প্রকাশ : ০৭ জুন ২০২৪, ০০:০০
চাঁদপুর কণ্ঠ : আমাদের প্রেমের ফসল
চাঁদপুর কণ্ঠ তার পথচলার ৩০ বছর অতিক্রম করেছে। নিশ্চয়ই এটি একটি আনন্দের সংবাদ। আঞ্চলিক সংবাদপত্রের জন্যে ৩০ বছর অতিক্রম করা নিশ্চিতভাবেই একটি মাইলফলক। ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের এই সুবর্ণ সময়ে চাঁদপুর কণ্ঠ এখনো তার যৌবন ধরে রেখে আপন গতিতে এগিয়ে চলছে--এটা আমাদের জন্যেও একটা খুশির খবর। চাঁদপুর কণ্ঠ তার পথচলার এ গতি ধরে রাখবে এবং আরো সামনে এগিয়ে যাবে--এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
সময়টা ১৯৯৪ সাল। ফরিদগঞ্জের চির্কা চাঁদপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে চাঁদপুর সরকারি কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হওয়া। ঠিক সেই সময়টাতেই চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার জড়িয়ে পড়া। লেটার প্রেসে তখন সাপ্তাহিক চাঁদপুর কণ্ঠ প্রকাশিত হতো। চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে না জড়ালে হয়তো লেটার প্রেসে পত্রিকা প্রকাশ করার সে কাজটা আমার জানা হতো না। তখন কোনো রকম সম্মানি ছাড়াই আমরা বেশ ক’জন তরুণ চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে কাজ করতে থাকি। এখনও সে সময়গুলোর কথা মনে পড়ে। সুন্দর এক অতীত। চাঁদপুরের সংবাদকর্মীদের মধ্যে এমন হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক এখন আছে কি না জানি না। ভবিষ্যতেও আসবে কি না আমার মনে হয় না।
চাঁদপুর কণ্ঠ লেটার প্রেস থেকে অফসেট প্রেসে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার ভাইয়ের স্ত্রী আমাদের বিলকিস ভাবীর নামে ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে একটি কম্পিউটার কেনা হয়। সে কম্পিউটার কেনা এবং পরবর্তীতে স্ক্যানারসহ সবকিছুকেই কম্পিউটারাইজড করার সাথে আমাদের বেশ ক’জনের শ্রমের কথা আমার এখনও মনে পড়ে। এটা চাঁদপুরের সংবাদপত্রের ইতিহাসে লেখা থাকবে। চাঁদপুর কণ্ঠের পরপরই ধীরে ধীরে সব পত্রিকা অফসেট প্রেসে চলে আসে। বিলুপ্তির পথে যাওয়া শুরু করে চাঁদপুরের লেটার প্রেসগুলো। জানি না এখন আর চাঁদপুরে কোনো লেটার প্রেস আছে কি না।
এবার নতুন পালা। নতুন চ্যালেঞ্জ। চাঁদপুর কণ্ঠ দৈনিক হবে। চাঁদপুরের সংবাদপত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের সবার কাছেই ব্যাপারটি ছিলো একটি বিস্ময়। এতো নিউজ কীভাবে কোথা থেকে পাওয়া যাবে। টেকনিক্যাল সাপোর্ট কীভাবে সম্ভব--এসব কিছু নিয়েই আলোচনা। যতটুকু মনে পড়ে ইকবাল ভাই তখন একটি হামলায় গুরুতর আহত ছিলেন। সাপ্তাহিক থেকে দৈনিকে রূপান্তরের অনুমোদন পাওয়ার পরই আমরা আর থেমে থাকিনি। সেদিনই দৈনিক পত্রিকা হিসেবে জন্ম নেয় চাঁদপুর কণ্ঠ।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের আনুষ্ঠানিক সংখ্যাটির কথা কখনোই ভুলতে পারবো না। কারণ এক নাগাড়ে ৩ দিন আমি নিজেও রাতে ঘুমাইনি। সারাদিন অফিসে কাটিয়েছি। আমার কম্পিউটারে পারদর্শিতার কারণে পুরো কাজের সাথেই সম্পৃক্ত থাকতে হয়েছে। জেলা শহর থেকে ৬০ পৃষ্ঠার এমন একটি উদ্বোধনী সংখ্যা এখনো করা সম্ভব কি না আমি জানি না। সে সময়গুলোর কথা আমাকে নাড়া দেয়। কারণ চাঁদপুর কণ্ঠ আমার প্রথম প্রেম। চাঁদপুর কণ্ঠে সবশেষ সহকারী বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। বার্তা সম্পাদক মির্জা জাকির ভাই তখন ব্রুনাইয়ে ছিলেন।
চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে জড়িয়ে আমি জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছি। ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ ছিলাম না। ৭৭৯ মার্কস্ নিয়ে এসএসসি পাস করা আমার আর পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠা হয়নি। দিনের বেশির ভাগ সময়তো চাঁদপুর কণ্ঠেই কাটাতাম। সপ্তাহে ২/৩ দিন গভীর রাত পর্যন্ত প্রেসেও থাকতে হতো। সাপ্তাহিক থাকাকালে অনেক সময় মেশিনম্যান নাজিরের অসহায়ত্ব দেখে তাকেও হেল্প করতাম। চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে আমার পথচলার ইতি ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিই একটি বিশেষ কারণে। সে প্রসঙ্গটি কোনো এক সময় বলবো হয়তো। আমার বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই আমার ফলাফল নিয়ে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে বিচলিত, ঠিক তখনই চাঁদপুর ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই।
আইসিএমবি (দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ)-এ ভর্তি হয়েই চাঁদপুর কণ্ঠ ছেড়ে ঢাকায় চলে আসা। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা। ৪/৫ মাস কেটে যাবার পরই আর এ পড়াটা কন্টিনিউ করা হলো না। জড়িয়ে পড়ি দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকায়। পাশাপাশি মাস্টার্সে ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। আজকের কাগজ, যুগান্তর, জাগো নিউজ, ঢাকা পোস্ট হয়ে এখন আবার ঢাকা পোস্টের পাশাপাশি যুগান্তরে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ আমার জীবন বদলে দিয়েছে। চাঁদপুর কণ্ঠকে আমি অনেক কিছু দিয়েছি মনে করি। আবার চাঁদপুর কণ্ঠ থেকে আমি কম নিইনি। আজকে আমার সাংবাদিকতা জীবনের যে অর্জন তার পিছনে চাঁদপুর কণ্ঠের ভূমিকা রয়েছে। চাঁদপুর কণ্ঠকে আমি এখনো মনে করি এটি আমার নিজের পত্রিকা। চাঁদপুর কণ্ঠের পথচলা নিশ্চয়ই আরো ভালো হবে। চাঁদপুর কণ্ঠ আঞ্চলিক সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি অনন্য নাম হিসেবে বিবেচিত হবে--এটাই আমার বিশ্বাস।
কৃতজ্ঞতা : চাঁদপুর কণ্ঠের সাথে জড়িয়ে আমি কিছু ভালো মানুষের সাথে মিশতে পেরেছি। যারা এখনো আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে বেশ ক’জন আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন অনন্তকালের ঠিকানায়। কিছু নাম না বললেই নয়- বাতেন ভাই, ওবায়েদ ভাই, কাজী শাহাদাত ভাই, মির্জা জাকির ভাই, আলম পলাশ, শাহাদাৎ হোসেন শান্ত, মিরন নাজমুল, সুমন, রাশেদ শাহরিয়ার পলাশ, গিয়াস উদ্দিন মিলন, রহিম বাদশা, রোকন, বিএম হান্নান, আবু সাঈদ কাউসারসহ আরো অনেকে। সময় করে একদিন এদের সবাইকে নিয়ে চাঁদপুর কণ্ঠের একটি স্মৃতি রোমন্থন অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা আছে আমার।
চাঁদপুর কণ্ঠের জন্যে আমার কিছু পরামর্শও রয়েছে। কাগুজে সংবাদপত্রের দিন এমনিতেই শেষ হয়ে আসছে। ডিজিটাল রূপান্তরের এ সময়ে চাঁদপুর কণ্ঠ খুব বেশি এগিয়েছে আমি বলবো না। তবে চাইলেই সম্ভব। রূপান্তরের এ অগ্রযাত্রায় চাঁদপুর কণ্ঠ আরো গতিশীল হবে--এটা আমার পরামর্শ। এ ক্ষেত্রে চাঁদপুর কণ্ঠ চাইলে আমি পরামর্শ ও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকুক। আরো সমৃদ্ধ কাগজ হোক। এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর; সম্পাদক, ঢাকা পোস্ট; সাবেক সহকারী বার্তা সম্পাদক, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ।