প্রকাশ : ০৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
আট জমিদারের নাতি দেশের একজন নিঃস্বার্থ সমাজসেবক ও দানবীর
সর্বোচ্চ করদাতার মুকুট কাউছ মিয়ার হাতে
এবারও বাংলাদেশের সেরা করদাতা হিসেবে এক নম্বর হয়েছেন চাঁদপুরের কৃতী সন্তান সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ ব্যবসায়ী, সমাজসেবক ও দানশীল হাজী মোঃ কাউছ মিয়া। ২০২১-২২ করবর্ষে সিনিয়র সিটিজেন করদাতা শ্রেণিতে ১ম সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী নির্বাচিত হয়ে সর্বোচ্চ করদাতার মুকুট এখন কাউছ মিয়ার হাতে। তিনি হাকিমপুরী জর্দার স্বত্বাধিকারী। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে।
|আরো খবর
বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়োজিত ‘জাতীয় ট্যাক্স কার্ড ও সর্বোচ্চ করদাতা সম্মাননা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার হাতে এ বছরের রাষ্ট্রীয় ক্রেস্ট ও সম্মাননা তুলে দেন। এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুনিম।
স্বাধীনতার আগে ও পরে এ পর্যন্ত টানা ২০ বার দেশের প্রবৃদ্ধি অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শীর্ষ করদাতার রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়ে অনন্য রেকর্ড গড়েন কাউছ মিয়া। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক বছর সরকার বাহাদুর কর নেয়নি। তাই তিনি কর দিতে পারেন নি। বাংলাদেশে তাঁকে বলা হয় দানবীর। যিনি মানবতার সেবকের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মানবিকতা দিয়ে জয় করেছেন মানুষের হৃদয়। সৎভাবে ব্যবসা করে দেশের শ্রেষ্ঠ করদাতার খ্যাতি পেয়েছেন অনেক।
১৯৩১ সালের ২৬ আগস্ট কাউছ মিয়া রাজরাজেশ্বরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম হাজী আব্বাস আলী মিয়া ও মাতা মরহুমা হাজী মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন (জমিদার কন্যা)। তৎকালে ভারতবর্ষের ত্রিপুরা ডিস্ট্রিক্ট ছিলো পূর্বে আগরতলা ও পশ্চিমে কলকাতা পর্যন্ত। কাউছ মিয়া যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন আমলের সামুগাদী চরবাহাদুর গ্রামে তাঁর বাবার শুধু বাড়িটিই ছিলো (বাড়ির বাট) ৮৩৭ শতাংশ জায়গা নিয়ে। আর তাঁদের শত শত বিঘা কৃষি জমিতো ছিলোই।
হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার ৮ নানা ছিলেন জমিদার। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে সরকার প্রত্যেক জমিদারকে ১শ’ একর করে জমি বুঝিয়ে দেয়। কাউছ মিয়ার বড় বাবা (নানার পিতা) আজগর দেওয়ান ছিলেন ১৭০০ সালের প্রতাপশালী জমিদার। তাঁর ছিলো ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। তাঁর একমাত্র কন্যার মধ্যে হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার মমতাময়ী মা জমিদার-কন্যা হাজী মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন ছিলেন সবার বড়। হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার বর্তমান বয়স ৯৩ বছর। এ বয়সেও আল্লাহপাক তাঁকে শারীরিক এবং মনের দিক থেকে প্রাণবন্ত রেখেছেন। কাউছ মিয়া মনে করেন, মানুষ যদি শরীর ও মনের দিক থেকে সুস্থ থাকে, সেটি আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহর রহমত ছাড়া কেউ সুস্থ থাকতে পারে না। তিনি বলেন, রাব্বুল আলামিনের কাছে শোকরিয়া, আল্লাহ আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন।
হাজী মোঃ কাউছ মিয়া এখনো প্রতিদিন তিনি ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা নিজেই ব্যবসা পরিচালনা করেন। ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা ৭৩ বছর এককভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে সিআইপি মর্যাদায় ২০ বার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভের রেকর্ড এখন তাঁর। ২০২১ সালে মুজিববর্ষের সেরা চমক ছিলেন কাউছ মিয়া। কেননা তিনি মুজিববর্ষে সারা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র দেশসেরা করদাতা নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর প্রদানে সততা, আন্তরিকতা ও স্বপ্রণোদিত মানসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ এবং জাতীয় রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় তাঁকে দেশসেরা করদাতার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। সারাদেশে এ সম্মাননা শুধু তিনি একাই পান। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাউছ মিয়াকে নিরাপত্তার জন্যে একটি রিভলবারের লাইসেন্স প্রদান করেন (যার নং-১৪)। তিনি সেই রিভলবারটি বয়সের কারণে নিজের ইচ্ছায় ২০১৮ সালে পুরাণ ঢাকার বংশাল থানায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জমা দেন।
তিনি তাঁর মরহুম পিতার নামে উত্তর তারাবুনিয়া আব্বাস আলী উচ্চ বিদ্যালয় এবং চাঁদপুর শহরের স্ট্র্যান্ড রোডে (কবি নজরুল সড়কে) মায়ের নামে মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি চাঁদপুর শহরের গুয়াখোলা আবাসিক এলাকায় মদিনা জামে মসজিদ এবং স্ট্র্যান্ড রোডে (বর্তমান কবি নজরুল সড়কে) আল-আমিন স্কুলের পাশে বোগদাদীয়া জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ দুটি মসজিদের মোতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
গুলশান, বনানী, মতিঝিলের ডাকসাইটেট ব্যবসায়ীদের পেছনে ফেলে পুরাণ ঢাকার ঘুপচি গলির এই ব্যবসায়ীই প্রতি বছর সর্বোচ্চ করদাতা নির্বাচিত হন। প্রতিবারই শীর্ষ করদাতাদের তালিকায় তাঁর নাম থাকছে সবার উপরে। অবশ্য অন্য শ্রেণির ব্যবসায়ীগণ প্রতি বছর সর্বোচ্চ যে পরিমাণ টাকার কর দেন কাউছ মিয়ার ধারে-কাছেও নেই তারা। কাউছ মিয়া ৬৪ বছর ধরে কর দিয়ে আসছেন। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দেন তিনি। ১৯৬৭ সালে এক নম্বর করদাতা হয়েছিলেন কাউছ মিয়া। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট তাঁকে সেরা করদাতার সার্টিফিকেট প্রদান করে।
কেনো কর দেয়া শুরু করলেন এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন কাউছ মিয়া। ২০১৯ সালে এনবিআরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, আগে টাকাণ্ডপয়সা এখানে-সেখানে রাখতাম। এতে নানা ঝামেলা ও ঝুঁকি থাকতো। ১৯৫৮ সালে প্রথম কর দিয়ে ‘ফ্রি’ হয়ে গেলাম। এরপর সব টাকাণ্ডপয়সা ব্যাংকে রাখতে শুরু করলাম। হিসাব-নিকাশ পরিষ্কার করে রাখলাম।
কাউছ মিয়া জানান, তাঁর বাবা চাইতেন না তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে নামেন। বাবার ইচ্ছা ছিলো ছেলে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। বাবা কখনো ব্যবসা করেননি। তাঁদের প্রচুর জায়গা-জমি রয়েছে। তাঁর বাবা বলতেন, তুমি ব্যবসা করবা কেনো? আমাদের এতো সম্পত্তি কে খাইবে। তখন কাউছ মিয়া বাবাকে বলেন, আপনার ওয়ারিশরা খাইবে। অথচ ব্যবসায় মন পড়ে থাকা কাউছ মিয়া ১৯৪৫ সালে অষ্টম শ্রেণি পাস করে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডোলে আর পড়াশোনা এগোয়নি। পুরাণবাজার মধুবাবুর স্কুলে পড়েছেন তিনি। ওই স্কুলের পাশেই তাঁর নানা জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম সাহেবের বাড়ি। কাউছ মিয়া তাঁর বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ১৯৫০ সালে চাঁদপুরের পুরাণবাজারে স্টেশনারী ব্যবসা শুরু করেন। দেশের প্রসিদ্ধ এই ব্যবসায়িক এলাকায় তৎকালে তাঁর ৬টি দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিলো। এরপর ধীরে ধীরে ১৮টি ব্র্যান্ডের সিগারেট, বিস্কুট ও সাবানের এজেন্ট হন তিনি। পরের ২০ বছর তিনি চাঁদপুরেই ব্যবসা করেন। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন, তামাকসহ অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেন এবং ৪০ থেকে ৪২ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত (তৎকালীনসহ বিভিন্ন সময়)।
একবার কাউছ মিয়া আমদানির ব্যবসায় নামতে লাইসেন্স নিয়েছিলেন। এ ব্যবসায় মন না চাওয়ার কারণে লাইসেন্স বাতিল করিয়ে নেন। নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্যে বেশ কিছু কার্গো জাহাজ রয়েছে ছেলেদের নামে। জাহাজগুলো তারাই দেখাশোনা করেন। ছেলেদের প্রত্যেকের নামে ইনকাম ট্যাক্সের ফাইল রয়েছে। হাজী মোঃ কাউছ মিয়ার বড় বাবার নাম হাজী মোঃ মুসলিম মিয়া বেপারী, দাদার নাম হাজী মোঃ সবদ আলী মিয়া বেপারী (সবদ হাজী), পিতার নাম হাজী মোঃ আব্বাস আলী মিয়া বেপারী ও মাতা জমিদার কন্যা মোসাম্মৎ ফাতেমা খাতুন। তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। তাঁদের বাড়ির বেশ নামডাক ছিলো। এক নামে হাজী বাড়ি হিসেবে চিনতো সবাই। তাঁর দাদারা ছিলেন ৬ ভাই। তাঁরা পায়ে হেঁটে পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন। তখন হজ্বে যেতে সময় লাগতো ৬ মাস, এখন সময় লাগছে ৬ ঘণ্টা।
কাউছ মিয়ার বড়বাবা অর্থাৎ নানার পিতা আজগর দেওয়ান। তিনি ছিলেন সতেরশ’ সালের ত্রিপুরা ডিস্ট্রিক্টের প্রতাপশালী জমিদার। আজগর দেওয়ানের কনিষ্ঠ পুত্র জমিদার মৌলভী আব্দুস সালাম। ১৮৬০ সালে তিনি কোলকাতা আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টাইটেল পাস করেন। আজগর দেওয়ানের ৭ ছেলে ও ১ মেয়ে। উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলে-মেয়ে আটজনই ছিলেন জমিদার। তাঁর বড় বাবা আজগর দেওয়ানের বড় ছেলে হাছান দেওয়ান ও ছোট ছেলে মৌলভী আব্দুস সালাম। হাছান দেওয়ান মারা যাওয়ায় তাদের জমিদারি ধন-সম্পদ ধরে রাখার জন্যে ছোট ভাই আব্দুস সালাম সাহেব বড় ভাই হাছান দেওয়ানের স্ত্রীকে অর্থাৎ বড় ভাবীকে বিয়ে করেন। তিনি মৃত্যুবরণ করায় কাউছ মিয়ার নানা সালাম সাহেব চাঁদপুর সদর উপজেলার নানুপুর বড় তালুকদার বাড়ির রহমান তালুকদারের মেয়ে হাজী মোসাঃ রোকেয়া বেগমকে বিয়ে করেন। নানার শ্বশুর কাউছ মিয়ার বড়বাবা রহমান তালুকদার ওই অঞ্চলের প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক ছিলেন। তাঁদের ওই এলাকায় তালুকদারি ছিলো। ব্রিটিশরা তালুকদার প্রথা উঠিয়ে দিলে ‘বাংলার বাঘ’ নামে খ্যাত এ.কে.এম. ফজলুল হক তৎকালীন শাসনামলে তালুকদারের সম্পত্তি অসহায় গরিবদের দিয়ে দেন। তাঁর নানা মৌলভী আব্দুস সালাম ছোটবেলায় কাউছ মিয়াকে খুব আদর করতেন। কাউছ মিয়ার বয়স যখন ৯ বছর তখন তাঁর নানা বলেছিলেন, ভাই, তুমি সব বংশের নাম রাখবা। সে সময় নানা তার পানি পান করার পিতলের গ্লাসটি কাউছ মিয়াকে দিয়েছিলেন। নানার দেয়া সেই পাত্রটি কাউছ মিয়া এখনো স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন।
কাউছ মিয়া তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে কখনো কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করেননি। তাঁর বাপ-দাদারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নেননি। এমনকি পূর্বপুরুষদের কেউ রাজনীতি করেননি। এজন্যে কাউছ মিয়া এবং তাঁর ছেলেরাও কোনো রাজনীতি করেন না।
কাউছ মিয়া একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সবসময় নিজেকে সমাজসেবা ও মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু মানুষকে তিনি সহযোগিতা করেছেন। তাঁর চাচাতো ভাই রুস্তম আলী বেপারী বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারায়ণগঞ্জ আইটি স্কুলের সামনে পাকহানাদার বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন প্রত্যেককে সাড়ে তিন হাজার টাকা করে নগদ প্রদান করা হবে। তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত সেই অর্থ রুস্তম আলী বেপারীর স্ত্রীর হাতে তুলে দেয় হয়। রুস্তম আলী বেপারীর স্ত্রী এখন জীবিত নেই। এখন থেকে চার বছর আগে ৯০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শহীদ রুস্তম আলী বেপারী ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে রেখে গেছেন। বড় মেয়েকে হাজী মোঃ কাউছ মিয়া বিয়ে দেন এবং মেয়ের জামাইকেও চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। বঙ্গবন্ধুর দেয়া সেই সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে জায়গা কেনার জন্যে কাউছ মিয়া সে সময় তার চাচাতো ভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা রুস্তম আলীর স্ত্রীকে (তার ভাবীকে) বলেছিলেন। কিন্তু ভাবী তাঁর কথা শুনেননি। ওই টাকা দিয়ে তৎকালে নারায়ণগঞ্জে চার বিঘা জমি রাখা যেতো। কাউছ মিয়া বলেন, তার কথা যদি তখন ভাবী শুনতেন, সেই জায়গার দাম এখন শত শত কোটি টাকা হতো। ভাবী তার চেয়ে দুই বছরের বড় ছিলেন। এখন ভাবী বেঁচে নেই। তারপরও মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এই পরিবারের স্ত্রী-সন্তানদের এখন পর্যন্ত তিনি সহযোগিতা করে আসছেন। তাদেরকে কাউছ মিয়া সরকারি সহযোগিতা নিতে দেননি। কারণ তিনিই তো সহযোগিতা করছেন। কাউছ মিয়ার আরেক মামাতো ভাই মুক্তিযোদ্ধা আঃ মালেক দেওয়ান। বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার আনন্দবাজার। তিনি এখনো মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন।
দেশসেরা এই করদাতা জানান, ১৯৮৮ সালে তিনি হাকিমপুরী জর্দা তৈরি এবং বাজারজাত করেন। তখন এটি ছিলো কুটিরশিল্প। তাঁর প্রতিষ্ঠানে ৪/৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। সরকার ১৯৯৯ সালের জুন মাসে জর্দার ওপর ভ্যাট আরোপ করে। তখন বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা ভ্যাট দিয়েছেন। বর্তমানে সম্পূরক শুল্কসহ ট্যাক্স প্রদান করছেন প্রায় ১০/১১ কোটি টাকা। জর্দা ব্যবসা ছাড়াও আগে থেকেই তার বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। যার কিছু ব্যবসা বয়সের কারণে তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, আবার কিছু ব্যবসা রেখেও দিয়েছেন। ঢাকাতে তাঁর অনেক বাড়ি-ঘর, জায়গা-জমি রয়েছে। তিনি ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদপুরে তাঁর নিজের কেনা ও ছেলেদের কেনা এবং পৈত্রিক সূত্রে বাড়ির জায়গা-জমিতে কৃষিপণ্য (ধান, পাট, সরিষা, সয়াবিন, মরিচ) চাষাবাদ করে ফলন করছেন। এর সাথে ৩টি বড় গরুর খামার রয়েছে। সেখানে তাঁর খরিদকৃত হাজার হাজার বিঘা জমি রয়েছে। তাঁর জমিতে এসব কৃষি পণ্য ছাড়াও প্রচুর পরিমাণ গো-খাদ্য উৎপাদিত হয়। তাঁর এই প্রজেক্টে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। এখানে বিদ্যুৎ ও পানির জন্যে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। গরুর খামারের গোবর তাঁর কৃষি জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৮ জমিদারের নাতি হাজী মোঃ কাউছ মিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে নানাদের জমিদারি সম্পত্তির অংশ পাওয়ার নিয়ম থাকলেও সেই সম্পত্তি নেননি এবং তাঁর পূর্বপুরুষরাও শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তি নেয়নি এবং তাঁর ছেলেরাও নেয়নি। বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতার সর্বাধিক পুরস্কার লাভ করায় এবং সর্বশেষ মুজিব শতবর্ষের সেরা করদাতার বিরল রেকর্ডের অধিকারী হওয়ায় চাঁদপুরবাসী তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করছে। একের পর এক সাফল্যে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয় দানবীর কাউছ মিয়ার নাম। অনেকে বলেন, সত্যিই ব্যবসা জগতে তিনি এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
মানবসেবার দৃষ্টান্ত : ১৯৫৪ সাল থেকে এ যাবৎ ২২ বার দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়। দেশের যে প্রান্তেই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গন, পাহাড় ধস হয়েছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে যখন বৈশ্বিক করোনা মহামারি দেখা দেয় তখনসহ প্রতিটি দুর্যোগে তিনি বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় টানা একমাস, ১৯৯৮ সালের বন্যার সময় প্রায় দুই মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দি মানুষের দোরগোড়ায় রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়ে কাউছ মিয়া দেশ-বিদেশে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। ২০২০ সালে মানুষ যখন মরণব্যাধি করোনাভাইরাসে দিশেহারা, এ সময়েও প্রায় ৭/৮ কোটি টাকার ত্রাণ সহায়তা দিয়ে মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। করোনার দুঃসময়ের মধ্যেও দেশে পাঁচ স্থানে বন্যা হয়েছে। সেই বন্যাকবলিত এলাকায় তিনি তাঁর বিশ্বস্ত লোক দিয়ে ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন। এভাবেই চব্বিশ বছর বয়স থেকে ৬৭ বছর যাবৎ মানবসেবা করে যাচ্ছেন তিনি। হাজী মোঃ কাউছ মিয়া দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন এবং তিনিও সবার জন্যে দোয়া করছেন। আমিন।