প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
অতি সম্প্রতি জ্যাক ডোরসে টুইটারের সিইও থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন ভারতীয় আমেরিকান পরাগ আগারওয়াল! পরাগ আগারওয়াল ভারতের আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি) থেকে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট করে আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি করেন। তিনি ২০০১ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। শুধুই কি পরাগ আগরওয়াল?
ভারতের ২৩টি আইআইটিকে এখন বলা হয়ে থাকে বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানের সিইও তৈরির কারখানা। যেমন আইবিএম-এর সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণা আইআইটি কানপুরের গ্র্যাজুয়েট। গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই আইআইটি খড়গপুরের গ্র্যাজুয়েট। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেল্লা, অ্যাডোবের সিইও শান্তনু নারায়ণ, নোকিয়ার সিইও রাজীব সুরি, নোভারটিসের সিইও ভাসান্ত নারাশিমহান এরা সবাই আইআইটি গ্র্যাজুয়েট। কেবল আমেরিকার বড় প্রতিষ্ঠানই নয়, ভারতের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের অনেক সিইও আছেন যারা আইআইটির শিক্ষার্থী।
শুধুই কি সিইও দিয়ে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাপা যায়? অবশ্যই না। তবে এইটা একটা বড় সূচক তো অবশ্যই। আইআইটিগুলো সিইও তৈরি ছাড়াও অসংখ্য বিশ্বমানের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী তৈরি করেছে। এমনকি ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ হয়েছিলেন রঘুরাম রাজন, যিনিও একজন আইআইটি গ্র্যাজুয়েট।
আশা করি, উপরের কথাগুলোর দ্বারা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কতটা গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত দেশ কিংবা সভ্য দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান দিন দিন আরও উন্নত হয়।
ভারতের আইআইটিগুলোর দিকে তাকান অথবা বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি (ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স)-এর দিকে তাকান, দিন যতো যাচ্ছে ততোই এইগুলো আরও ভালো মানের হচ্ছে। দিন যতো যাচ্ছে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিমালা আরও কঠিন হয়েছে এবং একই সাথে বেতন ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের একজন সহকারী অধ্যাপকের বেতন শুরু হয় ১,৬০,০০০ ভারতীয় রুপি দিয়ে। ভারতে বাসা ভাড়া এবং নিত্যপণ্যের দাম বাংলাদেশ থেকে কম ছাড়া বেশি না। আমাদের দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সকল প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, শুরুতে যতোটা ভালো ছিলো একটা সময় পর থেকে মান নামতে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরুন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সত্যেন বোসের হাত ধরে কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের জন্ম হয়। কি সাংঘাতিক ঘটনা। ঠিক একই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন রসায়নবিদ, শিক্ষক ও উদ্ভাবক জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। যিনি আইআইটি খড়গপুরের প্রথম ডিরেক্টর। এরপর তিনি বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সাইন্সের ডিরেক্টর এবং পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। উনার সময়েই বেঙ্গালুরুর আইআইএসসি (ওহফরধহ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ ঝপরবহপব) প্রভূত উন্নতি হয়।
আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সত্যেন বোস, রসায়নবিদ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার, শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কিংবা সাম্প্রতিক কালের অধ্যাপক ড. এ কে এম রফিকউল্লাহ বা ড. এ এম হারুন অর রশীদের মতো শিক্ষক কি আছে? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, দিন যতো যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কেবল নামছেই।
মান যে নামছে সেটা গত ৩০ বছরের ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-এর ডাটা দেখলেও স্পষ্ট বোঝা যায়। অথচ এই অধঃপতন রোধ করা বা এ থেকে উত্তরণের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। শিক্ষার কোনো পরিবেশ যে নেই তা গত কয়েকদিনের সংবাদ শিরোনাম দেখলেও টের পাওয়া যায়। যেমন ‘সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই আতঙ্ক ঢাবি ক্যাম্পাসে’, ‘ঢাবিতে ক্যান্টিনের দেয়াল ভেঙে আহত ২’, ‘ঢাবির এফএইচ হলের রুমে রুমে গিয়ে ছাত্রলীগের হুমকি’! এইসব কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবাদ শিরোনাম হতে পারে? এসবের একমাত্র কারণ হলো দলান্ধ ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি।
ছাত্র রাজনীতির আগের সেই অতীত ঐতিহ্য নেই, কারণ যেই পরিবেশ অতীত ঐতিহ্য তৈরি করেছিল সেই পরিবেশ এখন আর নেই। বাংলাদেশে যেমন ছাত্র রাজনীতি হওয়ার কথা ছিলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আমরা কখনো সেই পথে হাঁটিনি। অথচ এই পঞ্চাশ বছরে বিশ্ব রাজনীতি, বিশ্ব অর্থনীতি এবং বিশ্ব পরিবেশের আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমরা সেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খেতে পারে এমন রাজনীতি তৈরি করিনি। আমাদের রাজনীতি হলো কাদা ছোড়াছুড়ি আর অতীতমুখী।
শুধুই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নামছে? শুধুই কি বিশ্ববিদ্যালয়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষার্থীর জোগান দেয় সেই স্কুল কলেজের মানের দিকে তাকান। খোদ আমাদের ঢাকা কলেজের দিকে তাকান। এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিলেন সত্যেন বোসের সহপাঠী বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার মতো বিশাল বিজ্ঞানী, যার নামে কলকাতায় সাহা ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার ফিজিক্স নামে প্রতিষ্ঠান আছে। এতো আগে যাওয়ার দরকার নেই, এইতো আশির দশকের দিকে অধ্যাপক জাহিদ হাসান, যিনি বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঞযব ঊঁমবহব ঐরমমরহং চৎড়ভবংংড়ৎ ড়ভ চযুংরপং, তিনি ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন।
সেই সময় ঢাকা কলেজ আর নটরডেম কলেজের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা হতো। এই দুই কলেজ থেকে বোর্ডে সবচেয়ে বেশি স্ট্যান্ড করতো। সেই ঢাকা কলেজ আর আজকের ঢাকা কলেজের কতো তফাৎ। সুখের কথা হলো, নটরডেম কলেজ আজও তার শ্রেষ্ঠত্ব বেশ খানিকটা ধরে রেখেছে।
একবার যদি কল্পনা করি, আমাদের নটরডেম কলেজ আর হলি ক্রস কলেজ এই দুটি মিশনারি কলেজ ছাড়া আর ভালো কোনো কলেজ নেই। সত্যি সত্যি যদি এই দুটো না থাকতো বাংলাদেশের শিক্ষার কোনো মানই থাকতো না। এই দুটো কলেজ আছে বলে আমরা এখনো কিছু ভালো ছাত্র পাচ্ছি।
একই কথা বলা চলে ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্ষেত্রে। একটা সময় ছিলো যখন এই কলেজটিও খুব ভালো করছিলো। আজকে এটি আর সেই জায়গায় নেই এবং আমি লক্ষ করছি এর মানও নি¤œগামী। এ রকম দেশের বিভিন্ন পুরানো জেলাতে কিছু সরকারি জেলা স্কুল ছিলো সেগুলোও খুব মানসম্পন্ন ছিলো। সেগুলোর মানও এখন অনেক খারাপ হয়েছে। সত্যি বলতে কি, এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও পাওয়া যাবে না যেগুলো জন্মের পর থেকে ভালো থেকে আরও ভালো করতে করতে দীর্ঘকাল ধরে এই ভালো থাকার ধারা অব্যাহত রেখেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা হলো আমরা এখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারিনি। আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে অতি রাজনীতিকরণ করেছি। বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের ভিসি, প্রোভিসি, ডিন, হলের প্রভোস্ট, এমনকি হলের আবাসিক শিক্ষক পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে যায়।
শিক্ষক নিয়োগে রাজনীতি ঢুকে গেছে। যখন যেই দল ক্ষমতায় যায় সেই দলের শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক হয়। এতো রাজনীতি থাকলে শিক্ষা ও গবেষণা চলবে কীভাবে? আমি সকলের কাছে আহ্বান জানাবো, দেশকে বাঁচাতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করুন। শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫% বরাদ্দ দিন। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ দিন এবং একই সাথে শিক্ষকদের জন্যে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করুন। দেশে বিশ্বমানের ইন্সটিটিউট স্থাপন করুন সেখানে সহ¯্র ট্যালেন্ট হান্ট নামে প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশ-বিদেশ থেকে মেধাবীদের হান্ট করে নিয়োগ দিন। ট্যালেন্ট হান্ট করতে হলে উচ্চমানের সুযোগ দিয়ে যোগ্য জায়গায় নিয়োগ দিতে হবে। নিয়োগ পাওয়ার পর যেনো তারা কাজ করতে পারে সেই পরিবেশও দিতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহিদ হাসান যদি বাংলাদেশে আসেন তিনি কোনো কাজ করতে পারবেন না। কারণ সেই মানের কাজ করার পরিবেশ বাংলাদেশে নেই। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম দেশে এসেছিলেন। আসার পর তেমন কোনো বড় কাজ কি তিনি করতে পেরেছিলেন? বর্তমানে দেশের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যেই পরিবেশ বিরাজ করছে সেখানে বিশ্বসেরা গবেষকদের আনলেও বরং তার মেধা হত্যা করা হবে। তাই শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন, অধ্যাপক,
পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।