প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
নাম তার মিসেস ফরিদা ইলিয়াস। তিনি চাঁদপুর পৌরসভার ৭, ৮ ও ৯নং ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত ওয়ার্ডে নির্বাচিত মহিলা কাউন্সিলর। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান প্রার্থী নাছির উদ্দিন আহমেদের সাথে আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে কমিশনার নির্বাচিত হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কেননা চাঁদপুর শহরের ৭নং ওয়ার্ডে বিএনপির অধিক ভোটার অধ্যুষিত এলাকায় বসবাস করেও তিনি নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। পূর্ববর্তী নির্বাচনে এই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা, বিএনপি-জামাত সমর্থিত প্রার্থী লতুফা বেগমের কাছে তিনি হেরেছিলেন। তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আরো দুবার (২০১৫ ও ২০২০ সালে) নির্বাচিত হয়ে গত প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি একই সংরক্ষিত ওয়ার্ডে দায়িত্বপালন করছেন। বর্তমানে প্যানেল মেয়র-২-এর দায়িত্বেও রয়েছেন।
সরকারি সিদ্ধান্তে ২০০৮ সালের ১৪ মে চাঁদপুর সহ বাংলাদেশের অন্য সকল পৌরসভার চেয়ারম্যানগণ হয়ে যান মেয়র, আর কমিশনারগণ হয়ে যান কাউন্সিলর। সেমতে কমিশনার ফরিদা ইলিয়াস হয়ে যান কাউন্সিলর। সর্বশেষ অর্থাৎ বিজয়ের ধারায় তার তৃতীয় দফার নির্বাচনে (১০ অক্টোবর ২০২০) বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি প্যানেল মেয়র-২-এর মর্যাদা পান।
২০০৬ সালে নির্বাচিত হয়ে সোয়া দুবছর কমিশনার এবং পৌনে সাত বছর কাউন্সিলর অর্থাৎ নয় বছর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পান ফরিদা ইলিয়াস। কারণ, পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে সীমানা সংক্রান্ত জটিলতার প্রেক্ষিতে বারবার উচ্চ আদালতে রিট হয় এবং ঘোষিত নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যায়। ২০১৫ সালের ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ফরিদা ইলিয়াস দ্বিতীয় বার এবং ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৃতীয়বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভায় পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়ে অদ্যাবধি প্রায় ১৮ বছর (১৭ বছর ৭ মাস) দায়িত্ব পালনের সুযোগ ফরিদা ইলিয়াস ছাড়া অন্য নারীর ভাগ্যে জোটেনি। তৃতীয় মেয়াদের পুরো সময় সুস্থতার সাথে দায়িত্বপালন করতে পারলে তিনি ২০ বছর লাগাতার দায়িত্ব পালনের বিরল রেকর্ড করতে পারবেন।
মিসেস ফরিদা ইলিয়াস ভবিষ্যতে আর নির্বাচন করবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি চাঁদপুর কণ্ঠের 'নারীকণ্ঠ'কে বলেন, যতোদিন আমার শক্তিসামর্থ্য আছে, ততোদিন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবো এবং জনসেবা করে যাবো। 'কেন নির্বাচন করবেন' জিজ্ঞেস করতেই কিছুটা অশ্রুসজল হয়ে পড়লেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, আমার মা-বাবা নেই, সন্তান নেই, আমি জনগণ ছাড়া কার সেবা করবো? যতোদিন বেঁচে থাকবো, সুস্থ থাকবো অর্থাৎ আমার শক্তিসামর্থ্য থাকবে, ততোদিন জনসেবা করে যাবো। মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখবো।
ফরিদা ইলিয়াস চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ এবং বেড়ে উঠলেও তার পিতার আদি নিবাস কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চরপাইরা ইউনিয়নের চরপাইরা গ্রামে। বাবা আব্দুল গফুর শেখ (বর্তমানে মরহুম) মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন চাঁদপুরে। কারণটা ছিলো নিতান্তই ভয়জনিত। 'ওক্কা' (তামাক খাওয়ার উপকরণ) নিক্ষেপ করে রাখতে গেলে সেটি আঃ গফুর শেখের জেঠী আম্মার পায়ে পড়ে। এতে তার শাস্তি হতে পারে ভয়ঙ্কর --এই ভয়ে বাড়ি থেকে দৌড়ে পালালেন এবং ট্রেন ধরে চাঁদপুর চলে এলেন।
চাঁদপুর এসে জীবিকার প্রয়োজনে আঃ গফুর শেখ নানান কাজ করেন। এ সময় চাঁদপুর বড়ো স্টেশনে ইসলাম সর্দারের সাথে কাজ করা শরীয়তপুরের বাসিন্দা ছেরাজল তাঁতীর চোখে পড়েন কর্মঠ ও স্বাস্থ্যবান আঃ গফুর শেখ। বড়ো হলে তার কাছেই ছেরাজল তাঁতী তার মেয়ে সখিনা বেগমকে পাত্রস্থ করেন, যারা রেলওয়ে ক্লাব সংলগ্ন রেল শ্রমিক কলোনীতে বসবাস করতে থাকেন। আঃ গফুর শেখের ঔরসে একে একে জন্ম নেয় ১০ সন্তান। এদের মধ্যে পাঁচজন জীবিত ও পাঁচজন মৃত। আঃ গফুর শেখের জীবিত পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচে' বড়ো হচ্ছেন ফরিদা বেগম। বরিশালের বাসিন্দা, পুলিশ সদস্য ইলিয়াস হোসেনের সাথে তার বিয়ে হবার পর তিনি ফরিদা ইলিয়াস হয়ে যান এবং এই নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নিঃসন্তান। তাই শ্বশুর বাড়ির চেয়ে নিজ বাবার অস্থায়ী নিবাস রেল শ্রমিক কলোনীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং পিতার পদাঙ্ক অনুসরণে আওয়ামী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে, আর সাধারণ মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে থেকে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন, যেটি তাকে পৌরসভার কমিশনার/কাউন্সিলর হতে উদ্দীপ্ত করে। তার ছোট ২ ভাইদের একজন (আলমগীর) ও ছোট ২ বোনের একজন এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে তিনি একত্রে বসবাস করেন। ছোট দুবোনের মধ্যে রাবেয়া বেগম সরকারি চাকুরি করেন, যিনি তার সাথে থাকেন এবং আরেক বোন (রবিয়া বেগম) বৈবাহিক কারণে তরপুরচণ্ডী ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শহীদ কাজী বাড়িতে থাকেন, যিনি জুয়েল কাজীর সহধর্মিণী।
ফরিদা ইলিয়াস বর্তমানে চাঁদপুর যুব মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আওয়ামী রাজনীতিতে অনেক সক্রিয়। ‘কীভাবে রাজনীতিতে আসলেন’ জানতে চাইলে ‘নারীকণ্ঠ’কে বলেন, চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক কমিশনার কলিমুল্লাহ বেপারী (যিনি বর্তমানে মরহুম, জীবদ্দশায় 'কলু মেম্বার' হিসেবে ছিলো যার বহুল পরিচিতি)-এর হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হন এবং ওয়ার্ড শাখার মহিলা সম্পাদিকা পদে দায়িত্ব পেয়ে ব্যাপক সক্রিয় হয়ে উঠেন। ফরিদা ইলিয়াস জানান, পৈত্রিক সূত্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আমির খসরু এমপি (বর্তমানে মরহুম) তার আপন ফুফাতো ভাই। নানার দিক দিয়ে দেশখ্যাত ব্যবসায়ী হাজী কাউছ মিয়া তার আত্মীয়।
ফরিদা ইলিয়াসের দাবি, জনসেবার ক্ষেত্রে তার দলীয় পরিচয় কখনোই মুখ্য নয়। তিনি আওয়ামী লীগের লোকজনের পাশে তো অবশ্যই, তবে সুখণ্ডদুঃখ ভাগাভাগিতে এবং বিপদেআপদে দলমত বিবেচনা না করে সবার আগে সবার পাশে ছুটে যান। তার এলাকায় আওয়ামী লীগ-বিএনপির যে-ই মারা যাক, তার আগে কেউ যেতে পারে না। এমন মানসিকতায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ‘রত-আত’ (শক্তিসামর্থ্য) থাকা অবধি তিনি মানুষের সেবাই করে যাবেন, কেননা তাতেই তিনি অশেষ তৃপ্তি খুঁজে পান। এই তৃপ্তিতেই যেন তার বাকি জীবন কাটে--এজন্যে তিনি সকলের দোয়া ও মহান আল্লাহর কৃপা প্রার্থনা করেন।