প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২০:৫৪
এক পরিবার ছাড়া অন্যদের দাবি পরিকল্পিত হত্যা
ফরিদগঞ্জে নবতিপর বৃদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়
![ফরিদগঞ্জে নবতিপর বৃদ্ধার রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়](/assets/news_photos/2025/02/11/image-58846-1739285754bdjournal.jpg)
ফরিদগঞ্জে আম্বিয়া খাতুন (৯৫) নামে নবতিপর (নব্বই বছরের বেশি বয়সী) এক নারীর মৃত্যু রহস্য নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় ওই নারীর লাশ উদ্ধারের পর পোস্টমর্টেমের জন্যে চাঁদপুর পাঠিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এবং ওই বৃদ্ধার মেয়ে ও অন্যদের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তারা সুষ্ঠু ও সঠিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
পুলিশ জানায়, তারা পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছে। পাশাপাশি তারা ওই ঘটনার বিষয়ে বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।
জানা গেছে, পাইকপাড়া উত্তর ইউনিয়নের বিষুরবন্দ গ্রামের ছৈয়াল বাড়ির মৃত সোনা মিয়া মজুমদারের স্ত্রী ও তিন ছেলেসহ ৬ সন্তানের জননী আম্বিয়া খাতুন (৯৫)-এর মরদেহ তার ছোট ছেলে হারুনুর রশিদ মজুমদার (৫৯)-এর ঘরের বাথরুমে আড়ার সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) দুপুরে পুলিশ উদ্ধার করে।
সরেজমিনে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গেলে কথা হয় আন্বিয়া খাতুনের ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ, ভাইপো ও বাড়ির লোকজনদের সাথে। বাড়ির লোকজন জানান, মৃত আন্বিয়া খাতুন এরজন পরহেজগার নারী ছিলেন। তিনি পর্দা করতেন, তাই ঘরের ভেতরেরও পর্দা টানিয়ে রাখতেন। নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজসহ অন্যান্য নামাজ আদায় করতেন। বয়সের কারণে চলতে একটু কষ্ট হয় বিধায় লাঠি নিয়েই চলাফেরা করতেন। তবে তিনি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। তাকে মেরে ফেলতে লোকজন আসছে বলে প্রায়শই বলেতন। এর পেছনে অসুস্থতা, বয়সজনিত কারণ, না অন্য কোনো কারণ রয়েছে তা তারা নিশ্চিত নন। কিন্তু যেভাবে অর্থাৎ গলায় ফাঁস দিয়ে মৃত্যুর ঘটনাটি, সেটি তাদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে। কীভাবে একজন প্রায় শতবর্ষী নারী উঁচু ঘরের আড়ায় দড়ি বেঁধে তার সাথে ঝুলে পড়বেন, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টয়লেটে থাকা কাঠের মই, বাঁধা দড়ির দূরত্ব, আড়ার সাথে গিঁট দেয়া সবকিছুইতেই রহস্য রয়েছে। কারো মৃত্যু হলে তার স্বজনদের ডাকচিৎকারে লোকজন ছুটে আসে, ভিড় করে। কিন্তু এই ঘটনা বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) গভীর রাত বা ভোর রাতে হলেও বাড়ির কেউই টের পাননি, যা আশ্চর্যজনক। যদিও নিহত আন্বিয়া খাতুনের ছোট ছেলে হারুন মজুমদারের স্ত্রী কহিনুর বেগম জানান, তিনি লাশ দেখে ডাকচিৎকার দেয়ার পর বাড়ির লোকজন ছুটে আসে। তাছাড়া নিহত আন্বিয়া খাতুনের ছোট ছেলে হারুনুর রশিদ মজুমদারের স্ত্রী কহিনুর বেগম ও পাশের ঘরের হোসেনের স্ত্রী আকলিমা বেগমের কথার গরমিলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পারিবারিক বিরোধ, সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ না অন্য কোনো কিছু এর সাথে জড়িত রয়েছে তা নিয়ে প্রয়োজন অনুসন্ধান।
অনেকেরই দাবি, পুলিশ সঠিক তদন্ত করলে এর রহস্য উন্মোচন হবে--এটি হত্যাকাণ্ড না অপমৃত্যু।
নিহত আন্বিয়া খাতুনের মেয়ে মাছুমা খাতুন (৭০) কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার মা ভালই ছিলেন।একটানা চার মাস আমার বাড়িতে ছিলেন। সেই সময় তাকে পুরোপুরি সুস্থই দেখেছি। তিনি প্রায়ই বলতেন, তার ছোট ছেলে হারুনের বউ ও পাশের ঘরের হোসেনের বউ তাকে মেরে ফেলবে। আমার বাড়ি থেকে আসার পর তিনি আমার ছোট ভাই হারুনের ঘরে উঠেন। সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। তিনি এই বয়সে কীভাবে ফাঁসি দিবেন, আমি বুঝি না। এই ঘটনার তদন্ত ও বিচার চাই।
মেজো ছেলে জব্বার মজুমদার জানান, আমার মা সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। তিনি যখন বাথরুমে যেতেন তখন লাঠি নিয়েই যেতেন। ঘটনার দিন বুধবার গভীর রাতে আমার ছোট ভাইয়ের মেয়ে এবং পাশের ঘরের হোসেনের স্ত্রী আকলিমা আমার বাড়ি গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। পরে জানায়, আমার ছোট ভাই হারুনের স্ত্রী অসুস্থ, এখনই যেতে হবে। তাদের কথায় দ্রুত হারুনের বাড়িতে এসে দেখি, আমার মা ঘরের ভেতরের বাথরুমে গলায় ফাঁস দেয়া মৃত অবস্থায় রয়েছে। পরে কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভেতরে দড়ি খুলতে গেলে লোকজন জানান, এই মৃত্যুটি কেমন যেন, না ধরাই ভাল হবে। পরে স্থানীয় ইউপি সদস্য মুরাদ, চৌকিদার খবর শুনে ছুটে আসেন। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার সকালে স্থানীয় চেয়ারম্যান আবু পাটওয়ারীর কাছে গেলে তিনি আমাদেরকে থানায় যেতে বলেন। আমরা থানায় গেলে পুলিশ দুপুরে এসে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে লাশ নিচে নামায়। আমার বয়স যখন ১৩ বছর, তখন আমার বাবা মারা যান। সেই থেকে আমার মা তিন বড়ো বোন ও আমাদের তিন ভাইকে একা লালন পালন করেছেন। তার এভাবে মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না। সঠিক তদন্ত হোক আমরা চাই। আমি নিজে থানায় জিডি করেছি।
ছোট ছেলে হারুনুর রশিদ মজুমদার জানান, তিনি ঢাকায় থাকেন। তিনি আরো বলেন, আমাকে জানানো হয় ভোররাতে মেয়ে আছমা আক্তার বাথরুমে যাওয়ার জন্যে উঠে টয়লেটে গিয়ে দেখে আমার মা ও তার দাদী বাথরুমের আড়ার সাথে গলায় কালো রশিতে ফাঁস দেওয়াবস্থায় ঝুলে আছে। পরে ঘরের লোকজনের ডাকচিৎকার শুনে প্রতিবেশীরা এসে পুলিশকে খবর দেয়। পরদিন দুপুরে আমি ফরিদগঞ্জে আসি এবং থানায় যাই। তিনি জানান, আমার মা আগে অনেক ঔষধ খেলেও গত এক বছর পূর্বে আমরা সকল ঔষধ বন্ধ করে দিয়েছি। এতে কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি ভালই ছিলেন।
প্রতিবেশী হোসেনের স্ত্রী আকলিমা বেগম জানান, আন্বিয়া খাতুন আমার দাদী শাশুড়ি। বুধবার রাতে আমাদের বাড়িতে আরো একজন লোক মারা যায়। বাড়ির সব ঘরের লোকজন মৃতের ঘরে গেলেও হারুন মজুমদারের ঘরের কেউ যায়নি এবং ঘর বন্ধ ছিলো। লাশ দেখে আমি ঘরে গিয়ে মোবাইল ফোনে হারুন মজুমদারের স্ত্রী অর্থাৎ আমার চাচী শাশুড়ি কহিনুর বেগমকে ফোন দিয়ে বাড়ির এই মৃত্যুর বিষয়ে জানাই। তারা জানে কিনা জিজ্ঞাসা করি, বলেছেন জানেন না। এর কিছুক্ষণ পর কহিনুর বেগম আমাকে ফোন দিয়ে তার ঘরে যেতে বললে আমি বলি, মৃতের ঘরে আপনার, ওই ঘরে যাবেন কিনা। কিন্তু তিনি আবারো তার ঘরে বারবার আমাকে যেতে বলেন। এক পর্যায়ে আমি গেলে আমাকে বাথরুমের সামনে দরজা খুলে নিয়ে গিয়ে কহিনুর বেগম বলেন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। এই কথা বলে তিনি আমাকে জাড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। আমি দেখি, আমার দাদী শাশুড়ি গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় ঝুলে রয়েছে। সে সময় আমি, তার মেয়ে এবং কহিনুর বেগম ছাড়া কেউই ছিলেন না। তাছাড়া ডাকচিৎকার না দিয়ে তিনি আমাকে তার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তার ভাসুর জব্বার মজুমদারকে ডেকে নিয়ে আসতে বলেন। পরে আমি পাশের বাড়িতে গিয়ে জব্বার কাকাকে ডেকে আনি।
আন্বিয়া খাতুনের ভাইপো ইকবাল হোসেন টিটু জানান, বুধবার গভীর রাতে তার ফুফু মারা গেলেও ভোর সাড়ে ৬টার দিকে আকলিমা বেগম আমাদের বাড়িতে ফোন দিয়ে মৃত্যুর ঘটনা জানায়। আমি দ্রুত ঘটনা শুনে চলে আসি। কিন্তু আসার পর হারুন ভাইয়ের ঘরের টয়লেটে যেভাবে আমার ফুফুকে মৃত অবস্থায় দেখেছি, তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। ঘরের মধ্যে ওই টয়লেট রুমে একটি কাঠের মই ছিলো। এর থেকে কয়েক হাত দূরের আড়ার সাথে গিঁট দেয়া রশিতে ঝুলে রয়েছেন ফুফু। তাছাড়া নিচে কিছু ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখেছি। সম্ভবত মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাছাড়া ফাঁস দেয়া লাশে যে ধরনের আলামত বিশেষ করে হাত ও পায়ে দেখা যায়, আমার ফুফুর ক্ষেত্রে গরমিল মনে হয়েছে। আমিসহ পরে থানায় গিয়ে পুলিশকে জানিয়ে লাশ উদ্ধারের ব্যবস্থা করি। আমার ধারণা, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, পরিকল্পিতভাবে মৃত্যুর ঘটানো হয়েছে। এজন্যে সঠিক তদন্ত প্রয়োজন। বাড়ির মানুষ ও ঘরের মানুষজনের কথার যথেষ্ট গরমিল রয়েছে।
হারুনুর রশিদ মজুমদারের স্ত্রী কহিনুর বেগম জানান, ওই রাতে তিনি ঘুমে ছিলেন। ফজরের নামাজের কিছু আগে তার মেয়ে তাকে ডেকে তোলে এবং তার শাশুড়িকে গলায় ফাঁস দেয়া অবস্থায় দেখতে পাই। আমাদের ডাক-চিৎকারে বাড়ির লোকজন ছুটে আসে। এর মধ্যে আমি এসব দৃশ্য দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুদিন পর ফরিদগঞ্জ সরকারি হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাই। তিনি জানান, তার সাথে তার শাশুড়ির কোনো ঝগড়া-বিবাদ ছিলো না। তিনি দুপুরে খাবার খেয়েছেন, বিকালে মুড়ি খেয়েছেন। রাতে কিছুই খাননি।
ফরিদগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক জাকির হোসেন জানান, আন্বিয়া খাতুনের লাশের পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষায় তারা। ঘটনাটি তদন্তাধীন রয়েছে, তাই এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না। তবে ওই ঘটনার বিষয়ে তিনি এবং ওসি সাহেব কয়েকজনকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন বলে জানান।
লাশ উদ্ধারের পরবর্তীতে ফরিদগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহআলম জানান, বৃদ্ধা আম্বিয়া খাতুনের মৃত্যুর কারণটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টের অপেক্ষা করছি।