রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২০ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

আজ কচুয়ার রঘুনাথপুর গণহত্যা দিবস

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রঘুনাথপুর গণহত্যার শহীদরা মর্যাদা পাননি

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রঘুনাথপুর গণহত্যার শহীদরা মর্যাদা পাননি
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ॥

আজ ৮ সেপ্টেম্বর কচুয়ায় অবস্থিত রঘুনাথপুর বাজার গণহত্যা দিবস। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও রঘুনাথপুর বাজারে গণহত্যার শহীদরা মর্যাদা পাননি। ১৯৯৬ সালে গঠিত রঘুনাথপুর বাজার স্মৃতি সংসদের উদ্যোগে প্রতি বছর এলাকাবাসীসহ মুক্তিযোদ্ধারা ৮ সেপ্টেম্বরকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে।

কচুয়া, হাজীগঞ্জ ও মতলব উপজেলার সীমান্তবর্তী হওয়ায় রঘুনাথপুর বাজারটি ব্যবসায়-বাণিজ্যের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে এটি চাঁদপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ও অবহেলিত স্থান ছিলো। বর্ষাকালে এ বাজারে নৌপথে আসা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না। বাজারটিকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বেচা-কেনার নিরাপদ স্থান এবং মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আস্তানা হিসেবে বেছে নিয়েছিলো। সপ্তাহে কেবলমাত্র বুধবার এ বাজারটি বসে। বাজারটিতে প্রতি বুধবার হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো।

মন্তা নামের এক ব্যবসায়ী হাজীগঞ্জ থেকে এসে এ বাজারে পাট ব্যবসা করতো। সে রাজাকার বাহিনীতে যোগদান করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন জমজমাট এ বাজারটিতে পাট ব্যবসার নামে ছদ্মবেশে এসে এই মন্তা তার সহযোগীদের দিয়ে বাজারের আশেপাশে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান এবং বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হয়। পরে হাজীগঞ্জ ক্যাম্পে গিয়ে পাকবাহিনীর সাথে আলাপ করে রাজাকার বাহিনী দ্বারা বাজারটিতে পরিকল্পিত হামলার প্রস্তুতি নেয়।

১৯৭১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বুধবার ছিলো রঘুনাথপুর বাজারের সাপ্তাহিক হাটবার। বহু লোকের সমাগম হয়েছিলো বাজারে। ভরা বর্ষায় চতুর্দিক থেকে নৌকাযোগে আসা ক্রেতা-বিক্রেতায় বাজারটি ছিলো পরিপূর্ণ। আনুমানিক বিকেল ৩টায় ৫০/৬০ জন রাজাকার ৬/৭টি নৌকায় টোরাগড় গ্রামের রাজাকার কমান্ডার বাচ্চুর নেতৃত্বে রঘুনাথপুর বাজারের দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবেশ করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন তখন ছিলেন বাজারের দিঘির পূর্ব-উত্তর কোণের বগীরমার বাড়ি বলে পরিচিত বাড়িটির দক্ষিণ পাশের একটি নৌকাতে। তিনি রাজাকারদের আগমন টের পান এবং এলএমজি তাক করেন আক্রমণ করার উদ্দেশে। কিন্তু তার সহযোগীরা বাজারের লোকের জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় এ আক্রমণে তাকে বারণ করেন। এ সময় রাজাকারদের পূর্ব নিয়োজিত ইনফরমারদের দেয়া তথ্যানুসারে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর রাজাকাররা ফাঁকা গুলি চালিয়ে সমস্ত বাজারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বাজারের অপ্রস্তুত লোকজন গুলির আওয়াজে জ্ঞানশূন্য হয়ে বিভিন্ন দিকে পালাতে শুরু করেন। বাজারের মধ্যবর্তী বোয়ালজুরি খালের ওপরে বর্তমান নতুন ব্রিজটির প্রায় ২০০ গজ দক্ষিণে ছিলো একটি কাঠের পুল। কাঠের পুলের পশ্চিমপাড়ে পাটের ব্যবসায়ী রাজাকার মন্তা রাইফেল হাতে সহযোগী রাজাকারদের গাইডলাইন দিচ্ছে দেখে পাট মাপার কাজে নিয়োজিত তারাপল্যা গ্রামের সাহসী যুবক শামছুল হক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিনি দৌড়ে এসে রাজাকার মন্তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘মন্তা তুই! এ বাজারের লোক হয়ে তুই কিভাবে এই বাজার আক্রমণ করতে পারলি? ’এ নিয়ে রাজাকার মন্তার সাথে শামছুল হকের বাক-বিত-া শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শামছুল হক মন্তাকে ঝাপটে ধরে হাতাহাতি শুরু করে, রাইফেলটি ছিনিয়ে নিয়ে মন্তাকে ফেলে দিয়ে রাইফেল দিয়ে পিটাতে শুরু করে। এই সময় শামছুল হককে সাহায্য করতে দ্রুত ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসে তার পিতা ওয়াজউদ্দিন ও প্রতিবেশী জুনাব আলী। এমনটি দেখে অন্য রাজাকাররা প্রথমে শামছুল হককে এবং পরপর ওয়াজউদ্দিন ও জুনাব আলীকে গুলি করে হত্যা করে।

এ সময় তাদের গুলিতে নিহত হয় ৭ম শ্রেণির ছাত্র রশীদ খন্দকার। তার লাশ কবুতরের খাঁচা জড়িয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারপর রাজাকারেরা বাজারটিতে চালায় নির্বিচারে গুলি ও লুটতরাজ চালায়। বাজারের মসজিদের দেয়ালের সাথে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তান থেকে আসা সদ্য এমএ পাস করা মদ্দেরবাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার কয়েক গজ দূরে তখনকার কলেজছাত্র, পরে কাদলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম মাইনউদ্দিন মজুমদারকে গুলি করার উদ্দেশ্যে অন্যান্যের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। রাজাকাররা রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়কে অস্ত্র নির্মাণাগার এবং অস্ত্রের ভাণ্ডার মনে করে বিদ্যালয়ের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে এবং বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এমনি করে রাজাকাররা কয়েক ঘণ্টা তাণ্ডবলীলা (হত্যাকাণ্ড) ও ব্যাপক লুটতরাজ শেষ করে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনের লাশ হাজীগঞ্জে নিয়ে যায়। তাঁর লাশ হাজীগঞ্জ বাজারের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত টানা-হেঁচড়া করে উল্লাস করে এবং টানিয়ে প্রদর্শন করে। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিনের লাশ নাসিরকোটে সমাহিত করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাজাকারেরা চলে যাওয়ার পরপরই স্থানীয় লোকজন একত্রিত হয়ে রঘুনাথপুর বাজারে পড়ে থাকা ১৭টি লাশ দেখতে পান। তন্মধ্যে ৫টি বাজারের মধ্যবর্তী খালের পশ্চিম পাড়ে এবং ১২টি পূর্ব পাড়ে। এ সতেরোটি ছাড়াও অনেক লাশ তাদের আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় অর্ধশতাধিক লোক এ হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন। তন্মধ্যে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে ১৪ জন শহীদের নাম। তালিকাভুক্তরা হচ্ছেন : শাহরাস্তি উপজেলার রাজাপুর গ্রামের আব্দুল মতিন, হাজীগঞ্জ উপজেলার মহাব্বতপুর গ্রামের শামছল হক, মোয়াজ্জেম আলী, তারাপল্যা গ্রামের ওয়াজ উদ্দিন, জুনাব আলী, ধড্ডা গ্রামের আব্দুল আউয়াল চৌধুরী, সাড়াশিয়া গ্রামের আব্দুর রশীদ খন্দকার (৭ম শ্রেণির ছাত্র), রামপুর গ্রামের প্রান বল্লব, ওড়পুর গ্রামের মোখলেছুর রহমান, জংশর আলী, আব্দুর রব, কচুয়া উপজেলার মহদ্দিরবাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, দেবীপুর গ্রামের জাহানারা (৮ বছর) ও পরাণপুর গ্রামের গিরিশ চন্দ্র সরকার।

রঘুনাথপুর বাজারের হত্যাকাণ্ডটি ছিলো লোমহর্ষক, হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী। হত্যাযজ্ঞের বিভৎসতা আজও তাড়া করে ফিরছে এলাকাবাসীকে। জেলার মধ্যে এ হত্যাকাণ্ড ছিলো সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড। চাঁদপুর জেলার এ পল্লীতে এমনি একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ১৯৯৭ সালের পূর্বে শহীদদের কেউ স্মরণ করেনি। তৎকালীন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোঃ খালিদ আনোয়ার এ স্থানে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও অর্থাভাবে সে উদ্যোগ সফল করে যেতে পারেননি। কিন্তু ক্ষুদ্রাকৃতির একটি শহীদ মিনারের জন্যে কিছু অর্থের ব্যবস্থা করেছেন। ফলে রঘুনাথপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের পশ্চিম পাশে বর্তমানে শহীদ মিনারটি শোভা পাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সম্প্রতি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ের পূর্বপ্রান্তে পৃথক শহীদ মিনার নির্মাণ করেছে। অযত্ন-অবহেলার কারণে শহীদ মিনারটি বর্তমানে জরাজীর্ণ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেখভাল করার যেনো কেউ নেই।

গণহত্যার স্থলে একটি ভাস্কর্য নির্মাণের জন্যে এলাকাবাসীর দাবি দীর্ঘদিনের। ভাস্কর্য নির্মাণ বিষয়ে কচুয়া উপজেলা প্রকৌশলী সৈয়দ জাকির হোসেন জানান, দুই বছরেরও অধিক সময় পূর্বে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কচুয়ার রঘুনাথপুর বাজারে ও রহিমানগর কলেজ গেট সংলগ্নে গণহত্যার স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্যে নকশা তৈরি করে প্রেরণ করা হয়। ৩৫ লক্ষ টাকার মধ্যে প্রেরিত নকশা অনুযায়ী প্রাক্কলন তৈরি করে প্রেরণ করতে বলা হয়।

সরেজমিনে গিয়ে প্রস্তাবিত স্থানে নকশানুসারে ভাস্কর্য নির্মাণের জন্যে প্রয়োজনীয় জায়গা পাওয়া যায়নি। স্থানীয় অধিবাসীরা জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়ার আশ্বাস দিলেও এ পর্যন্ত জায়গা নির্ধারণ করে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে পারেনি। ফলে ওই দুটি ভাস্কর্য নির্মাণের প্রাক্কলন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সম্ভব হয়নি।

রঘুনাথপুর বাজার শহীদ স্মৃতি সংসদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসার জানান, ৮ সেপ্টেম্বর বুধবার বিকেলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে রঘুরাথপুর বাজারে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিচ্ছেন চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এমএ ওয়াদুদ। তিনি আরো জানান, ভাস্কর্য নির্মাণে প্রয়োজনীয় জায়গার ব্যবস্থা করার জন্যে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়