প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
মানুষের মূক মুখে ভাষার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু হয়েছে তার সঠিক হদিস না পেলেও আজকালকার যুগে ভাষাহীন মানুষের অস্তিত্ব অকল্পনীয় এবং অসম্ভব। ভাষা কেবল একে অন্যের সাথে যোগাযোগই স্থাপন করায় না, ভাষা নিজের সাথে নিজের, সৃষ্টির সাথে ¯্রষ্টার, পরম করুণাময়ের সাথে করুণাপ্রার্থীরও সংযোগ ঘটায়। যদি মানুষের মুখে কোনো ভাষা না থাকতো, তবে মানুষ কী রূপে চিন্তা করতো তা অভাবনীয়। ভাষাহীন ব্যক্তি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে কীভাবে আশিস ও সহযোগিতা প্রার্থনা করতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নৃবিজ্ঞানীরা মানুষের মাথার খুলি হতে ভাষার বয়স নিরূপণে সচেষ্ট হলেও আদিম মানুষ বা প্রথম ভাষা উৎপাদনকারী মানুষের মাথার খুলি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি বিধায় ভাষার উৎপত্তির সঠিক বয়স নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে এ কথা পরিষ্কার যে, লিখিত ভাষার বয়স পাঁচ হাজার বা তার কিছু বেশি হলেও মুখের ভাষার বয়স বিশ হতে আশি লক্ষ বছরের কম নয়। ভাষার উৎপত্তি অধ্যয়নে প্রয়াসী প্রকৌশলীর সন্ধান মোতাবেক প্রাথমিক ভাষাদের একটির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, যার সর্বমোট শব্দসংখ্যা তিনশটি এবং অতি ক্ষুদ্র এক নৃগোষ্ঠীই এর ব্যবহারকারী। ভাষার উৎপাদনে ব্যবহৃত ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির উন্নত স্বরযন্ত্র নিয়েন্ডার্থাল পর্যায়ের স্যাপিয়েন্সেরও ছিলো না। কাজেই ভাষার উদ্ভব কোটি বছরের প্রাচীন নয়।
বাংলা ভাষার উদ্ভব অধ্যয়নে ভাষাবিজ্ঞানী মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহদের শ্রমকে প্রাতঃস্মরণীয় বলে মেনে নিয়ে বলা যায়, বাংলা ভাষার উদ্ভব আড়াই হাজারের বেশি পূর্বে নয়। বাংলা ভাষার আদি জননী ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা, আর এ কারণেই স্কটিশ, আইরিশ, ফরাসীÑএই ভাষাগুলি আমাদের ভাষাগত দূর সম্পর্কীয় বোনের মতো। ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষা হতে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার সিঁড়ি ধরে পালি-মাগধী-প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে আমাদের মুখের ভাষা আজকের বাংলা ভাষা হয়ে ওঠে। হাজার বছরের প্রাচীন চর্যাপদের সান্ধ্য ভাষার রূপকে পরিত্যাগ করে আজকের আধুনিক বাংলায় আসতে আমাদের অনেক বিবর্তন মেনে নিতে হয়েছে।
কিন্তু শত বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলা ভাষাকে পশ্চিমারা সাম্প্রদায়িকতার কালিমা লেপন করে এর অনন্য গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা বলে যে অপপ্রচার সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান সূচনা করেছিল, তাতে ছিলো এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। কেননা, তারা চেয়েছিল, উর্দুই তাদের রাষ্ট্রভাষা হবে। অথচ সদ্যোজাত পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগের মুখের ভাষা হলো বাংলা। এই ষড়যন্ত্র কেবল যে পাকিস্তানের সূচনালগ্নেই চালু হয়েছিল তা নয়। মধ্যযুগেই বরং বাংলা ভাষার প্রতি এই আক্রমণ দানা বাঁধতে শুরু করে।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, বাংলা ভাষার জন্ম হয় সপ্তদশ শতকের শেষে যার আঁতুরঘর ছিলো পালযুগের বৌদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল রাজদরবার হতে ঊনিশশো তের সালে চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কার করে সে সত্য প্রমাণ করেন। কিন্তু পালযুগের সমৃদ্ধ সময়কে অতীত করে যখন সেন রাজত্ব শুরু হলো বাংলায়, তখনই ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান হলো এবং রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার পরিবর্তে সংস্কৃতকে রাজ্যের মূল ভাষার অধিকার দেয়ার পাঁয়তারা হলো। তারা শ্লোকের অবতারণা করলো এই মর্মে যে, বাংলাভাষায় ধর্মাচরণ করলে রৌরব নরকে পতন অনিবার্য। কিন্তু বাংলামায়ের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। মুসলিম শাসকরা মসনদে এসে বাংলায় মঙ্গলকাব্য রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া শুরু করলেন। সংস্কৃত হতে বাংলায় অনুবাদেও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মধ্যযুগেই আরবী ভাষায় ধর্মচর্চার বাধ্যবাধকতা থাকায় বাংলাভাষা গৌণ হয়ে যেতে থাকে। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার ওপর চাপানো হয় হিন্দুয়ানী অপবাদ। এসময় আবারো উদার মুসলিম কবিসাহিত্যিক বাংলা ভাষার পুনর্জাগরণে এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের সীতাকু-ের কবি শাহ্ পরাণ ও তাঁর ছেলে শেখ মুত্তালিব, সন্দ্বীপের আব্দুল হাকিম, কবি মুজাম্মিল উল্লেখযোগ্য। শেখ মুত্তালিবের কবিতা,
‘আরবীতে সকলে না বুঝে ভালোমন্দ
তেকারণে দেশীভাষে রচিলুঁ প্রবন্ধ।
মুসলমানি শাস্ত্রকথা বাঙ্গালা করিলুঁ
বহু পাপ হৈল মোর নিশ্চয়ই জানিলুঁ।’Ñহতে আমরা বুঝে নিতে পারি, মধ্যযুগে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে কী ষড়যন্ত্র চলছিল। কবি মুজাম্মিলের পংক্তিমালা,
‘আরবি ভাষার লোকেঁ ন বুঝে কারণ
সভানে বুঝিবে কৈলুঁ পয়ার বচন।।
যে বলে বলৌক লোকেঁ করিলুঁং লিখন
ভালে ভাল মন্দে মন্দ ন খএ খ-ন।।’ সে ধারণাকে আরো পোক্ত করে তোলে। ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার কবি আব্দুল হাকিম এই ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে সরাসরি বলেন,
‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষে বিদ্যা যার মনে ন যুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়?’
কবি-সাহিত্যিকের কলমের সংগ্রাম মধ্যযুগের ভাষার রণে বাংলাকে জিতিয়ে দিয়ে চলে আসে সাহিত্যের অন্ধকার যুগ পেরিয়ে মাইকেল মধুসূদনের কাছে। মধুসূন উচ্চাভিলাষের মেকি অমৃত পান করে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়ে শেষমেষ ‘ঈধঢ়ঃরাব খধফু’ তে পরাজিত হয়ে রচনা করেন অনুতাপমুখি কবিতা। আমরা পাই ভাষাপ্রেম ও স্বদেশের এক কালজয়ী কবিতা। এ কবিতা হয়ে ওঠে আধুনিক ভাষাপ্রেম ও স্বদেশের অজর-অক্ষয় সনদ। আমরাও আউড়ে যাই তার সাথে,
‘হে বঙ্গভা-ারে তব বিবিধ রতন
তা সবে, (অবোধ আমি) অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।’
বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় ব্রতী হয়ে আত্মপরিচয় ভুলতে বসা কবি মাইকেল মধুসূদন ফিরে পান মাতৃসুধা। কৃতজ্ঞ চিত্তে মাইকেল বলে ওঠেন,
‘পালিলাম আজ্ঞা সুখে ; পাইলাম কালে
মাতৃভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মায়াজালে।’
তার পাশাপাশি বাংলাকে শিশু শিক্ষার বাহন হিসেবে বিস্তৃত করার প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংগ্রামের কথা উল্লেখ করতেই হয়। তাঁর বর্ণপরিচয়ের মাধ্যমে বর্ণমালা শিক্ষণ প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে চলে এসেছে। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরে ব্রাহ্ম আন্দোলনের প্রবক্তা কেশব সেনের ভূমিকাও বাংলা ভাষার চর্চার প্রসারে অনন্য। ধর্মের বিধিবিধান ও জগৎকল্যাণকে বাঙালির মনোগভীরে সঞ্চারণের জন্যে তিনি পবিত্র কোরান, গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেলের বঙ্গানুবাদ করিয়ে নেন। গিরিশ চন্দ্র সেনের বাংলায় কোরান অনুবাদ আজও মাতৃভাষায় ধর্ম চর্চার পথে এক অনুকরণীয় বিপ্লব। এর পাশাপাশি বলতে হয়, বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে জগদ্বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বোস, কুদরত-ই খুদা, আব্দুল্লাহ্ আল মুতী শরফুদ্দিন, অধ্যাপক আলী আসগর, অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর প্রয়াস ও অবদান শ্রদ্ধাভরে স্মরণযোগ্য। এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলা ভাষার আন্দোলনে তাঁরাও মেধাবী সংগ্রামী যোদ্ধা।
মাতৃভাষাকে সাম্প্রদায়িকতার কবল হতে বাইরে আনতে অতুল প্রসাদ উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
‘মোদের গরব মোদের আশা
আ-মরি বাংলা ভাষা।
তোমার কোলে,
তোমার বোলে,
কতই শান্তি ভালোবাসা।’
বাংলা ভাষার ওপর হিন্দু-মুসলিম আগ্রাসনকে এড়িয়ে ভাষা যখন তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন এলো পর্তুগীজ ও ফিরিঙ্গি বেনিয়াদের নিজস্ব নকশায় বাংলাকরণ প্রক্রিয়া। বাংলা এ সময় কী ধরনের চাপ সহ্য করছিল তা সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চুটকি হতেই পরিষ্কার বুঝা যায়। ইংরেজ পরীক্ষকের কাছে আদিষ্ট হয়ে ‘আপদ’ আর ‘বিপদ’-এর পার্থক্য বুঝাতে গিয়ে বঙ্কিম বাবু ইংরেজদের হাতে বাংলাকে বিকৃত হতে দেখার বেদনা প্রকাশ করেন। ঠিক এ কারণেই 'ঢাকা' ইংরেজদের কাছে হয়ে ওঠে ‘ডাক্কা’ (উধপপধ), ‘বগুড়া’ হয়ে যায় ‘বোগরা’ (ইড়মৎধ)। বাঙালির বাংলাকে ইংরেজ কবল হতে রক্ষা করতে না করতেই বাংলা অপদস্থ হতে শুরু করে নব্য পাকিস্তানীদের হাতে। এ দুঃখকে কণ্ঠে ধারণ করে পুঁথিপাঠক আব্দুল লতিফ গেয়ে ওঠেন অগ্নিবাহী দ্রোহে,
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার দুটি পায়’।
বাঙালির ভাষার জন্যে যে আন্দোলন, তা যেন আবহমান কালের। বাংলা ভাষার আদি ও মধ্যযুগে হয়তো বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার মৌলিকতা রক্ষার জন্যে রাজপথে আন্দোলন হয়নি। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকের কলমে এ আন্দোলন সতত প্রবহমান ছিল। ফল্গুধারার মতো প্রবহমান সে আন্দোলন রাজপথে প্রথমবারের মতো উঠে আসে দেশ বিভাগোত্তর ঊনিশশো আটচল্লিশ সালে, যখন পাকিস্তানের গভর্নর চতুর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের গণপরিষদ সদস্য বাঙালি বীর সন্তান ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের অধিবেশনে উপর্যুপরি তিনবার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন এবং কোন না কোন উছিলায় এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার আন্দোলনের প্রথম অংশে ঊনিশশো আটচল্লিশের এগার মার্চ রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এ সময় বাঙালির হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, সে সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিব নিজেই রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন ও স্বৈরাচারী গোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। জিন্নাহর মৃত্যুর পর আন্দোলন স্তিমিত হলেও ঊনিশশো বায়ান্ন সালে এসে খাজা নাজিমউদ্দীন ও লিয়াকত আলীর তৎপরতায় আবারো উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারা শুরু হলে ছাত্রআন্দোলন আবারো তীব্র রূপ অর্জন করে এবং এ সময় সাধারণ জনতা ছাত্রদের সাথে যোগ দেয়ায় আন্দোলনের শক্তি কার্যকারিতা অর্জন করে। রাজনৈতিক কারণে কারাগারে আটক শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সহবন্দি মহিউদ্দিন আহমদসহ ষোল ফেব্রুয়ারি হতে টানা বারো দিনের অনশন শুরু করেন। কারাবন্দিকালীন মুজিব হাসপাতালের সিকবেডের আশ্রয় নিয়ে ভাষা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে পরামর্শ দিতেন।
ঊনিশশো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ছিলো পাকিস্তান প্রাদেশিক গণপরিষদের অধিবেশন। একে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এই কর্মসূচির ঘোষণায় পাকিস্তানী স্বৈরাচার আঠার ফেব্রুয়ারি হতে তার নিজস্ব আওতায় ছাত্রসংগ্রামের কর্মসূচিস্থলে একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে। বাঙালি ছাত্র-জনতা সেদিন নান্দনিক সাহসে ও দ্রোহে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙেছিল বলেই আমরা আজ রক্তগাঙের বানে পেয়ে গেছি আমাদের মায়ের ভাষার মান।
আমাদের সেই ভাষা আন্দোলনের আজ সত্তর বছর অতিক্রম হতে চলেছে। আজও আমরা জানি না ঠিক কতজন সেদিন পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। রাষ্ট্র একুশে পদক দিয়েছে ভাষা শহীদদের, যেখানে পাঁচজন ভাষা শহীদকে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু একুশের প্রথম কবিতার কবির কলমে সেদিন চল্লিশজন শহীদ হয়েছিলেন বলে পংক্তিবদ্ধ হয়েছে। পরের দিনের সংবাদপত্রগুলোর কোনটা ছাব্বিশজন আর কোনটা ষোলজনের কথা উল্লেখ করেছিল। কোন কোন পত্রিকায় বারোজন শহীদের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বাঙালির তাজ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের ডায়েরি মোতাবেক সেদিন নয়জন ভাষার জন্যে শহীদ হয়েছিল বলে লিপিবদ্ধ আছে। ভাষা শহীদের সংখ্যার এ দ্বন্দ্ব যদি আজও মীমাংসা করা না যায় তবে ভবিষ্যতের ইতিহাস বিতর্কিত হয়েই আবর্তিত হবে।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের পরিণামে অসমীয়রাও ভাষার জন্যে আন্দোলনে এগিয়ে আসে। ঊনিশশো একষট্টি সালের মে মাসে আসামের বরাক উপত্যকার ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হওয়ার ঘটনা ঘটে। বাংলাকে এড়িয়ে সকল সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে অসমীয়া ভাষাকে চালু করার প্রজ্ঞাপন জারি হলে আসামের বাংলাভাষীদের মধ্যে দ্রোহের সঞ্চার হয়, যা তাদের শহীদ হওয়ার শক্তি জাগায়।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী ফল হিসেবে ঊনিশশো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজশাহীতে শহীদ মিনার গড়ে ওঠে যা মাত্র তিনঘন্টা স্থায়ী ছিল। পুলিশের হামলায় তা ভাঙা হয়। বাহান্ন সালের তেইশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাতারাতি গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যার নকশা করেন সাঈদ হায়দার। কিন্তু এটার আয়ুও তিন দিনের বেশি স্থায়ী হলো না। এর পরে ঊনিশশো তিপ্পান্ন সালে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয় যার সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান। এতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত একুশের সেই কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’Ñপ্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। এর পাশাপাশি তোফাজ্জল হোসেনের একুশের গানটিও স্থান পেয়েছিল যার প্রথম দুই কলি ছিল, ‘রক্ত শপথে আমরা অজিকে তোমারে স্মরণ করি, একুশে ফেব্রুয়ারি’। মহান একুশের ঐতিহাসিক প্রথম সংকলনে কবি শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, হাসান হাফিজুর রহমান, আনিস চৌধুরী, আতাউর রহমান, জামালুদ্দিনের কবিতা স্থান পেয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রথম সংকলনে ছাপা হওয়া কবিতাগুলোর কোনো শিরোনাম ছিল না।
এছাড়াও কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম এবং আতোয়ার রহমানের লেখা পাঁচটি গল্পে সংকলনটি পূর্ণতা পেয়েছিল। ‘একুশের নকশা’ নামে দুটি বিশেষ রচনা এ সংকলনে ছাপা হয়েছিল, যার একটিতে মুর্তজা বশীর লিখেছিলেন, ‘ফুঁসে ওঠা অজগরের মত বিরাট মিছিলটা কেঁপে কেঁপে আসছে। কালো কালো মাথাগুলো রোদে চকচক করছে ওর শরীরের আঁশের মত। সামনে গতকালের শহীদদের রক্তাক্ত কাপড় নিশানের মত ওড়ানো। আরেকজনের কাঁধে একটা টুকরি। অনেকগুলো খালি টিয়ার গ্যাসের খোল দিয়ে তা ভর্তি..।’ একুশের নকশার দ্বিতীয় লেখাটি লিখেছিলেন, সালেহ আহ্মদÑ‘বন্ধুগণ, একশ চুয়াল্লিশকে ভেঙে আমরা এগোতে চাই না। কিন্তু তাই বলে মনে করো না আমাদের সংগ্রাম-আমাদের জীবন এখানটাতেই থেমে গেছে।’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের ছাপচিত্র দিয়েই শুরু হওয়া একুশের প্রথম সংকলনের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। কবিরউদ্দিন আহমদের লেখা একুশের ইতিহাস দিয়েই সংকলনটি সমাপ্ত হয়।
ভাষা আন্দোলনের ফসলকে পূর্ণমাত্রায় ঘরে তুলতে যে বা যারা আগে-পরে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা উজ্জ্বলতম। ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাগে ঊনিশশো সাতচল্লিশে যুবনেতা হিসেবে বাংলা ভাষাকে অফিস-আদালতে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবিনামা পাঠ, ঊনিশশো আটচল্লিশে রাজপথে সক্রিয় আন্দোলন ও এগার মার্চের রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস সফল করার জন্যে জেলায় জেলায় গমন ও জনমত গঠন এবং গ্রেপ্তার ও নির্যাতিত হওয়া, ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় ভাগে ঊনিশশো বায়ান্ন সালে জেলবন্দি থেকে টানা বারদিন কড়া অনশনের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তীকালে ঊনিশশো বায়ান্ন সালের পহেলা অক্টোবর, নয়াচীনের অক্টোবর বিপ্লবের আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে শেখ মুজিবের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলায় ভাষণ প্রদান বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির অঙ্গীকারকে। ঊনিশশো একষট্টি সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে রেডিও পাকিস্তান কোনো অনুষ্ঠান প্রচার করেনি, অথচ সারাবিশ্ব রবীন্দ্র বন্দনায় ছিল মুখর। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র কেবলমাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের একটা অনুষ্ঠান দিয়েই দায় সারে। মূলতঃ ঊনিশশো একষট্টি থেকে ঊনিশশো একাত্তর অব্দি রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়, কারণ রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষার কবি। ১৯৬৭ সালে জুন মাসে তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহবুদ্দিন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন যে , ভবিষ্যতে রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের পরিপন্থী রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই ধরনের অন্যান্য গানের প্রচার কমিয়ে দেওয়া হবে । ঢাকার ‘ দৈনিক পকিস্তান ‘ পত্রিকায় এই খবর প্রকাশিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে এর বিরোধিতা করে বলেন, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইব, আমরা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনব। বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইলেও বঙ্গবন্ধু তা হতে দেননি। বায়ান্ন পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গণপরিষদে নয় নভেম্বর, ঊনিশশো পঞ্চান্ন সালে বাংলায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন: ‘মাননীয় ডেপুটি স্পিকার মহোদয়, আমাকে বাংলায় কথা বলতে হবে। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, এ ভাষা আপনার বোধগম্য হবে না, তবুও আমাকে বাংলাতেই বলতে হবে।’ তাঁর এ বক্তব্য তাঁকে বাংলা ভাষার রক্ষা কবচ হিসেবেই ফুটিয়ে তোলে। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়নকালে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা হবে এই মর্মে অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেন। ঊনিশশো চুয়াত্তর সালে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাকে মর্যাদাশীল করে তোলেন।
ভাষা আন্দোলনের নবযাত্রায় ঊনিশশো আটানব্বই সালে কানাডার ভ্যাঙ্কুবারে বসবাসরত অভিবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব মিঃ কোফি আনানের কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার আবেদন করেন। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোফি আনানের তথ্য কর্মকর্তা হাসান ফেরদৌসের পরামর্শে জাতিসংঘের অন্য একটি সদস্য দেশের আবেদন এর সাথে যুক্ত করার পরামর্শ দেন। ফলস্বরূপ রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম 'মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভার্স ক্লাব অব দ্য ওয়ার্ল্ড ' নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর মাধ্যমে কোফি আনানকে আরও একটি চিঠি প্রেরণ করেন। সেই চিঠির অনুলিপি জাতিসংঘের কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত মিঃ ফাওলারকে ও ইউনেস্কোর আনা মারিয়াকে দেয়া হয়। মারিয়ার পরামর্শে এই প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ, কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি ও ফিনল্যান্ডকে যুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু অগ্রসর হওয়ার পর দেখা যায়, এই দাবির পক্ষে ঊনত্রিশটি দেশ একমত হয়ে কাজ করে। ঊনিশশো নিরানব্বই সালের সতের নভেম্বর ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয় এবং দুহাজার সাল হতে জাতিসংঘের একশ আটাশিটি সদস্য রাষ্ট্রে একযোগে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দুহাজার দশ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের পঁয়ষট্টিতম সাধারণ অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনের। সেই মোতাবেক জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহে এবং জাতিসংঘ সদর দপ্তরে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং শহীদ মিনার স্থাপিত হয়।
আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশে আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষত তরুণ সমাজের মধ্যে রোমান হরফে সংক্ষিপ্ত রূপে বিকৃত বাংলা উপস্থাপনের যুগ চলছে। তরুণদের এ চর্চা আমাদের ব্যথাহত করে। বিভিন্ন বিদ্যুৎ-নির্ভর গণমাধ্যমে যারা সঞ্চালকের ভূমিকায় থাকেন, তাদের বাংলায় খিচুড়ি ভাষার মিশ্রণ শহীদের চেতনাকে ধূলায় ভূলুণ্ঠিত করে। রেডিও জকিদের ডিজ্যুসমার্কা বাংলা যেমন আমাদের সংস্কৃতির জন্যে হানিকারক তেমনি টেলিভিশন চ্যানেলের নাটকগুলোতেও প্রমিত বাংলা ভাষার দফারফা হয়ে যাচ্ছে। পথেঘাটে ভুল বানানে বাংলাকে উপস্থাপন যেন ভাষাকে ধর্ষণের শামিল। এর সাথে যোগ হয়েছে বানান বিষয়ে বাংলা একাডেমির অদূরদর্শী ক্রিয়াকলাপ। বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্র বানানরীতি অনুসরণ করে ভাষাকে সাধারণ মানুষের জন্যে জটিল করে তুলেছে। একদিকে দেশে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাষাকে যেমন সার্বজনীনতা প্রদানের চেষ্টা করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আদালত ও উচ্চস্তরের শিক্ষায় এখনও বাংলা ভাষাকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। এখনও মোবাইলে অধিকাংশ বাঙালি বাংলা লিখতে শেখেনি। আমরা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের একুশে পদক দিলেও কম্পিউটার কী-বোর্ডে অভ্র ফন্টের মাধ্যমে বাংলা প্রবর্তনকারীকে কোনো স্বীকৃতি দেইনি। অথচ সবাই সকল ক্ষেত্রে বিনাবাক্য ব্যয়ে অভ্র ব্যবহার করে যাচ্ছি। আমরা কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, পরে চাই ইংরেজি শেখার পত্তন’Ñএই প্রাজ্ঞ বচনকে আউড়ে যাই, কিন্তু নিজেদের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পাঠিয়ে উন্নত দেশের অভিবাসী নাগরিক বানানোর স্বপ্নে বিভোর থাকি।
এইসব অসঙ্গতি দূর করে আগামী প্রজন্মকে প্রমিত বাংলার চর্চায় অধ্যবসায়ী করা না গেলে ভবিষ্যতে বিকৃত যান্ত্রিক বাংলার উদ্ভব হবে, যা আমাদের ভাষা আন্দোলনের মৌল চেতনার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে।
তথ্যসূত্র
১. চৎরসরঃরাব খধহমঁধমবং, খধহমঁধমব গরহরধঃঁৎব
২. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান, জুন ২০১২, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড