শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২২, ০০:০০

মাটি খেকো
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া

কুদ্দুসের আর কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু একটাই। মানুষের যে কয়টা হাত, চোখ আর নাক, কান থাকে তারও সে কয়টাই আছে। কুদ্দুস যখন কথা বলে তখন তার শ্রুতিমধুর গলার স্বরে মানুষ থমকে দাঁড়ায়। তার শরীরে বা মনে, চিন্তায় বা ভাবনায় আর কোন সমস্যা নেই। তার সমস্যা ওই একটাই। ওহ্! কুদ্দুসকে তোমরা কেউ চিনো না তাই না? চিনিয়ে দিচ্ছি। কুদ্দুস হলো মা-বাবাহীন একটা বারো বছরের কিশোর। আমার মত। ঠিক এ বয়সে আমার যা যা করতে মন চায় এবং করি, কুদ্দুসও তাই তাই করে। কুদ্দুসের মন ভালো থাকলে মাঝে মাঝে সে গলা খুলে গানও গায়। সে তো আর গান শিখেনি। কিন্তু রেডিও-টিভিতে শুনে শুনে সে গান গাওয়া শিখে ফেলেছে। তবে কুদ্দুস স্কুলেও যায়। বড় রেল স্টেশনে এরকম শিশুদের লেখাপড়া করায় একটা সংগঠন। তারা বিকেলের দিকে তাদের ক্লাস নেয়। একজন নানাভাই তাদের পড়ালেখা করার খাতা-কলম দেয়। নানাভাইয়ের মনে অনেক মায়া এই শিশুদের জন্যে। উনি সবার নানাভাই। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও তাকে নানাভাই ডাকে। জনতার নানাভাই। কুদ্দুস নানা ভাইয়ের সে স্কুলে পড়ে। তারাই প্রথম কুদ্দুসকে রেল স্টেশন থেকে এনে এই স্কুলে নাম লিখিয়ে দিয়েছে। কুদ্দুস এখন দেখতে বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে। শহরে মানবতার দেয়ালে অনেক কাপড়-চোপর ঝুলছিল। কুদ্দুস সেই দেয়াল থেকে নিজের জন্যে কাপড়-চোপড় বেছে নিয়েছে। এই কুদ্দুসকে দেখলে কেউ বলতে পারবে না তার একটা বড় সমস্যা রয়েছে। লেখাপড়া শিখার পর থেকে সে কারও সাথে তার এই সমস্যা নিয়ে কথা বলেনি। কুদ্দুস দিনকে দিন সেই একই সমস্যা নিয়েই বড় হচ্ছে।

কুদ্দুসের বাবা-মা কে তার কোন হদিশ নেই। তার তার কোন আত্মীয়-স্বজন আছে কি না তা-ও সে জানে না। তার বাড়ি বা ঠিকানা জানার কোন প্রশ্ন নেই। কুদ্দুস কীভাবে ছোট থেকে বড় হলো তাও সে বলতে পারে না। কুদ্দুসের দুই বছর বয়স থেকে স্মৃতিগুলো খেয়াল আছে। তার দুই বছর বয়স থেকে তার মাতাকে এই রেলের প্ল্যাটফর্মে রেখে হারিয়ে গিয়েছিল কোথায় জানি। দুই বছরের কুদ্দুস তারপর সারাদিন স্টেশনে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে হেঁটে এখানেই বড় হয়েছে। অনেকেই তাকে ভিখারির বাচ্চা বলে মনে করে তার দিকে আর তেমন মনোযোগ দেয়নি। প্রতিদিন আমি স্কুলে যাওয়ার সময় রেল স্টেশনে কুদ্দুসকে দেখি। কখনো উদোম গায়ে, কখনো তার চেয়ে বড় ঢাউস কোন ছেঁড়া পুরানো পোলো শার্টে। এখন কুদ্দুসের বয়স বার বছর। রেল স্টেশনে সে যাত্রীদের বোঝা টেনে দশ-পাঁচ টাকা পায়। তার খুব বেশি টাকা লাগে না। স্টেশনের বেঞ্চে কুদ্দুস রাতে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে রেলের পুলিশ তাড়িয়ে দিলেও আবার এসে সে ঘুমোয়। কুদ্দুসের কোন বাকশো-পেটরা নেই। কেবল দেহখানা সম্বল। তার মায়াময় চোখ। যে কেউ দেখলে মনে করবে ছোট দুখু মিয়া। নানাভাইয়ের স্কুলে তার মতো আরো অনেকেই পড়ে। ভিভিয়ান দাদার মতো ভালো মানুষ হয় না। খুব আদর করে উনি পড়ান। তার পড়ানোর গুণেই কুদ্দুস এখন ইংরেজি বর্ণমালাও পড়তে পারে। ভিভিয়ান দাদা কুদ্দুসকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছে। বড় হওয়ার স্বপ্ন। অনেক বড় স্বপ্ন। কুদ্দুসকে কেউ দুপুরবেলা কিংবা রাতের খাওয়ার সময় দেখে না। সে কোথায় থাকে এ সময় কে জানে। অবশ্য তার খোঁজ রাখারও কেউ নেই। কারও গরজও নাই তার খবর রাখার।

কুদ্দুসের এই সমস্যার কথা কেউ জানে না। এমনকি ভিভিয়ান দাদাও জানে না। জানবে কোত্থেকে? সে তো এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেই না। ওই একটা সমস্যা ছাড়া কুদ্দুসের জীবনে আর কোন সমস্যা আপাতত নেই। মা-বাবা এ পৃথিবীতে অনেকেরই নেই। ঘরবাড়িও হাজার হাজার মানুষের নেই। এসব কোন সমস্যাও নয়। কুদ্দুসের যে সমস্যা ওটা আসলে এখন আর তার জন্যেও কোন সমস্যা নয়। কিন্তু সমস্যা হলো যদি কেউ তা দেখে ফ্যালে তার জন্যে।

নানাভাইয়ের গণস্কুলে এবার দালান উঠবে। দালান মানে মেঝে আর দেয়াল পাকা। তবে চাল হবে টিনের। দোচালা ঘরের মতো। বড় স্টেশনের এ জায়গাটা রেলওয়ের। তাই এখানে স্থায়ী কিছু করা সম্ভব নয়। আপাতত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্যে স্কুল চালাতে ডিসি সাহেব টেম্পোরারি ঘর তুলতে অনুমতি দিয়েছেন। তবে শর্ত আছে। সরকারের প্রয়োজনে যে কোন সময় উচ্ছেদ করা হবে। নানাভাই তাতেই রাজি। তিনি একজন লায়ন। লায়ন মানে একটা সেবা সংগঠনের সদস্য। অর্থাৎ তিনি লায়নিজম করেন। এর সদস্য হিসেবেই তিনি লায়ন। তার মানবিক কাজ করার হৃদয় অনেক বড়। রজনীগন্ধা নামে তার একটা আবাসিক হোটেল আছে। সেই আয় হতে তিনি এসব কাজে কিছুটা ব্যয় করেন। নানার স্কুলের ভিত্তি নির্মাণের জন্যে মাটি খোঁড়া হলো। তারপর আস্তে আস্তে গাঁথুনির আয়োজন চলছে। মোট কাজ সম্পন্ন হতে প্রায় মাসখানেক লাগবে বলে মনে হচ্ছে। রাতে এই স্কুল পাহারা দেওয়ার জন্য দুই-তিনজনকে কাজে লাগানো হলো। কুদ্দুসও এদের মধ্যে একজন।

দিনগুলো গড়িয়ে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারে। রাতে পাহারা দিয়ে আর দিনে রেলস্টেশনে কুলিগিরি করে কুদ্দুসের দিন যাচ্ছে। এর মধ্যে মিস্ত্রি খেয়াল করলো স্কুলের ভিত্তি খোঁড়ার মাটি কমে গেছে। মনে হয় কেউ তাদের না বলে নিয়ে গেছে। নিলে নিক। এ মাটি তাদের কোন কাজে আসবে না। যিনি হেডমিস্ত্রি তিনি কুদ্দুসদের ভালোমতো পাহারা দিতে বললেন। কারণ দেয়ালের কাজ প্রায় সমাপ্ত। এখন শুধু চাল উঠবে। পরদিন বিকেলে ভিভিয়ান দাদা এলো স্কুলে। কুদ্দুসদের ক্লাস নিতে। তিনি কুদ্দুসের মুখের কোণে মাটি দেখে তাকে মুখ ধুয়ে আসতে বললেন। ভিভিয়ান দাদার কথা শুনে কুদ্দুস ভড়কে গেলো। সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলো মুখ ধুয়ে আসতে। কুদ্দুস আসার পরে পড়ানো শুরু হলো। আজকের পড়ার বিষয় হলো মাটি।

ভিভিয়ান দাদা পড়ানো শুরু করলেন। মাটি হলো বিভিন্ন উপাদানের সমষ্টি। এতে বিভিন্ন খনিজ যৌগ থাকে। শতকরা পঁচিশ ভাগ পানি থাকে মাটিতে। এতে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম প্রভৃতি উপাদান মিশে আছে। মাটি হলো সকল পুষ্টির গুদাম ঘর। কুদ্দুসের মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো আজকের পড়াটা তার খুব মনে ধরেছে। সে খুব সহজেই পড়া মুখস্থ করে ভিভিয়ান দাদাকে দিয়ে দিল। ভিভিয়ান দাদা কুদ্দুসের এই পারফর্মেন্সে খুব খুশি হলো। খুশিতে ভিভিয়ান দাদা কুদ্দুসকে বললো, চল, আজ তোকে আমি বিরিয়ানি খাওয়াবো। বিরিয়ানির কথা শুনে কুদ্দুসের হিক্কা উঠে গেলো। সে জোর গলায় বললো, নানা, আমি বিরিয়ানি খাবো না। ভিভিয়ান দাদা অবাক হলো। ওর বয়সী এবং ওর মতো শিশুরা যেখানে বিরিয়ানী খেতে পাগল, সেখানে কুদ্দুস বিরিয়ানী খেতে চায় না! ভিভিয়ান খুব আশ্চর্য হলো। সেদিন রাতে হটাৎ ঝড় উঠলো খুব। বাতাসের গতিবেগ খুব বেশি। ফণীর চেয়ে কম নয়। ভিভিয়ান কুদ্দুসদের জন্যে ভয় পেলো। তাদের যদি কিছু হয়ে যায়? সে নানাভাইকে ফোন দিলো। নানাভাই ভিভিয়ানকে বললো, ওকে চলো, তুমি আর আমি মিলে বড় স্টেশন গিয়ে ওদের দেখে আসি। ভিভিয়ান দাদা আর নানাভাই নির্মাণাধীন স্কুলঘরের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো। যাদেরকে স্কুলঘরের পাহারায় রেখে গিয়েছিলো তারা কেউই নেই, কেবল কুদ্দুস ছাড়া। কিন্তু কুদ্দুসকে তারা যে ভঙ্গিতে দেখলো তাতে তাদের চোখ উঠে গেছে কপালে। এটা আদৌ কুদ্দুস নাকি তার ভূত তা তারা বুঝে উঠতে পারছে না। তারা দেখলো, কুদ্দুস গপ গপা গপ স্কুলের চারপাশে রাখামাটি গিলে চলেছে। প্রায় দুই-তিন মিনিট দেখার পর তারা উভয়েই কুদ্দুসকে হাতেনাতে মাটি খেতে ধরে ফেললো। তাদের হাতে ধরা পড়ে কুদ্দুস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কেঁদে দিলো। কিরে! তুই কান্দস্ ক্যান? তোকে তো আমরা কিছুই বলিনি। কুদ্দুস চোখের জল মুছে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে তাদের দিকে।

আচ্ছা বল, তোর এ সমস্যা কবে থেকে? কুদ্দুস কিছু বলতে চায় না। কিন্তু অনবরত জিজ্ঞাসার পর একসময় কুদ্দুস বলতে শুরু করে, নানাভাই, আমার দোষ নিয়েন না। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন আমার মায়ে আমারে রেল স্টেশনে ফেলাইয়া রেলে উইঠ্যা চইল্যা যায়। আমি আমার বাপেরেও দেহিনাই। দুই বছরের আমারে কেউ খাওন দ্যায় না। আমি ক্ষুধায় কান্দি। কেউ খাওন দ্যায় না। দিবো কত্থুন। আমার চারপাশে হেরাই তো কেউ খাওন পায় না। আমি ক্ষুধার চোটে কানতে কানতে ঘুমাইয়া পড়ি। ঘুমের ঘোরে ক্ষুধার চোটে হাতে মাটি খোঁচরাইয়া মুখে দেই। এইভাবে মুখে মাটি খাইতে খাইতে আমার অভ্যাস অইয়া যায়। আমি এখন মাটি ছাড়া আর কিচ্ছুই খাইতে পারি না। মাটি না খাইলে আমার পেটই ভরেনা। মাটি না খাইলে আমার ঘুমই আসে না। কেউ আমারেযখন কোনখাওন দ্যায়নাইতখন এই মাটিই আমারে বাঁচায়া রাখছে নানাভাই। আমি তাই এখনও মাটি খাই। গত দশ বছর ধইরা আমি মাটি খাইয়া বাঁইচ্যা আছি। এ বলে কুদ্দুস নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। কুদ্দুসের কথা শেষ হওয়ার আগেই সশব্দে কেঁদে ওঠে নানাভাই আর ভিভিয়ান দাদা। তাদের কান্না থামাতে কেউ যেন পারে না। কুদ্দুস অবাক হয়ে যায় তাদের কান্না দেখে। শেষমেষ নিজের কান্না থামিয়ে তাদের কান্না সে থামায়।

কুদ্দুস আজ ধরা পড়ে গেছে নানাভাই আর ভিভিয়ানের কাছে। কুদ্দুস একজন মাটিখেকো। কিন্তু কুদ্দুস ভয় পেয়েছিলো, হয়তো সে মাটি খায় তা জানলে নানাভাই আর ভিভিয়ান তাকে স্কুল থেকে বের করে দিবে। কিন্তু না। তারাতার কিছুই করলো না। কুদ্দুসকে নিয়ে তারা এক হোটেলে বসলো। নানাভাই একটা চিকেন বিরিয়ানির অর্ডার দিলো। কুদ্দুস অবাক হয়। নানাভাই আর ভিভিয়ান হলো সংখ্যায় দুইজন। কিন্তু বিরিয়ানি কেন একটা! একটু পরে টেবিলে বিরিয়ানি আসলো। সুন্দর ঘ্রাণ বিরিয়ানির। গরম ধোঁয়া ওঠা। নানাভাই বললেন, কুদ্দুস, হাত ধুয়ে আয়। তারপর খাওয়া শুরু কর। কুদ্দুস ইতস্তত করে। কিন্তু নানাভাই আর ভিভিয়ান জোরাজুরি শুরু করে দেয়। কুদ্দুস চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু নানাভাই তাকে ধরে রাখে। আজ থেকে তুই ভাত খাবি। তোকে প্রতিদিন আমিই ভাত খাওয়াবে। তুই শুরু কর কুদ্দুস। নানাভাই জোর করে কুদ্দুসের মুখে এক লোকমা বিরিয়ানি তুলে দেয়। কুদ্দুসের বিরিয়ানির গন্ধে মাথা ধরে যায়। খাবার গলা দিয়ে ঢোকে না। তার বমি আসে। ভক্ করে বমি করে দেয় কুদ্দুস। সে তীব্রভাবে ঘামাতে থাকে। ভয় পেয়ে যায় নানাভাই আর ভিভিয়ান। এক সময় জ্ঞান হারিয়ে বিরিয়ানির থালার ওপর মুখ থুবড়ে পরে কুদ্দুস।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়