রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ১৮ জুন ২০২১, ১২:১৪

বারান্দায় ময়না টিনের চালে শালিক

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বারান্দায় ময়না টিনের চালে শালিক

আমাদের বাসার নিচতলায় রাহুলরা থাকে। রাহুলরা মানে তার বড় বোন রিয়া, প্রিয়া আর ছোট বোন বুলুসহ রাহুল। রাহুল আমার চেয়ে কয়েক মাসের বড়। রাহুলের বাবা বিজয়মেলা হতে একটা ময়না পাখি কিনে এনেছে। ময়নাটা খাঁচায় আটকানো। উত্তরদিকের বারান্দায় ময়নাটার আবাস। সে এখনো পুরোপুরি কথা বলতে শেখেনি। তবে ময়না, ময়না বলে মৃদুস্বরে ডাকতে পারে। ময়নাটা খুব কড়া করে শিস্ দেয়। তার শিস্ শুনে আমাদের দোতলার বাসায় বসে আমিও শিস্ দিতে শিখে গেছি। তবে মা শিস্ বাজাতে না করে। শিস্ বাজানো নাকি অশোভন। যাই হোক, ময়নাটা মোটামুটি একতলা-দোতলার সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রথম কিছুদিন ময়নাটাকে ডাইনিংরুমের প্রবেশদ্বারে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু সে ওই স্থানটুকু তার বর্জ্য দিয়ে ময়লা করে ফেলেছে। ফলে একতলার দিদা ময়নাটাকে উত্তরের বারান্দায় রাখাটা সমীচীন মনে করেছেন।

উত্তরের বারান্দা দিয়ে খোলা হাওয়া আসে, আসে রোদ আর আলো। ময়না নতুন আবাস পেয়ে মনে হয় খুশি হয়েছে। তার শিস্ দেওয়ার হার ও শক্তি বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে সুরেলাও হয়ে উঠেছে। উত্তরের বারান্দার সাথে লাগোয়া হলো পাশের বিল্ডিংয়ের মাসুদ ভুঁইয়া নানাদের গাড়ি ঘর। সেই গাড়ি ঘরের টিনের চালে বেশ কয়েকটা শালিক এসে বসে। দুপুরে আমরা খেতে বসলে খাওয়ার ঘরের জানালা দিয়ে তাদের দেখা যায়। প্রতিদিন মা বেঁচে যাওয়া খাবারের কিছু অংশ টিনের চালে শালিকদের দেয়। শালিকেরা কোথা হতে জানি উড়ে এসে সে খাবার ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে খায়। শালিকদের তাড়িয়ে কখনো কখনো বর্গীর মতো হানা দেয় শহুরে পাতিকাক। আমরা জানালায় দাঁড়িয়ে কাকদের তাড়িয়ে দিলে শালিকেরা শান্তি মতো খেতে পায়।

উত্তরের বারান্দায় ময়নাকে আনার দু-চারদিন পর দেখি খাবার না দিলেও শালিকেরা টিনের চালে এসে বসে। তখন ময়নার হাঁকডাকও বেড়ে যায়। আমরা বেশ কয়েকদিন ব্যাপারটা খেয়াল করলাম। উভয়পক্ষের ডাকাডাকি শুনে মনে হোল তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। যখনই বিষয়টা ধরতে পারলাম তখন আগ্রহ গেলো বেড়ে। ময়না যদি একটা শিস্ দেয় তাহলে শালিকেরা তার জবাব দেয়। আবার শালিকেরা যদি ডাকে তবে ময়নাও ডাক ছাড়ে। শালিকেরা বললো, কি রে ময়না, খাঁচায় কেমন আছিস্? ময়না জবাব দেয়, আছি এক রকম। খাই-দাই আর চিল্লাই। তোরা কেমন আছিস্? আমরা খুব আনন্দে আছি। বললো ভাত শালিকেরা। হুম! সে তো তোদের দেখেই বুঝতে পারছি। তা তোরা কোন বনে থাকিস্? ময়না পাল্টা শুধায়। বন! বন আর আছে নাকি? শালিকেরা সমস্বরে জবাব দেয়। মানুষের দল বন কেটে সব উজাড় করে দিয়েছে। আমরা আশপাশের গাছের ডালে ডালে থাকি। কেন? বন কাটলো কেনো? ময়না অবাক হয়। আরে কাটবে না! যে হারে মানুষ বাড়ছে, মানুষের চাহিদা বাড়ছে তাতে বন কেনো সবকিছুই কেটে উজাড় হয়ে যাবে। ভাত শালিকদের এ জবাবে ময়নার আর বুঝতে বাকি নেই, তারা মানুষের ওপর খুব বিরক্ত। হবেই না বা কেনো। মানুষ মাঝে মাঝে খুব অবিবেচকের মতো কাজ করে। তারা জানে, একটা দেশে তার মোট ভূমির শতকরা পঁচিশ ভাগ বনভূমি লাগে। কিন্তু দেশে আছে মাত্র শতকরা আট ভাগ। তাও কেটে ফেলছে কারণে অকারণে। তাহলে এদেশে আর বৃষ্টি হবে কেমনে? কেমনে মানুষ অক্সিজেন পাবে? গাছই তো অক্সিজেন দেয় মানুষকে। সেদিনের মতো তাদের খোশগল্প শেষ হলো। আবার আঁধার নেমে সন্ধ্যা হলো। পূর্ণিমা চাঁদখানা হেসে উঠল পূর্ব আকাশে। শালিক ও ময়নার কথোপকথন মূলতবী রইল। শালিকেরা ফিরে গেল নিজের ডেরায়। দলবেঁধে আকাশে উড়ে যাওয়া শালিক দেখে ময়নার মন খারাপ হয়। তার মায়ের জন্যে মন কেমন কেমন করে। চাঁদ যতো হাসে তত ময়নার পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে। মায়ের সাথে ময়না গিয়েছিল ধান খেতে এক কৃষকের উঠোনে। বেশ পাকা রঙ ধান। পুষ্ট এবং সুঠাম সব ধানগুলি। লোভ সামলাতে না পেরে মা-ছেলে খেতে বসে গেল কৃষকের উঠোনে। আশেপাশে না তাকিয়ে হাভাতের মতো মায়ের পাশে থেকে থেকে ময়নাটা ধান খেয়ে যাচ্ছিল মনের সুখে। হঠাৎ দেখল, ধান শুকানোর পাটিতে একটা ফাঁদ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পা আটকে গেল ফাঁদে। তারপর! তারপর আর কী? তারপর ময়নাটা এ হাত ও হাত হয়ে শহরের মার্কেটে এসে পড়লো। এদিকে ধান খাওয়ার সময় মা সতর্ক ছিলো। তাই তার পা আটকেনি ফাঁদে। মা উড়ে যেতে পেরেছিল ফাঁদ এড়িয়ে। কিন্তু নিজেকে নিরাপদ রেখেও মার মনে শান্তি নেই। মা শিস্ দেওয়া শুরু করলো অনবরত দুঃখে। মায়ের সে দুঃখ শুনে মানুষেরা মন করলো গান। এদিকে শহরের মার্কেটে এসে ময়নার জায়গা হয় বিজয় মেলার দোকানে। সেই দোকান থেকেই রাহুল ও তার বাবা কিনে আনে ময়নাটি। মেলার দোকান হতে ঘরে এসে ময়নাটির মন আরো খারাপ হয়ে যায়। দোকানে তাও অনেক পাখি ছিল যাদের দেখে মাকে সে ভুলে থাকতো। কিন্তু রাহুলদের ঘরে এসে তার কেবল মাকে মনে পড়ে। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে তার ঘুম পেয়ে যায়। ময়না আজ আর রাতের দানাপানি খায় না।

শহরে সূর্য ওঠে মনে হয় দেরীতে। রাহুলদের বাসায় আটটার আগে কেউ ওঠে না ঘুম থেকে। তারা না উঠলে কেউ বারান্দার রেক্সিনের পর্দা সরায় না। ফলে ময়নার ভোরের আলো দেখা হয় না। গত দুদিন ধরে একটা বড় কালো বেড়াল তার খাঁচার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছিলো বারান্দায়। ভাগ্যিস, খাঁচার শিকগুলোর ফাঁক দিয়ে তার পা ঢোকেনি। ঢুকলে তো ময়নার আর সকাল দেখতে হতো না। ময়না অপেক্ষায় থাকে, কখন উপরতলার মা টিনের চালে খাবার দিবে আর কখন ভাত শালিকেরা আসবে। উপরতলার মানুষগুলোর মনে হয় খিদে পায় দেরীতে। ময়না ভাবে। ভাত শালিকেরা যখন খাবার পায় তখন বেলা বেশ গড়িয়ে যায়। সূর্যটাও যেনো বুড়ো হয়ে আসে। প্রতীক্ষার শেষে আজ ভাত শালিকেরা অবশেষে নামে টিনের চালে। তাদের মধ্যে বেশ অস্থিরতা দেখা যায়। ময়না তাদের জিজ্ঞেস করে, কিরে, তোরা আজ এতো অস্থির ক্যান? ভাত শালিকদের কনিষ্ঠজন জবাব দেয়, ময়না ভাই, তোমার মায়ের সাথে আমাদের দেখা হয়েছে। ময়না অবাক হয়। খুশিও হয় অঢেল। কিরে, যা বলছিস ঠিক বলছিস তো? আরে হ্যাঁ গো হ্যাঁ। তাকে দেখলাম বাজারের কাছে গাছের ঝোপে। সে কেবল বাজারের যেদিকে পাখিয়ালরা পাখি ধরে খাঁচায় পুরে বিক্রী করে সেদিকে তাকিয়েছিল। মনে হয় তোমাকে খুঁজছিল। আমাদের মনে সন্দেহ হওয়াতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম। কিহে খালা, তুমি কাকে খুঁজছ? খালা বললো তোমার কথা। যা যা বর্ণনা দিলো তাতে তোমার কথাই মনে হলো। ময়না দ্রুত বলে উঠলো, তোরা তাকে আনতে পারলি না সাথে? ভাত শালিকেরা বললো, আগামীকাল তাকে আনবো। সে বলেছে, দল নিয়ে এসে তোমাকে উদ্ধার করবে। ময়নার মুখ প্রসন্ন হলো। ময়নার চোখে নীল আকাশ ভাসতে থাকে। মুক্তির আশা তার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে।

ময়না-শালিকের কথা শুনে আমার মজা লেগে যায়। সত্যিই কি তাই! ময়নার মা কি পারবে ময়নাকে উদ্ধার করতে? আমি ভাবি আর নিজেকে প্রশ্ন করি। আহা! সত্যিই যদি ময়নাটা মুক্তি পেতো খাঁচা থেকে! পরদিনের প্রতীক্ষায় থেকে আমি ফিরে যাই পড়ার টেবিলে। আজ পড়াটা বেশ মজার। বাংলাদেশের পাখি। বাংলা রচনা। বেশ বড়। বইতে অনেক পাখির কথা লিখেছে। ময়নার কথাও আছে। আমি একমনে পড়ে ফেলি পাখিদের কথা। ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম যখন ভাঙলো তখন আটটা বাজতে পনর মিনিট। বাসার কাছেই স্কুল। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে মারি ছুট স্কুলে। এখনও আমি একা একা স্কুলে যেতে পারি না। বাসার সামনের রাস্তাটা অনেক ব্যস্ত থাকে। বড় বড় ট্রাক, লরি এই রাস্তা দিয়ে আসে-যায়। আমি রাস্তা পার হতে পারি না। বাবা হাতে ধরে রাস্তা পার করে দেয়। স্কুলের সামনে দোকান থেকে বাটার বন টিফিন নিয়ে তারপর স্কুলে ঢুকি। আজকে ক্লাসে বসে পড়ায় মন বসছিল না। মন পড়ে আছে টিনের চালে আর ময়নার খাঁচায়। আমি বাসায় যাওয়ার আগেই যদি শালিকেরা এসে পড়ে তাহলে তো দেখাই হবে না তাদের অভিযান। এর মধ্যে একটা সুবিধা পাওয়া গেল। বড় ক্লাসের পরীক্ষার জন্যে আজকে সিট বন্টন হবে। তাই এক পিরিয়ড আগেই স্কুল ছুটি হল। ব্যস্। আমার তো খুশি ধরে না। দারোয়ান আঙ্কেলের ফোন হতে মাকে ফোন দিয়ে নিতে আসতে বললাম।

আমি তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছেই চলে যাই খাবার ঘরের জানালার পাশে। দেখি, তখনও শালিকেরা আসেনি। যাক,আমি স্বস্তি পেলাম। ধীরে ধীরে স্কুল ইউনিফর্ম ছেড়ে ধাতস্থ হলাম। তারপর খাবার টেবিলে গিয়ে বসতে না বসতেই শুনি অনেকগুলো পাখির সম্মিলিত আওয়াজ। এ আওয়াজের উৎস খুঁজতে গিয়ে নিচে নেমে এসে দেখি, নিচতলায় বারান্দার গ্রিলে একদল ময়না-শালিক বসে আছে। সংখ্যায় শ’খানেক। তাদের আওয়াজে মাথার মধ্যে যেন হেলিকপ্টার চলছে। অবাক হয়ে আমরা সবাই দেখলাম তাদের অভিনব প্রতিবাদ। রাহুলদের পরিবারের লোকজনও এ ঘটনা দেখে অবাক। পাখিরা আটকে থাকা ময়নার খাঁচার চারপাশে নেমে এলো ধীরে ধীরে। কাউকে ভয় না পেয়ে খাঁচার চারপাশে মরার মতো পড়ে থেকে নিরব হয়ে রইলো। রাহুলের বাবা বাসায় ছিলো না। কাছেই তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তিনি সেখানে ছিলেন। তাকে জরুরি ফোন করে আনানো হলো। তিনিও এই বিস্ময়কর প্রতিবাদ দেখে অবাক হলেন। শেষমেষ ঠিক হলো, ময়নাটা ছেড়ে দিবে আকাশে। যদিও রাহুল আর বুলুর মন খারাপ হয়ে গেছে, তবুও সবাই খুশি হলো এ সিদ্ধান্তে। রাহুলের বাবা খাঁচার হুক খুলে দিলেন। আটকে থাকা ময়নাটা ধীরে ধীরে হেঁটে বের হয়ে এলো খাঁচা থেকে। তারপর ময়না ময়না করে দুবার ডেকে শিস্ দিয়ে উঠলো। ময়নার শিস্ শুনে মরার ভান করে পড়ে থাকা অন্য পাখিরা উঠে গেলো। তারপর দল বেঁধে ফুরুৎ। সবার চোখ ছলছল হয়ে গেলো। এমন অভিনব প্রতিবাদ কেউ আর কখনো দেখেনি। কয়েক মিনিট পরে পাখিরা মিলিয়ে গেলো দিগন্তে। আমি হঠাৎ করে আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটাও যেনো হেসে উঠেছে নীলের পেখম মেলে। কানে আসছে নিচতলার বুলু আর রাহুলের কান্নার আওয়াজ। আর আমি যেনো মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি ময়না ও তার মায়ের মজার খুনসুঁটি।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়