রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ফারুক সুমন

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস পরম্পরায় যে ক’টি ঐতিহাসিক ঘটনা বিশেষ গুরুত্বের সাথে সুচিহ্নিত হয়ে থাকে, ভাষা-আন্দোলন তন্মধ্যে একটি। মূলত ভাষার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম সচেতন ও সক্রিয় প্রতিবাদ ছিল ভাষা-আন্দোলন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ইতিহাসের প্রত্যক্ষদর্শী। কেবল প্রত্যক্ষদর্শী নয়, ছিলেন দাবি আদায়ের অগ্রগামী নেতা। বঙ্গবন্ধু তাঁর দূরদর্শিতা দ্বারা আন্দাজ করতে পেরেছেন যে, বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কিছুতেই আপোষ করা যাবে না। ফলে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ২১ দফা দাবি নিয়ে সর্বপ্রথম যে ইস্তেহার প্রণীত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু নির্দ্বিধায় উক্ত ইস্তিহারের সপক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। সেসময়ের সক্রিয় রাজনীতিবিদসহ মোট ১৪ জন ভাষাসংগ্রামী এই ২১ দফা দাবি সম্বলিত ইস্তেহার পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। পুস্তিকাটির নাম ‘রাষ্ট্র্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রসঙ্গে। এই পুস্তিকাটি স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রতিবাদের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে স্বীকৃত। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের ভাষ্যমতে : ‘পাকিস্তান সৃষ্টির তিন-চার মাসের মধ্যেই পুস্তিকাটির প্রকাশনা ও প্রচার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের জন্য পাকিস্তান নামের স্বপ্ন সম্পৃক্ত মোহভঙ্গের সূচনার প্রমাণ বহন করে। পুস্তিকাটি যাদের নামে প্রচারিত হয়েছিল তারা সবাই অতীতে ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী।

উল্লেখ্য, এদেরই একজন ছিলেন ফরিদপুরের (বর্তমানে গোপালগঞ্জ) শেখ মুজিবুর রহমান; পরবর্তীকালে যিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’ (রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল, শায়খুল বারী, পুনঃপ্রকাশ জানয়ারি ২০০২)।

ভাষা-আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অংশগ্রহণ একজন সময়সচেতন নেতার দূরদর্শিতাকে প্রমাণ করে। ১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুব কর্মীদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু সেই সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানান। এভাবে ভাষা-আন্দোলনের সাথে বঙ্গবন্ধু নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন বৈরী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে তিনি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব দেন। যার ফলে ১৯৪৮-এর ২ মার্চ ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ মার্চ তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব তৎকালীন পাকিস্তানী স্বৈরশাসকের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে তারা বারবার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। তবুও তিনি দমে যাননি। এদেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তাঁর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য ও লেখায় এ কথা অসংখ্যবার উচ্চারিত হতে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নীতি ও আদর্শের প্রতি অটল ছিলেন। অন্যায়ের কাছে মাথানত করেন নি বলেই ১৫ মার্চ তারিখে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর আপসহীন মনোভঙ্গি তাঁকে অন্য অনেক নেতার থেকে আলাদা করেছে। মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তাঁর মতো উৎসর্গিকৃত মনোভাব খুব মানুষের মাঝে দেখা যায়।

কেবল ইতিহাসের পৃষ্ঠা নয়, বঙ্গবন্ধু তাঁর জবানিতে লিখে গেছেন ভাষা-আন্দোলনের মর্মন্তুদ ঘটনাবলি।

১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি থাকাকালীন নিকটজনের অনুরোধে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : ‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, তোমার জীবনী লেখ’। সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলি লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী।’ বললাম, ‘লিখতে যে পারি না; আর এমন কি করেছি যা লেখা যায়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ০১]

এভাবেই বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের কথাগুলো লিখতে প্রণোদিত হয়েছেন। যেখানে যৌবনের উন্মাতাল রাজনৈতিক দিনগুলোর স্মৃতি অত্যন্ত মর্মবিদারী ভাষায় স্থান পেয়েছে। বার বার কারাবরণের দুঃসহ স্মৃতিলেখা পড়ে আমাদের মন খারাপ হয়। তাঁর এই আত্মজীবনী গ্রন্থটি বৈরী সময়ের কারণে প্রকাশহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। ২০১২ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।

১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে করাচিতে অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক। যেখানে রাষ্ট্রভাষা কী হবে এই নিয়ে আলোচনা হয়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারটি উত্থাপিত হলে কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিরোধিতা করেন। তিনি সংখ্যাগুরুর বিবেচনায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ এবং ‘তমদ্দুন মজলিস’ বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব দেয়। এই লক্ষে তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। তরুণ বঙ্গবন্ধু তখন সক্রিয়ভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেন। তাঁর ভাষায় : ‘সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস ঘোষণা করা হল। জেলায় জেলায় আমরা বের হয়ে পড়লাম। আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করে ঐ তারিখের তিন দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম।...রাতে কাজ ভাগ হল। কে কোথায় থাকব এবং কে কোথায় পিকেটিং করার ভার নেব। সামান্য কিছু সংখ্যক বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়া শতকরা নব্বই ভাগ ছাত্র এই আন্দোলনে যোগদান করল।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৯২] ১৯৪৮-এর এই দিন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর অপর আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন: ‘প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শাসমুল হক সাহেবসহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আবদুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।’ [কারাগারের রোজনামচা, বাংলা একাডেমি, পৃ ২০৬]

১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় আয়োজিত এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে করা মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে : ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলো। মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করলেন। সংশোধনীগুলো গৃহীত হলো এবং অলি আহাদের মাধ্যমে তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলো।’ [তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮, প্রথম খ-, পৃ. ২৩০] এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্য : ‘১৬ই মার্চ আবার বিশ^বিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকালে আইনসভার সামনে লাঠিচার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে।’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২০৬]

ভাষা-আন্দোলন ছাড়াও পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন অন্যায্য সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে ফরিদপুরের কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার দায়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু তাই নয়, ১৯৪৯-এর ৩ মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবির সপক্ষে দেয়া ধর্মঘটকে বঙ্গবন্ধু সমর্থন জানান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিশ^বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ অযৌক্তিকভাবে তাঁকে জরিমানা করে। ২০ এপ্রিল তারিখে তাকে গ্রেফতার করে।

১৯৫২ সালে ভাষা-আন্দোলনের সময়পর্বে বঙ্গবন্ধু একজন উদীয়মান ছাত্রনেতা। তাঁর বয়স তখন ত্রিশের আশেপাশে হবে। তারুণ্যে উদ্দীপিত বঙ্গবন্ধু তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অপশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। বিনাবিচারে রাজবন্দিদের কারাগারে বন্দি রাখার প্রতিবাদে অনশন ধর্মঘট করেন। কারণ বিনাবিচারে ছাব্বিশ-সাতাশ মাস তাঁকে জেলে রাখা হয়েছে। বন্দি অবস্থায় এখন তাঁকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। ‘রাষ্ট্র-ভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সিদ্ধান্ত হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাথে জেলে থাকা মহিউদ্দিনকে সাথে নিয়ে জেলখানায় অনশন করবেন বলে মনস্থির করলেন। ১৯৫২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে বঙ্গবন্ধু কারাগারে অনশন শুরু করেন। এমতাবস্থায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে সরকার-বাহিনী গুলি চালায়। এতে শহীদ হন সালাম, রফিক, বরকত-সহ অনেকে। বঙ্গবন্ধু তখন জেলে অনশনরত অবস্থায় থেকেও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় : ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটালাম, রাতে সিপাহীরা ডিউটিতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কয়েকজন লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। রেডিওর খবর। ফরিদপুরে হরতাল হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে জেলগেটে এসেছিল। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’, আরো অনেক স্লোগান। আমার খুব খারাপ লাগল। কারণ, ফরিদপুর জেলা মহিউদ্দিনের নামে কোনো স্লোগান দিচ্ছে না কেন? শুধু ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ বললেই তো হত।.....মাতৃভাষা আন্দোলনে পৃথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরাই রক্ত দিল। দুনিয়ার কোথাও ভাষা- আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২০৩]

উনশশ’ পঁচাত্তর পরবর্তী সময়পর্বে ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে কেউ কেউ নিঃস্পৃহ মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে দেখানোর প্রবণতা দেখা যায়। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকারের শামিল। মজার ব্যাপার এই, একুশ-শতকে এসে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধুর অবদান দিবালোকের ন্যায় সবার কাছে খোলসা হয়ে যায়। কারণ এ দু’টি গ্রন্থে ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর সক্রিয় অশগ্রহণ স্পষ্ট হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, প্রখ্যাত লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষ্যে ভাষা-আন্দোলন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরক্তির কথা জানা যায়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে অন্নদাশঙ্করসহ অনেকেই ঢাকায় এসেছিলেন। কথাবার্তার একপর্যায়ে ‘বাংলাদেশের আইডিয়া তাঁর মাথায় কীভাবে এলো?’ এই মর্মে প্রশ্ন করা হলে জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন: ‘... ‘শুনবেন?’ তিনি (বঙ্গবন্ধু) মুচকি হেসে বললেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে। আমি সুহরবর্দী (সোহরাওয়ার্দী) সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালীর এক দেশ।... দিল্লী থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সুহরাবর্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজী নয় তাঁদের প্রস্তাবে।... তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সোনার বাংলা।... হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলাভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞেস করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না বাংলাদেশ। তারপর আমি শ্লোগান দিই, ‘জয়বাংলা’।...‘জয় বাংলা’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয় বা সাম্প্রদায়িতকার উর্ধ্বে।’’ [ মুনতাসীর মামুন/‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’, মাওলা ব্রাদার্স]

ভাষা-আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গবন্ধু জেলে অনশনরত অবস্থায় অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও অনশন অব্যাহত রেখেছিলেন। মৃত্যু অবধারিত জেনেও তিনি সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। প্রতিবাদ থেকে সরে আসেননি। একজন মহান নেতার ঔদার্যে অবিচল থেকে দেশ ও জাতির কথা ভেবেছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় : ‘আমাদের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ-সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। কিছু সময় পর আবার ফিরে এসে বললেন, ‘এভাবে মৃত্যুবরণ করে কি কোন লাভ হবে? বাংলাদেশ যে আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করে।’ আমার কথা বলতে কষ্ট হয়, আস্তে আস্তে বললাম, ‘অনেক লোক আছে। কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তাদের জন্যই জীবন দিতে পারলাম, এই শান্তি।’ ডেপুটি জেলার সাহেব বললেন, ‘কাউকেও খবর দিতে হবে কিনা? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোন টেলিগ্রাম করবেন?’ বললাম, ‘দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাইনা।’ আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। হার্টের দুর্বলতা না থাকলে এত তাড়াতাড়ি দুর্বল হয়ে পড়তাম না। একজন কয়টি ছিল, আমার হাত-পায়ে সরিষার তেল গরম করে মালিশ করতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ পৃ.২০৪]

দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়, বঙ্গবন্ধু বয়সে তরুণ হয়েও অনুধাবন করেছেন ভাষা-আন্দোলনের তাৎপর্য। ফলে মাতৃভাষাকেন্দ্রিক প্রতিবাদের মধ্যেই যে লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। এই বোধ ও বিশ^াস ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তৎকালীন তরুণ প্রজন্মের কাছে। যারা পরবর্তীসময়ে আরও বেশি পরিণত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছেন। মাতৃভাষা বাংলার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ ভালোবাসা সবসময় ছিলো। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণেও অন্য অনেক প্রসঙ্গের সাথে বাংলাভাষার কথা ভুলে যাননি। তাঁর ভাষায় :

‘...আপনারা আরও জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী এবং ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস অনুসারে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ভাষা-আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। সেসময় জেলে গিয়েও তিনি উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রসমাজের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ভাষা-আন্দোলনের ভেতর তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। ফলে উত্তরকালে তিনিই হয়েছেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : ফারুক সুমন, কবি ও প্রাবন্ধিক

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়