প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
সাক্ষাৎকার : ডাঃ পিযুষ সাহা
রোগীর মুখের হাসি সবসময় প্রত্যাশা করি
ডাঃ পিযুষ সাহা ২০০৯ সালে চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। চাকুরিজীবনে তাঁর প্রথম কর্মস্থল ছিলো চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বর্তমানে তিনি আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার (মেডিসিন) হিসেবে কর্মরত। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায়।
|আরো খবর
তিনি বলেন, জনবল সঙ্কটের কারণে রোগীদের পুরোপুরি চিকিৎসাসেবা চাইলেও দিতে পারছি না। রোগীর মুখের একটি ছোট্ট সুন্দর হাসি সবসময় প্রত্যাশা করি। রোগীরা যখন বলে ‘স্যার আপনার চিকিৎসাসেবা পেয়ে আগের থেকে অনেক ভালো আছি’-এর থেকে আনন্দের আর কিছুই থাকে না।
সদা হাস্যোজ্জ্বল ও রোগীবান্ধব ডাঃ পিযুষ সাহা ২৩ অক্টোবর শনিবার দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের পাক্ষিক আয়োজন ‘চিকিৎসাঙ্গন’-এর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নেন আল-আমিন হোসাইন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
ডাঃ পিযুষ সাহা : এখন পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই আছি। তবে দেশের পরিস্থিতিতে মন-মানসিকতা খুব বেশি ভালো নেই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কোথায়?
ডাঃ পিযুষ সাহা : আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই।
ডাঃ পিযুষ সাহা : আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার সার কারখানা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এখানে আমি প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর ঘোড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানা স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করি। এইচএসসি পাস করি ঢাকার নটরডেম কলেজ থেকে। সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। ২০০৯ সালে চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসক হওয়ার ভাবনাটি সূচনা হলো কীভাবে?
ডাঃ পিযুষ সাহা : আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করি তখন থেকেই মূলত চিকিৎসক হওয়ার ভাবনাটি সূচনা হয়। আমার মনে একটি সুপ্ত আভাস ছিলো, আমি হয়তো চিকিৎসক হবো। কারণ আমার একজন দিদা (দাদি) চিকিৎসক ছিলেন। তিনি ছিলেন গাইনী চিকিৎসক। বলতে পারেন, আমি তার হাত ধরেই চিকিৎসা পেশা আসি। দেশের প্রতি আমার ভালোবাসা আর দিদাকে দেখেই আমার চিকিৎসক হওয়ার ভাবনাটি জাগে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসক হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
ডাঃ পিযুষ সাহা : চিকিৎসক হিসেবে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। প্রথম দিনেই আমাদের বড় ভাইয়েরা এবং রেজিস্ট্রার স্যাররা সার্জিক্যাল বেশ কিছু কাজ শিখিয়েছেন। প্রথম দিন আমরা যখন ওয়ার্ডে রোগীদের সেবা দিতে যাই, তখন মনে হয়েছে আমরা হয়তো দেশের জন্যে ভালো কিছু করতে পারবো। আমি হয়তো ভবিষ্যতে দেশের জন্যে ভালো কিছু করতে পারবো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুরে যোগদান করেছেন কবে?
ডাঃ পিযুষ সাহা : ২০১৭ সালে আমি চাঁদপুরে যোগদান করেছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চাঁদপুরের চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক দিক নিয়ে কিছু বলুন।
ডাঃ পিযুষ সাহা : চাঁদপুরের চিকিৎসাব্যবস্থা খুব বেশি উন্নতও না, আবার খুব বেশি অনুন্নতও না। এখানে চিকিৎসাব্যবস্থার সার্বিক দিক বলতে গেলে, উন্নয়নশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা অতিক্রম করছি। ঢাকার খুব কাছাকাছি জেলা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থাটা এখনো খুব বেশি একটা উন্নত হয়নি। আমাদের চিকিৎসক সঙ্কট রয়েছে অনেক। বিশেষ করে আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও আমাদের এখানে প্রতিদিন গড়ে চারশ’র বেশি রোগীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। কিন্তু সে হিসেবে আমাদের চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম। তবে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক ব্যবস্থাপনা ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের যেহেতু চিকিৎসক এবং নার্স সঙ্কট এজন্যে পুরোপুরি চিকিৎসাসেবা আমরা চাইলেও দিতে পারছি না। এছাড়া অন্যান্য কর্মীদেরও অভাব রয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার কাছে কোন্ ধরনের রোগী বেশি আসে?
ডাঃ পিযুষ সাহা : আমি যেহেতু মেডিসিন প্র্যাকটিস করি তাই আমার কাছে মেডিসিনের রোগীই বেশি আসেন। প্রেসার এবং ডায়াবেটিসের রোগী এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগীদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?
ডাঃ পিযুষ সাহা : রোগীর মুখের একটি ছোট্ট সুন্দর হাসি সবসময় প্রত্যাশা করি। রোগীরা যখন আমার কাছে এসে বলে ‘স্যার আপনার চিকিৎসাসেবা পেয়ে আমি খুব ভালো আছি কিংবা আগের থেকে অনেক ভালো আছি’-এর থেকে আনন্দের আর কিছুই থাকে না। সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত এটাই।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসাজীবনের একটি সুখের এবং একটি দুঃখের স্মৃতির কথা বলুন।
ডাঃ পিযুষ সাহা : সুখের আসলে অনেক স্মৃতি আছে। আগেই বলেছি, রোগীর মুখের একটি ছোট্ট সুন্দর হাসি আমাকে অনেক খুশি করে। রোগীরা এসে যখন বলে ‘আগের থেকে অনেক ভালো আছেন’ এসব আমার সুখের স্মৃতি। এছাড়াও আমার মা বেশ অসুস্থ হয়ে ছিলেন। আমার মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। আমার মায়ের ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালেন্স ছিলো। আমি মাকে হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে নিজে চিকিৎসাসেবা দিয়ে বেশ সুস্থ করি। তখন আমার মনে হয়েছে চিকিৎসক হিসেবে আমি ভালো কিছু করতে পারলাম।
আমার চাকুরিজীবনের প্রথম কর্মস্থল ছিলো চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে একজন হার্টঅ্যাটাকের রোগী আমার কাছে আসেন। আমরা ইসিজি করার পর চিকিৎসাসেবা দেয়ার পর পরই রোগীটি মারা যান। এরপর রোগীর আত্মীয়স্বজন উত্তেজিত হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। যদিও ব্যাপারটা সামলে নেয়া গেছে। ওইদিনের ব্যাপারটা আমাকে খুবই কষ্ট দিয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে কী কী প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন?
ডাঃ পিযুষ সাহা : চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদেরকে অনেক কিছু সামলিয়েই আসলে চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের কথাই যদি বলি, এখানে আয়া এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাব রয়েছে। এতে করে রোগীদের আমরা হয়তো চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে পারি কিন্তু অন্যান্য যে সার্বিক ব্যবস্থাপনা সেটা ঠিকমতো করতে পারি না। এসব বিষয় সমাধানে আমরা খুব চেষ্টা করে যাচ্ছি। সামনের দিনগুলোতে হয়তো এসব বিষয়ে আমরা ভালো পদক্ষেপ পাবো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলে প্রথম যে তিনটি কাজ করতেন?
ডাঃ পিযুষ সাহা : আমি অন্তত আশা করি না যে আমি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবো। কারণ আমি কোনো রাজনীতির সাথে খুব বেশি জড়িত নই। যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী হই, তাহলে আমি প্রথমেই চেষ্টা করবো আমার নিজের এলাকায় একটি আধুনিক হাসপাতাল গড়ে তোলার। যেখানে মানুষ কম খরচে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করবে।
আমাদের দেশে চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। চিকিৎসকদের হাসপাতাল অনুযায়ী ঠিক জায়গায় নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। আমার প্রথম পদক্ষেপ থাকবে, রোগীবান্ধব হাসপাতাল পরিচালনা করা এবং হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট দূর করা।
আমাদের জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে হৃদরোগের চিকিৎসাসেবা প্রদান খুব বেশি একটা হয় না। হৃদরোগের চিকিৎসা প্রদানে চাঁদপুরেও এখন পর্যন্ত একটা করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) হাসপাতাল গড়ে উঠেনি। আমাদের এখানে মেডিকেল কলেজ হলে হয়তো করোনারি কেয়ার ইউনিট গড়ে উঠবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলে আমি প্রত্যেকটা জেলা সদরে করোনারি কেয়ার ইউনিট গড়ে তোলার চেষ্টা করবো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : করোনাকালে চিকিৎসাসেবা প্রদানের অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
ডাঃ পিযুষ সাহা : গত দু বছর যাবৎ আমরা করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করছি। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছি। আড়াইশ’ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের যথেষ্ট ভালো চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিলো রোগী কোনো অবস্থায়ই যেনো মারা না যান। আমরা করোনা রোগীদের সুস্থ করে তোলতে অনেক শ্রম দিয়েছি। করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে প্রথম প্রথম আমাদের বেশ কষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার ৩-৪ মাস পরই আমরা যখন এর চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে যাই, চিকিৎসাসেবা প্রদানের নতুন প্রটৌকলগুলো তৈরি হয় তখন আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি ভালো চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে। বিশেষ করে চাঁদপুরে অনেক রোগী থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর সংখ্যার হার অন্যান্য জেলা থেকেও কম ছিলো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
ডাঃ পিযুষ সাহা : রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে আমাদেরকে অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি এবং বিশুদ্ধ খাবার খেতে হবে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ফলমূল অবশ্যই খেতে হবে। নিয়মিত ২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটাচলা এবং ব্যায়াম করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে লাল গোশত ও চর্বিযুক্ত খাবার কম খাওয়া। এছাড়াও প্রতিদিনের খাবারে সবজি থাকা আবশ্যক। এসব নিয়ম মেনে চললে আমরা অনেকটা সুস্থ-সবল জীবনযাপন করতে পারবো।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসরে কী করেন?
ডাঃ পিযুষ সাহা : অবসরে পড়াশোনা করি। গল্প-উপন্যাসের বই পড়ি। এছাড়াও ডাকটিকিট সংগ্রহ করা আমার শখ। আমার সংগ্রহে প্রায় পাঁচ হাজার ডাকটিকিট রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আমি ডাকটিকিট সংগ্রহ করি। এখনও করছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ডাঃ পিযুষ সাহা : ধন্যবাদ।
* চিকিৎসাঙ্গন বিভাগে লেখা পাঠানোর ই-মেইল