প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রহমান মৃধার দুটি লেখা
খেলাধুলার গুরুত্ব : গেল অলিম্পিকে বাংলাদেশের অবস্থা
অলিম্পিক গেমস বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া আসর। এখানে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো তাদের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের মাধ্যমে নিজেদের মেধা এবং পরিশ্রমের পরিচয় দেয়। সুইডেন, মাত্র এক কোটি লোকের দেশ, ইতোমধ্যে একাধিক পদক জয় করেছে। অন্যদিকে, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশে এই প্রতিযোগিতায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখা যায়নি। এর পেছনে মূল কারণ হিসেবে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবকে দায়ী করা যেতে পারে।
আমার সন্তানরা টেনিসে বিশ্বদরবারে সুইডেনের পতাকা উড়িয়ে সাফল্য অর্জন করছে, যা আমাকে গর্বিত করছে। কিন্তু এটি আমাকে একই সাথে কষ্টও দেয়, কারণ তাদের ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা উড়ানো। দেশের দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে তারা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটি শুধুমাত্র আমার নয়, সমগ্র জাতির জন্যে একটি বড় ক্ষতি।
ফুটবলহ্যান্টস অ্যাকাডেমি চালু করার সময় আমি দেখেছি কীভাবে দুর্নীতি এবং অনৈতিক কার্যক্রম প্রতিভার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। আমার লক্ষ্য ছিল দেশের ফুটবলে নতুন প্রতিভা তুলে আনা। কিন্তু দুর্নীতির কারণে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবে এই ব্যর্থতা আমাকে আরও দৃঢ় করেছে ক্রীড়াক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার জন্যে।
বাংলাদেশে ক্রীড়া ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্রীড়া ব্যবস্থায় দুর্নীতি এবং অপব্যবস্থা। অনেক প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সহায়তা না পেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। যাদের ক্ষমতা আছে তারা সুযোগ পাচ্ছে, আর যারা প্রকৃত মেধাবী তারা পিছিয়ে পড়ছে। ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের উপস্থিতি একেবারে নেই বললেই চলে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে যদি কোনো সাফল্য নিয়ে কথা বলা হয়, তবে ক্রিকেটে দেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করেছে এবং দেশের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু অন্যান্য খেলাগুলো, যেমন ফুটবল, হকি, টেনিস, গল্ফ, অ্যাথলেটিক্স ইত্যাদিতে তেমন সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। এর মূল কারণ ক্রীড়া ক্ষেত্রে সঠিক বিনিয়োগ এবং ব্যবস্থাপনার অভাব। ক্রিকেটে সরকারি এবং বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা কিছুটা ভালো থাকলেও, অন্যান্য খেলায় সেই মনোযোগ এবং বিনিয়োগের অভাব রয়েছে।
এবারের অলিম্পিক উদ্বোধনীতে বাংলাদেশের চিত্র
যখন বিশ্বের অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এক এক করে তাদের দেশের পতাকা তুলে অলিম্পিক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বোট যোগে প্যারিসের সেন নদী পার হচ্ছিল, তখন বাংলাদেশের বোটে খেলোয়াড়ের চেয়ে নেতা-কর্মীদের দেখে বুঝতে পেরেছি, কেন দেশের অধঃপতন, কিন্তু কেন এবং কে এর জন্যে দায়ী? রাষ্ট্র কি এ দায়ভার এড়াতে পারবে?
ক্রীড়া শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি জাতির সুনাম, গৌরব এবং পরিচয়ের প্রতীক। একটি দেশ যখন আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সফল হয়, তখন সেটি দেশের মানুষের মনোবল বৃদ্ধি করে এবং বিশ্বে দেশের পরিচিতি বাড়ায়। এছাড়া ক্রীড়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি সমাজের যুবকদের মধ্যে শৃঙ্খলা, দলগত কাজের মূল্যবোধ এবং নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ করে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে সবসময় একটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। যদিও ক্রিকেটে দেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য, তবুও অন্যান্য খেলায় তেমন সাফল্য আসছে না। এর কারণ ক্রীড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্নীতি, সঠিক বিনিয়োগের অভাব এবং ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা না থাকা। দেশের প্রশাসনকে ক্রীড়ার গুরুত্ব বুঝতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা করতে হবে। যদি ক্রীড়া ক্ষেত্রে সঠিক মনোযোগ এবং পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়, তবে বাংলাদেশও বিশ্বদরবারে নিজেদের স্থান তৈরি করতে পারবে, এ বিশ্বাস আমি করি।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্রীড়ায় প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের অভাব নেই। ক্রিকেটে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের স্থান তৈরি করেছে। ফুটবল, হকি, টেনিস, গল্ফ, অ্যাথলেটিক্স সহ অন্যান্য ক্রীড়ায়ও বাংলাদেশের প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ, প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ সুবিধার। সঠিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ এবং দুর্নীতি মুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াক্ষেত্রে উজ্জ্বল স্থান করে নিতে পারবে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রকে উন্নত করতে হলে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে :
১) দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ : ক্রীড়া সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
২) উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অবকাঠামো : প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের জন্যে আধুনিক সুবিধা প্রদান করতে হবে।
৩) সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা : ক্রীড়াক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে।
৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রীড়ার প্রসার : স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ক্রীড়া কার্যক্রমের উন্নয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়ন দেশের সুনাম বৃদ্ধি এবং জাতির মঙ্গল সাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন হওয়া এবং ক্রীড়ার বিকাশে অবদান রাখা। সঠিক পদক্ষেপ নিলে, একদিন বাংলাদেশের পতাকাও বিশ্ব দরবারে গৌরবের সাথে উড়বে এবং আমরা আমাদের ক্রীড়াবিদদের সাফল্যে গর্ববোধ করব। জাগো বাংলাদেশ জাগো।
হাতের শক্তি ও মহিমা
হাত আমাদের শরীরের একটি অনন্য এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মায়ের হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি, বাবার হাত ধরে সাহস পেয়েছি। নিজের হাতে নিজেকে গড়েছি। আমরা হাত ধরেছি, হাত ছেড়েছি, হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি। হাত তুলে প্রভুর কাছে মোনাজাত করি। হাতে হাত রেখে জীবনের সঙ্গী/সঙ্গিনী হই। হাত দিয়ে আমরা অর্থ উপার্জন করি এবং কুশলাদি বিনিময় করি।
হাত দিয়ে কতই না কী করি! পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে যাদের হাত নেই, জন্মের পর বা পরে কোনো কারণে হাত অচল হয়ে গেছে, তারাও হাত ছাড়া জীবনযাপন করে চলছে। হাত থাক বা না থাক, জীবনের সমাধান খুঁজে নেওয়া যায়। তবে হাত থাকলে জীবনের কাজগুলো সহজতর হয়। আমরা হাত দিয়ে ধরি, করি, অনুভব করি।
আমার বাম হাত টেলিফোনটি চোখের সামনে ধরে রেখেছে, ডানহাত ঝটপট করে লিখছে। চোখ দুটি ছোট্ট কীবোর্ড ও ডিসপ্লেতে নজর রাখছে। মন ভাবনাগুলোকে হাতের আঙ্গুলের সাহায্যে প্রকাশ করছে। মাঝে মাঝে সবকিছু থেমে যায়। তখন চোখ দুটি লেখাটি পড়ে, মন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে, দরকারে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে।
আমি এ মুহূর্তে একা, মন এবং জ্ঞানে নিরব, নিস্তব্ধ হয়ে শুধু কমান্ড ফলো করছি। আমার শরীরে কত শত কোটি কম্পোনেন্ট, কিন্তু সবকিছু কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে লিখছে! আমার দেহে একাধিক ‘নফস’ রয়েছে। একটি বিশেষ ‘নফস’ সবকিছু মনিটরিং করছে। আমি তার কমান্ড অমান্য করতে পারি না।
সবকিছু নেতৃত্বাধীন, কিন্তু মাত্র একজন নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমার হাতের আঙ্গুল থেমে যাচ্ছে, কারণ সে অর্ডার ফলো করছে। কিন্তু কার? আমার মনে হচ্ছে, যা কিছু চলছে সবই একটি বিশেষ ‘নফস’ কমান্ডের ওপর। এই ‘নফস’ দ্বারা যা কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তাকে আমরা আল্লাহ বলে ডাকি।
লেখার শুরুতে আমি হাত নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম, মনে হচ্ছিল হাত বিশাল কিছু। কারণ দুনিয়াতে হাতের অনেক ক্ষমতা, এমনকি আমার কাছেও। কিন্তু লিখতে গিয়ে বুঝলাম, হাতকে আমার দেহের ভেতর থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। হাত থেকে আত্মা, আত্মা থেকে ‘নফস’ এবং ‘নফস’ থেকে আল্লাহ---দ্য গ্রেটেস্ট অলমাইটি।
বাংলাদেশ ছেড়েছি চল্লিশ বছর আগে। যাবার বেলায় মা হাত দুটি ধরে বলেছিলেন, চিঠি দিয়ো বাবা। দূরপরবাস থেকে বহুবার চিঠি লিখেছি। বাবা-মা যখন এসেছেন, নিজ হাতে রান্না করে তাদের পরিবেশন করেছি। বাবা-মা মারা গেছেন, মাকে নিজ হাতে কবর দিয়েছি। মৃত্যুর পর নতুন জীবন শুরু হবে নাকি এ জীবন তখনই শেষ হবে চিরতরে, জানি না।
তবে আমি জানি, হাত ধরে হাঁটা একটি স্বাভাবিক ক্রিয়া। এখন জানি, হাত দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। হাতের গুণাগুণ সম্পর্কে জানার পর আমি বিশ্বাস করছি যে, আমার হাতের জোর বাড়ছে। আমি আমার কাজের মাধ্যমে হাতের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলছি। হাত নিজেই নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। আমি আমার হাত দিয়ে অনেক কিছু করতে পারি, এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমি কাজ করে চলছি।
অতএব, আমার হাত যেন আজীবন অন্যের দরকারেও বাড়িয়ে দিতে পারি সেই প্রত্যাশা করি। হাত, তুমি উদার এবং মহান হও।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।