প্রকাশ : ২১ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
ছোট্টগ্রামটা খুব সুন্দর। নামটাতার চেয়েও সুন্দর। চরণদ্বীপ। হয়তো চরণ রাখার মতো ভূমি থেকেই এই গাঁয়ের উৎপত্তি। তাই নাম হয়েছে চরণদ্বীপ। উত্তরে গ্রামের গা ঘেঁষে চলে গেছে এক পাহাড়ি নদী। নদীতে ক্যাঁক্রোত ক্যাঁক্রোত শব্দে সাম্পান চলে সারি বেঁধে। পাহাড় থেকে তারা কলা নিয়ে আসে। সেই কলা বিক্রির জন্যে নিয়ে যায় শহরে। মাঝে মাঝে জেলে নৌকোগুলো জাল ফেলে মাছ ধরে। গ্রামের দক্ষিণ দিকে চলে গেছে এক মাটির সড়ক। সোজা নদীর দুইপাড় সংযোগকারী সেতু পর্যন্ত। গ্রামের দক্ষিণ দিকের সড়ক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে এক তেঁতুলগাছ। লোকেরা বলে সেই গাছের উপর একটা ভূত আছে। সব সময় সে ভূত সবাই দেখে না। যারা একটু গভীররাতে ঐ রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতো তাদের অনেকেই সে ভূতের কবলে পড়েছে। গ্রামের অঞ্জন দাদু শহরে চাকরি করতেন। তিনি প্রতিদিন ভোরে গ্রাম হতে অফিসে যেতেন আর রাতের দশটা করে ঐ রাস্তা দিয়ে অফিস শেষে ফিরতেন। ছুটির দিনে এ রুটিনে ছেদ পড়তো। তাকে গল্প করতে শুনেছি, একদিন শীতের রাতে তিনি অফিস থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। তখন নাকি তেঁতুলগাছের নিচে আসার পর তিনি দেখলেন এক ইয়া লম্বা ভূত তার পথ আটকে আছে। তার বাঁশের মতো লম্বা দুটো পা বিস্তারকরেতাকেনাকিসুরেবলছিলো, তুঁই নিঁচ দিঁয়ে যাঁ। তুঁই নিঁচ দিঁয়ে যাঁ। অঞ্জন দাদুভয় পেয়ে উল্টোদিকে এমন দৌড় মেরেছিলো, দৌড়াতে দৌড়াতে তার আর হুঁশ নাই। পরদিন তাকে হাসপাতালের বেডে পাওয়া গেল, দুপায়ে ব্যা-েজ। দুটো পা-ই রাস্তার পাশে অগভীর ডোবায় পড়ে আছাড় খেয়ে ছুলে গেছে। ডান পা মাঝখানে গেছে ভেঙ্গে। কী হয়েছিল তা তিনি অনেকদিন বলতে পারেননি। তবে ভালো হওয়ার পর থেকে আর তিনি ঐ পথ মাড়াননি। অনেকদিন আগে হওয়া এ ঘটনা ইদানীং সবাই প্রায় ভুলে গেছে। অঞ্জন দাদুর দুর্ঘটনার পরও কেউ তেঁতুলতলা দিয়ে আসা-যাওয়া বন্ধ করেনি। কারণ সেটাই গাড়ি চলাচলের মূল সড়ক।
গ্রামের একটা ঐতিহ্য আছে। এ গ্রামে বৃটিশ আমলের অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেনের বেশ কয়েকজন অনুসারী কর্মী ছিল। সে কারণে অনেকেই এ গ্রামকে সমীহ করে। এঁদের মতো বিপ্লবীদের নাম সবাই বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এ গ্রামের মানুষের জীবিকা বিভিন্ন রকম। তবে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত মানুষও কম নয়। এদের একজন হলেন হিমাংশু দাদু। তিনি চৌধুরী পাড়ায় রাতে টিউশানি করতে যেতেন। ঐ পাড়ায় পর পর তিন বাড়িতে তিনি টিউশানি করে রাত এগারটার দিকে বাড়ি ফিরতেন। টিউশানি শুরু করতেন বিকেল পাঁচটায় আর শেষ হতো রাত দশটায়। তার বাবা অদীন মাস্টারও মাস্টারি করতেন। মাস্টারের ছেলে হিমাংশু মাস্টারের বাড়ি ফিরতে ছোট ছোট পদক্ষেপে এক ঘন্টা লেগে যেত। তার একটা বদভ্যাস বা মুদ্রাদোষ ছিল। প্যান্ট লম্বায় যতটুকুই হোক না কেন তিনি তবু একহাতে প্যান্টের একটা খুঁট ধরে হাঁটবেন। তিনি ধীরস্থির এবং ঠাণ্ডা মেজাজের। তিনি মাস্টারির জন্যে এক উপযুক্ত চরিত্র বটে। একটু বেশি বয়সে পিটিআই ট্রেনিং করেছেন। তাদের যৌবনে এই ট্রেনিং অতো সহজ ছিল না। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতো।
যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন ছিলো শীত শুরুর অমাবস্যা। বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। তাই একটু বেশিক্ষণ সময় দিতে হলো ছাত্রছাত্রীদের। পরদিন ইংরেজি পরীক্ষা। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিতে কাঁচা। তারা ইংরেজিকে বাঘের মতো ভয় পায়। তাই পুরোসিলেবাস একটা রিভিশন না দিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না। যতই তাদের বলছেন, তোরা গ্রামারটা ঠিক করলে পাশ করবি, তারা ততো তাকে ইংরেজি রচনা নিয়ে যন্ত্রণা দেয়। স্যার, অ্যাসেটা ছোট করে দেন, অ্যাসে এর কথাগুলো কঠিন... ইত্যাদি। পড়ানো শেষ করে হিমাংশু মাস্টার বাড়ির পথ ধরলেন।
শীতের রাতে একদিকে যেমন কুয়াশা তেমনি অন্যদিকে ঘনঘোর। দুইহাত দূরের জিনিষও পরিষ্কার দেখা যায় না। এ রকম রাতে আটটা না বাজতে শহরেই মানুষ ঘরে ঢুকে যায়। আর এটাতো গ্রাম। চারদিক সুনসান নিরবতা। কেবল মাঝে মাঝে গাছের পাতা হতে ঝরে পড়া শিশিরের শব্দ। কখনো কখনো দুয়েকটা বাদুরের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যায়। হিমাংশু মাস্টারের সে রাতে ঘরে ফিরতে ফিরতে প্রয়োজনের চেয়ে অধিক দেরি হয়ে গেল। শীতের ঠাণ্ডা হতে রেহাই পেতে তিনি কান ঢেকেছেন দুবাইওয়ালা ভাতিজার উপহার দেওয়া মাফলার দিয়ে। কিন্ত নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতার কারণে তিনি দূরের শব্দও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলেন। যে তেঁতুল গাছে ভূত থাকে সে তেঁতুলগাছের তলায় এলে তিনি কখনও ভয় পাননি। আজও কোন ভয় পেলেন না। তিনি আপনমনে হাঁটতে হাঁটতে তেঁতুলগাছের ছায়া পার হয়ে গেলেন। মনে মনে তার হিসেব চলছে। বড় মেয়েটার বিয়ের জন্যে পাত্র আসছে। সামনের মাসে আরো একটা টিউশানি বাড়াতে হবে।
সাত-পাঁচ সংসারের ঝুটঝামেলা ভাবতে ভাবতে তিনি বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে পড়লেন। ঠিক এসময় তার কানে এক ছাগশিশুর কান্না এসে পৌঁছালো। যতই তিনি এগুচ্ছিলেন সামনে ততই তার কানে এ শব্দ ক্রমশ তীব্র হতে লাগলো। তার মনে হলো, তাদের ছাগল আর তার বাচ্চাকে কেউ বিকেলে দক্ষিণের ক্ষেতে চরতে দিয়ে হয়তো বাড়ি ফিরিয়ে নিতেনভুলে গেছে। আজকাল ছেলেমেয়েরা যা ভুলোমনা হয়েছেনা! তিনি মনে মনে তাদের ওপর একচোট রাগ ঝাড়লেন। তারপর তিনি দক্ষিণের ক্ষেতে নেমে পড়লেন ছাগশিশুর সন্ধানে। তিনি যত এগিয়ে যান ক্ষেতের ভিতর ততই ছাগশিশুর কান্নার শব্দ দূরে সরতে থাকে। তিনি তবু এগোতে থাকেন সামনে। কখনো কখনো মনে হচ্ছে, ছাগশিশু একটা নয়, একাধিক। মনে হচ্ছে চারদিক থেকেই ডাকছে। বড়োই করুণ সে আর্তনাদ। অনেকটা বিপদে পড়লে যে রকম মানুষের শিশুরা কাঁদে সে রকম। ম্যা ম্যা করে একটানা কেঁদে যাচ্ছে ছাগ শিশুটি। হাতে যে টর্চ ছিলো তা আর জ্বলছে না। শেষ টিউশানির বাড়ি হতে বের হওয়ার পর জ্বালাতে গিয়ে কিছুদূর এসে নিভে গেছে। মনে হচ্ছে নতুন একজোড়া ব্যাটারি কিনতে হবে। আজকাল ব্যাটারিগুলোও যেন ভেজাল হয়ে গেছে। আগেবএকজোড়া ব্যাটারি কিনলে মাস খানেক যেতো। এখন আর যায় না। মাসের আধেক পার হলেই তা অকেজো হয়ে যায়। এদিকের জমিতে তাদেরও একটা ক্ষেত আছে। নিজেদের ক্ষেতে তারা আলু লাগিয়েছে। নিজের ক্ষেত পার হয়ে প্রতিবেশির ক্ষেতে হিমাংশু দাদু এসে পড়েছেন।
মাত্র নতুন ক্ষেত করেছে কেউ মূলা আর মরিচের। মাঝে মাঝে পিঁয়াজের সারি। সেগুলো মাড়িয়ে তিনি চলছেন ছাগশিশুর ভেসে আসা কান্নার সন্ধানে। আর একটু সামনে গেলেই নাপিত খালি। এটা একটা খাল যেটা কর্ণফুলির বুক হতে বয়ে চলেছে গ্রামের দিকে। হিসেব করে দেখলে এখন জোয়ার হওয়ার কথা নদীতে। সে নদীর পানি এসে খালটাকে টই টম্বুর করে দিয়েছে হয়তো। হিমাংশু মাস্টারের আর সেদিকে খেয়াল নেই। তার মাথায় কেবল দক্ষিণের ক্ষেতে আটকে থাকা ছাগশিশুর ডাক প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এতো আঁধারে হিমাংশু দাদু তার নিজের হাতে বাঁধাঘড়িও দেখতে পাচ্ছেন না। তবুও পথ চলছেন হাতড়ে হাতড়ে। এ জমি তার চিরচেনা। ছোটবেলায় তিনি নিজে জমিচাষের সময় কতদিন মইয়ে চড়ে মজা লুটেছেন! শীতের ক্ষেতে কাঁচা টম্যাটো আর কাঁচা মরিচণ্ডলবণ দিয়ে কচ্ কচ করে খেয়েছেন ছেলেবেলার বন্ধুরা মিলে। হাঁটতে হাঁটতে সেদিনের কথা মাথায় ঝিলিক দিলেও ছাগশিশুর ক্রমাগত কান্না তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
বাড়িতে অনেকক্ষণ ধরে ভাত নিয়ে বসে আছে হিমাংশু দাদুর বউ ছবি ঠাকুম্মা। প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা ভাত খেয়ে উঠতে না উঠতেই হিমাংশু দাদুবাড়িতে ঢোকেন। বাড়ি ঢুকেই বলেন, অ শিবুরমা, ভাত দাও। খিদে পেয়েছে। আজ তাকে সময়মত না আসতে দেখে তার বউ চিন্তিত হয়ে পড়ে। ছোট ছেলেকে হাতে একটা টর্চ লাইট দিয়ে তিনি পাঠালেন হিমাংশুর খোঁজে। ছোট ছেলে সবেমাত্র গ্রামের কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে। বাবার সন্ধানে ছেলেটা গ্রামের শিশিরভেজা মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করে। গ্রামে একটা রেওয়াজ প্রচলিত আছে। কেউ কাউকে খুঁজে ডাকলে উঁচু গলায় সুর করে নামধরে ডাকে। তাতে ডাক অনেক দূরে যায়। হিমাংশুর ছেলেও দখিনের ক্ষেতের পাশের রাস্তায় এসে জোরে ডাক শুরু করলো, ও বাবারে এ এ এ। তার ডাক দূরের ঘন বনে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসলো কয়েকশ ডাক হয়ে। এভাবে দুয়েকবার ডাকার পর তা হিমাংশুর কানে গেল। ছেলের ডাক শুনে হিমাংশুর চেতনা ফিরে এলো। হিমাংশু তার ছেলের ডাকের উত্তর দিয়ে দ্রুত রাস্তায় উঠে এলো। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো, ছাগল আর বাচ্চাকে আড়ালে (ছাগলেরবাথান) নিয়েছে কিনা। তার ছেলে রিটু আসতে আসতে হিমাংশুকে জানালো, সন্ধ্যার আগে আগেই সে ছাগল আর বাচ্চাকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়েছে। ছেলের কথা শুনে হিমাংশু আর কথা বাড়ালো না। ছেলেকে কিছু না বলে জোর কদমে ছেলের হাত ধরে বাড়িতে ঢুকে গেল। পরের দিন সকালে রোদ ওঠার পর সবাই সচল হয়ে উঠলে, হিমাংশু আবার একা একা ওই জায়গায় গেল। গিয়ে দেখে, যে জায়গায় ছাগশিশু ডাকছিল বলে মনে হয়েছিল, সে জায়গায় বিরাট একটা দাঁড়কাক মরে পড়ে আছে। কাকটা অস্বাভাবিক কালো আর আকারে বেশি বড়। হিমাংশু দাদুতা দেখে ঘেমে উঠলেন জব জব করে।