প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০
গল্পটা চালাকু খানের। চালাকু খান খুব চালাক। ওর চালাকির যন্ত্রণায় সবাই অস্থির। কী ধরনের চালাকি করে চালাকু খান?
একদিনের কথা। চালাকুর মা বললেন, ‘যা তো চালাকু, তোর মামার সাথে দেখা করে আয়।’ চালাকু বললো, ‘মামা? কোন্ মামা?’
‘কোন্ মামা আবার? তোর মামা। আমার ভাই। আমার ভাই-ই তোর মামা। তোর মামাকে তুই চিনিস না?’
‘আমার মামা তো অনেকগুলো।’
মা অবাক হয়ে বললেন, ‘অনেকগুলো মানে? আমার তো একটাই ভাই। আর কে কে তোর মামা শুনি?’
চালাকু বললো, ‘চাঁদ আমার মামা, সূর্য আমার মামা, হালুম আমার মামা...’
‘হালুমটা আবার কে?’
‘হালুম হচ্ছে হালুম। একসময় আলুম থাকে। তারপর হালুম হয়ে যায়।’
মা চোখ দুটো কপালে তুলে বললেন, ‘মানে!’
দুচোখ নাচিয়ে চালাকু বললো, ‘মানে বাঘ। এই সহজ জিনিসটা বুঝতে তোমার এতক্ষণ লাগল? আসলে তোমরা কেউ আমার মতো চালাক নও।’
‘তা বুঝলাম। কিন্তু চাঁদ, সূর্য, বাঘ এরা তো সবারই মামা। দুনিয়ার সব মানুষের মামা। আমারও মামা।’
চালাকু অবাক হয়ে বললো, ‘তোমারও মামা!’
‘নয় তো কী? চাঁদকে কত মামা ডেকেছি!’
আরো অবাক হলো চালাকু, ‘চাঁদকেও মামা ডেকে ফেলেছ? কতবার ডেকেছ?’
‘অনেকবার। কেন?’
‘আমার মামাকে তুমি মামা ডাকতে পারলে?’
মা বললেন, ‘চাঁদমামার দখলদারিত্ব কী শুধু তোর একার? আর কারো নেই?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চালাকু। জানতে চাইল, ‘কে আগে চাঁদকে মামা ডেকেছে? তুমি না আমি?’
মা বললেন, ‘যেহেতু আমার বয়স তোর চেয়ে বেশি, কাজেই আমিই আগে চাঁদকে মামা ডেকেছি।’
‘ঠিক আছে মা, আমার মামার তালিকা থেকে একটা মামা বাদ পড়ল। আজ থেকে চাঁদকে আমি নানা বলে ডাকব।’
কপাল কুঁচকে মা বললেন, ‘সেটা তোর ইচ্ছে। ছোটবেলায় তোর বাবাও কিন্তু চাঁদকে মামা বলে ডাকত।’
‘তাহলে তো চাঁদ আমার দাদাও হয়। আচ্ছা থাক, সেটা কোনো বিষয় না।’
‘তোর নানা আর দাদাও কিন্তু ছোটবেলায় চাঁদকে মামা ডাকতেন।’
এবার কি যেন ভাবল চালাকু। তারপর বললো, ‘তুমি নিজে শুনেছ যে নানা চাঁদকে ছোটবেলায় মামা ডাকতেন?’
মা বললেন, ‘ধ্যাৎ গাধা। তোর নানার ছোটবেলার কথা আমি নিজের কানে শুনবো কেমন করে?’
রাগ করল চালাকু। মুখ ভার করে বললো, ‘তুমি আমাকে গাধা বললে কেন? কোনো গাধা কি আমার মতো চালাক হয়? বলো?’
‘কিছু কিছু গাধাও চালাক হয়। আর বক বক করিস না। তোর মামার সাথে দেখা করে আয়।’
‘মামাও কি চাঁদকে ছোটবেলায় মামা ডাকত মা?’
‘ডাকতই তো। সবাই চাঁদকে মামা ডাকে। তোর মামা, মামি, খালা, ফুফু, নানা, চাচা, দাদা, দাদি, নানি সবাই। চাঁদ সবার মামা।’
চালাকুর মন খারাপ হয়ে গেল। মুখটা ভার রেখেই বললো, ‘কেন যে চাঁদকে মামা বানানোর জন্য তোমরা সবাই টানাটানি করো, বুঝি না। চাঁদ কি তোমাদের সবার মামা ডাক শুনে সাড়া দিত?’
এবার মা নিজেই ভাবনায় পড়লেন। তাই তো! এটা তো কখনো ভেবে দেখেননি। কিন্তু মামা আর চাঁদ নিয়ে চালাকু বড্ড ঝামেলা করছে। আর ঝামেলা করতে দেয়া যায় না। মা বললেন, ‘দ্যাখ চালাকু, অনেক হয়েছে। আর না।’
‘কী বলো আর না! চাঁদের সাথে এখনও আমার সম্পর্কটা ঠিক হয়নি। মানে চাঁদকে আমি কী ডাকব এখনও সে সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি।’
এবার বিরক্ত হলেন মা। বললেন, ‘চাঁদ আর মামা নিয়ে বাড়াবাড়ি অনেক হয়েছে। এবার তোর সত্যিকার মামার কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যা।’
চালাকু আর কি করে! মায়ের সাথে তো চালাকি করতে পারে না। মায়ের সঙ্গে চালাকি করাও ঠিক না। এ কারণেই এতদিন করেনি। নইলে কবেই মায়ের কাছ থেকে চাঁদকে কেড়ে নিয়ে নিজের মামা করে নিতো। থাক। ও জানে মায়ের কোনো মামা নেই। এ জন্য নিশ্চয়ই মায়ের অনেক দুঃখ। চাঁদকে মামা ডেকে মামার দুঃখ ভুলতে চায় ভুলুক। মায়ের মামা হিসেবে চাঁদকে একেবারেই দিয়ে দিল সে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, আর কখনো নিজের মামা বলে চাঁদের পরিচয় দেবে না।
২.
চালাকুকে দেখে ভীষণ খুশি হলেন মামা। বললেন, ‘কী মনে করে রে?’
চালাকু বললো, ‘মা বললেন, তোর মামাকে দেখে আয়। তাই দেখতে এলাম। এবার তাহলে যাই।’
মামা অবাক হয়ে বললেন, ‘যাই মানে? কোথায় যাবি?’
‘কোথায় আর যাবো? বাড়িতেই ফিরে যাব!’
‘বলিস কি? মামাবাড়ি এসেই ফিরে যাবি?’
‘তোমাকে দেখা শেষ। আমার কাজ শেষ।’
‘দ্যাখ চালাকু, আমার এখানে কিন্তু কোনো চালাকি চলবে না। মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিস, দু-চারদিন থাকবি। তারপর যাবি। আমিই তোকে দিয়ে আসব। এসেছিস কার সঙ্গে?’
‘বাবার সঙ্গে। বাবা পৌঁছে দিয়ে চলে গেছেন। কিন্তু মা যে কেবল তোমাকে দেখতে বলে দিয়েছেন! এখানে থাকতে বলেননি।’
মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘একবারই দেখতে বলেননি। এখানে কিছুদিন থেকে থেকেই আমাকে দেখবি। বুঝেছিস? সব কথা তো আর ব্যাখ্যা করে বলতে হয় না।’
বুঝেছে। চালাকু বুঝেছে। কিন্তু মা কথাটা বুঝিয়ে বললে কী হতো? মা যদি বলতো তোর মামার কাছে থেকে মামাকে কিছুদিন দেখে আয়, তাহলেই তো সহজে বুঝে ফেলত।
মামা বললেন, ‘আয়, ঘরের ভিতর আয়। ব্যাগ রেখে দে ঘরে। বাইরে থেকে নাস্তা সারতে হবে।’
চালাকু বললো, ‘মামিকে একা রেখে যাব?’
‘তোর মামি বেড়াতে গেছে। তার বাবার বাড়ি। তার বাবার বাড়ি মানে আমার শশুরবাড়ি। বুঝেছিস?’
বুকটা টান টান করে চালাকু বললো, ‘কেন বুঝব না। আমার নাম চালাকু খান। নামেই আমার পরিচয়।’
চালাকুর পিঠ চাপড়ে মামা বললেন, ‘সে পরিচয় আমরা পাচ্ছি চালাকু। তোর কারণে আমরাও বিখ্যাত হয়ে যাব মনে হচ্ছে।’
নাস্তার পর চালাকুর হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলেন মামা। বললেন, ‘এটা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিস। এবার যা। ঘরে গিয়ে ঘুম দে। অফিস থেকে ফিরে তোকে নিয়ে ঘুরতে বেরুব।’
চালাকু চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকল। দরজা ভালো মতো আটকাল। তারপর কাপড় চোপড় ছেড়ে গোসল করে ঘুম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না। তবে ঘুমটা হয়েছে জম্পেশ। চোখ-মুখ ফুলে গেছে। আর ঘুম থেকে উঠে টের পেল, বেশ খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে ঢুঁ মারল। হাঁড়ি উল্টে-পাল্টে দেখল। নেই। ফ্রিজ খুলল। ফ্রিজেও নেই। কিচ্ছু নেই। ঘরে কোনো খাবার নেই। তখনই ওর মনে পড়ল, দুপুরের খাবার সেরে নেয়ার জন্য মামা একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছিলেন। আর মনে হতেই খুশি হয়ে ওঠল মন।
৩.
মামা এলেন সন্ধের দিকে। চালাকু দরজা খুলে দিল। চালাকুকে দেখেই মামা চমকে ওঠলেন। বললেন, ‘তোর একি হাল! কী হয়েছে?’
চালাকু বললো, ‘পেটে বেশ ব্যথা মামা।’
‘পেটে ব্যথা? কেন?’
‘জানি না। পেটের ভিতরে কেউ যেন কামান ছুঁড়ছে। গুড়–ম গুড়–ম করছে।’
‘দুপুরে খেয়েছিস?’
‘খেয়েছি।’
‘পুরো পঞ্চাশ টাকাই খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ মামা। পুরো পঞ্চাশ টাকাই খেয়েছি। তবু পেট ভরেনি।’
গ্রামের ছেলে। পঞ্চাশ টাকার খাবারে পেট না-ও ভরতে পারে। তাছাড়া খাবার-দাবারের যা দাম! মামার খুব খারাপ লাগল। খুব অনুশোচনায় ভুগতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলেন, চালাকুকে আরো বেশি টাকা দিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল।
রাতে চালাকুকে বড়সড় একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন মামা। ভরপুর খাওয়ালেন। আর চালাকুও যা খেল। প্রচুর। ওর খাওয়া দেখে মনে হলো, সকালের পরে আর কিছুই খায়নি।
৪.
পরদিন সকালেও হোটেলে গিয়ে চালাকুকে নিয়ে নাস্তা খেলেন মামা। তারপর অফিসে যাওয়ার আগে ওর হাতে একশ টাকার একটা নোট দিলেন। আর বললেন, ‘এটা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিস।’
বিকেলে ফিরে মামা জানতে চাইলেন, ‘আজ নিশ্চয়ই পেট ভরেছে?’
চালাকু বললো, ‘পেট তো ভরেইনি, উল্টো পেট ব্যথা আরো বেড়েছে। গতকালের চেয়েও বেশি।’
মামা অবাক হলেন। মোড়ের ওই রেস্টুরেন্ট ছাড়া এখানে আর কোনো ভালো খাবারের দোকান নেই। ওখানে একশ টাকার খাবারে যে কারোরই পেট ভরবে। তা সে যত বড় খাদকই হোক। তা-ও চালাকুর পেট ভরল না! আবার বলছে পেট ব্যথা। হাবিজাবি খায়নি তো!
মামা জানতে চাইলেন, ‘পুরো একশ টাকাই খেয়েছিস?’
চালাকু বললো, ‘হ্যাঁ মামা। পুরো একশ টাকাই খেয়েছি।’
‘একশ টাকার কী খেয়েছিস?’
‘একশ টাকাই খেয়েছি।’
‘একশ টাকা খেয়েছিস, সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু একশ টাকার কী খেয়েছিস?’
‘কী আর খাবো। একশ টাকা খেয়েছি।’
মামা একটু বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘আহ্! চালাকু। আমি যা জানতে চাইছি সেটা বল। একশ টাকা দিয়ে কী কিনে খেয়েছিস?’
মামার কথায় ভীষণ অবাক হলো চালাকু। চোখ দুটো কপালে তুলে বললো, ‘কিনে খেতে হবে নাকি? তুমি তো আমাকে কিনে খেতে বলে যাওনি।’
মামাও অবাক হলেন চালাকুর কথা শুনে। বলছে কি গাধাটা! টাকা দিয়ে তো কিনেই খেতে হয় চালাকু। তাহলে একশ টাকা কীভাবে খেয়েছিস?’
চালাকু বললো, ‘চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছি। কড়কড়ে নতুন টাকা, চিবোতে খুব কষ্ট হয়েছে মামা। গতকাল যে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিয়েছিলে, সেটা চিবোতে অবশ্য খুব একটা কষ্ট হয়নি। তবে আজ চিবোতে কষ্ট হয়েছে। কষ্ট হচ্ছে দেখে পানি দিয়ে গিলে গিলে খেয়েছি। তবু খিদে মেটেনি।’
মামা এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। চালাকুর মতো কেউ এতটা চালাক হতে পারে, তাঁর ধারনার বাইরে। ভাগ্যিস পেট খারাপ হয়নি। কেন যে হয়নি সেটাই রহস্য। আর যাই হোক, চালাকুর পেটের জোর আছে। ল্যাতল্যাতে পঞ্চাশ টাকার নোট আর টাটকা একশ টাকার নোট হজম করে ফেলেছে!
মামা বললেন, ‘তোকে টাকাই চিবিয়ে খেতে হবে কেন? তোকে তো চিবিয়ে খাওয়ার জন্য টাকা দেইনি। টাকা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য দিয়েছি।’
চালাকু বললো, ‘বা রে, তুমিই তো গতকাল পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বললে, এটা দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিস। আজ একশ টাকার নোট দিয়ে সেই একই কথা বলেছ। আমি তোমার নির্দেশ পালন করেছি মামা। মা বলে দিয়েছেন, মামা যা বলবে সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি। অন্য কোনো চালাকি করবি না। আমি তো চালাকি করে টাকা দিয়ে কিছু কিনে খেতে যাইনি।’
‘তাই বলে তোকে নোট চিবিয়ে খেতে বলেছি নাকি? ওই নোট দিয়েছি খাবার কিনে খাওয়ার জন্য।’
চালাকু বললো, ‘তাহলে সেটা ব্যাখ্যা করে বলবে না? তোমরা বড়রা কোনো কিছুই ব্যখ্যা করে বলো না। অর্ধেক কথা পেটে রেখে বলো।’
‘হয়েছে। আর প-িতের মতো কথা বলতে হবে না। এবার চল। রাতের খাবার খেয়ে নিবি।’
চালাকু বললো, ‘চল। খিদেয় আমার পেট চোঁ চোঁ করছে। এবার বুঝেছি, মানুষ কেন টাকা চিবিয়ে খায় না। কারণ টাকা চিবিয়ে খেলে খিদে মেটে না।’
মামা রাগ করতে গিয়েও পারেন না। বোকা হলে রাগ করতে পারতেন। কিন্তু এ হচ্ছে চালাকু। চালাকুর সাথে রাগ করা যায় না। তবু একবার বিড় বিড় করলেন, ‘গাধা!’
চালাকু শুনে ফেলল। শুনেই জানতে চাইল, ‘মামা কি আমাকে কিছু বলেছেন?’
‘বলেছি।’
‘কী বলেছেন?’
‘সব কিছু তোর শুনতে হবে নাকি?’
মামার মুখের দিকে তাকাল চালাকু। মামার মুখ থমথমে। মামার থমথমে মুখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পেল না চালাকু। মামার সাথে হাঁটতে লাগলো হোটেলের দিকে।