাদা পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে যান। মৃত্যুর পর সাদা কাফন পরিয়ে অন্তিম যাত্রা হবে এই ভাবনা থেকে কেউ কেউ সাদা কাপড়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন।
প্রবীণরা ঘড়ি পরিবর্তন করতে তেমন একটা আগ্রহী হন না। ঘড়ি মেরামত করে বছরের পর বছর ব্যবহার করেন। নতুন ডায়াল, নতুন মডেল, ফিতা চেইন কিংবা, হাল ফ্যাশনের ঘড়ির প্রতি অনাগ্রহ দেখান।
সবচেয়ে বেশি অমনোযোগী হন জুতা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে। জুতা না ছেঁড়া পর্যন্ত জুতা ফেলে দিতে চান না। জুতা দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে জুতার সেপ নষ্ট হয়ে যায়। জুতার সোল নষ্ট হয়ে যায় অথবা জুতার একপাশে বেশি ক্ষয় হয়ে যায়। এরকম জুতা ব্যবহার করলে পায়ে মেছ পড়ে যায় কিংবা পায়ের তালু শক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে জুতা পরিবর্তন না করলে পায়ের ক্ষতি হয়। জুতার ভেতরে ভেজা থাকলে পায়ে ক্ষত সৃষ্টি করবে। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগীর জন্য এটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবীণরা কোথাও কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় ভালো মানের জুতা পরেন। বেশিরভাগ সময়ই অল্প দূরে কিংবা হাট বাজারে ঘরে পরার সেন্ডেল পায়ে দিয়ে চলে যান। জুতা চুরি হবার ভয়ে মানহীন উঁচু নিচু জুতা পরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হাজির হন। তাই প্রবীণদের কয়েক জোড়া জুতা থাকা উচিত।
প্রবীণদের হালকা ভালো মানের নরম জুতা পরা খুবই জরুরি। এতে করে পায়ের যতœ হবে, ফ্যাশন হবে, হাঁটতে চলতে আরাম লাগবে।
প্রবীণদের বেশিরভাগই চশমা পরেন। তারা ফ্রেম বা গ্লাস পরিবর্তন করতে তেমন আগ্রহ করেন না। ভালো ফ্রেম নতুন ডিজাইন প্রবীণদের মনে আনন্দের সৃষ্টি করে। একই ফ্রেম বছরের বছর ব্যবহার স্বাস্থ্য সম্মত নয়। অন্ততঃ দুই জোড়া চশমা থাকা ভালো। ভালো চশমা ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করে।
হাত-পায়ের যতেœ লোশান, ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। এতে করে হাত পা মসৃণ থাকবে। চুলের যতেœ বেশি শ্যাম্পু ব্যবহার না করা এবং বেশি ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে গোসল না করাই ভালো।
প্রবীণ যতবেশি বাইরে বের হবে ততবেশি ফ্যাশন সচেতন হবে। বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। একেক দিন একেক ধরনের পোশাক, জুতা, ঘড়ি, ছাতা, লাঠি নিয়ে বের হলে বেশি আনন্দ পাবে। সামাজিক কাজে বেশি অংশগ্রহণ করলে সমাজে বেশি মর্যাদা পাবে। মানুষের শ্রদ্ধার ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠলে জীবনকে সার্থক মনে করতে শুরু করবে। প্রবীণের ফ্যাশন মানে জীবন সম্পর্কে গভীর আগ্রহ তৈরি হওয়া। প্রবীণ নিজকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে জীবন সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি তৈরি করতে পারবে। হতাশা, অভিযোগ, আক্ষেপ, নালিশ করা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পারবেন। জীবনকে উপভোগ করার প্রেরণা পাবেন। সুস্থ দীর্ঘ জীবন-ই মানুষ মানুষের কাম্য। নেতিবাচক ধারণা পুষতে পুষতে মানুষ জীবন সম্পর্কে সকল আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক সময় বিষণœতা তাকে গ্রাস করে ফেলে। পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে।
প্রবীণরা ফ্যাশন সচেতন হলে জীবনকে উপভোগ করতে পারবে। তরুণ প্রজন্মের নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা ধরতে পারবে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর নানান রকমের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিজেকে এগিয়ে নিতে পারবে। নিজের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে প্রযুক্তির হাত ধরে সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবেন। মনে রাখতে হবে প্রবীণের ফ্যাশন মানে সক্রিয় বার্ধক্য।
হাসান আলী : প্রবীণ বিষয়ক লেখক ও সমাজকর্মী