বিশ^নবী (সাঃ) সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত হিসেবেই আগমন করেছেন। গোটা মাখলুকাতের ইহকালীন ও পরকালীন সার্বিক কল্যাণ ও নাজাতের পয়গাম নিয়ে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার প্রভাতে তিনি ধরার বুকে আগমন করেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামিন হিসেবে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই আজতক এ রহমতের ধারা প্রবাহবান রয়েছে। তাই ১২ ই রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়।

পবিত্র কোরআনেও ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী আমি আপনাকে সারাবিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

হজরত আদম (আঃ)- এর মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে প্রথম নবীর আগমন, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)-এর আগমনের মাধ্যমে পৃথিবীতে নবী-রসুলের আগমন পর্বের সমাপ্তি টানা হয়েছে। মহানবী মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পর পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবেন না। তিনি হলেন সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মনোনীত নবী। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে তারা তার উম্মতের মধ্যেই গণ্য হবে। পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসবে না। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আগে যে হাজার হাজার নবী-রসুল এসেছেন তাদের বিশেষ সম্প্রদায়ের নবী রসুল হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আখেরি নবীর আগমন ঘটেছে সমগ্র মানব জাতির জন্য।

সত্যের মশাল সদা বুলন্দ করাই মহানবী (সাঃ) দুনিয়ায় আগমনের উদ্দেশ্য। সত্যের পথের অনুসরীদের উভয় জাহানে পুরস্কৃত করার বার্তাবাহক। এ জন্য মাহান রব পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আমি আপনাকে সমগ্র জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি, অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা সাবা : ২৮)।

রাসুল (সাঃ)-এর আগমনের কথা সকল আসমানি কিতাবগুলোতেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কোরআনুলকারিমে বলা হয়েছে, ‘হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পাঠানো রাসূল, সত্যতা বিধানকারী সেই তাওরাতের, যা আমার আগে এসেছে, আর সুসংবাদদাতা এমন একজন রাসূলের যে আমার পরে আসবে, যার নাম হবে আহমদ।’ (সূরা আস-সফ : ৬)

নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কোনো একটি বিশেষ দল বা সম্প্রদায়ভুক্ত নবী ছিলেন না এবং তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বনবী। কারণ তাঁর পর দুনিয়ায় আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, “অন্য নবীরা তাঁদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন, আর আমি বিশ্বের সব মানুষের জন্য প্রেরিত হয়েছি।”

মহানবী (সাঃ) পৃথিবীতে আবির্ভূত হন এমন এক কঠিন সময়ে যখন সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ছিল অজ্ঞতায় সয়লাভ যা আইয়্যামে জাহেলিয়াত নামে আমাদের নিকট বেশ পরিচিত। কোথাও শান্তি ছিল না, স্বস্তি ছিল না, ধর্মের নামে অধর্ম বিরাজ করছিল সর্বত্র। শিরক ও কুফরের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল সবাই। নারীদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছিল অবলীলায়, কন্যাসন্তানকে দেয়া হচ্ছিল জীবন্ত কবর। মারামারি, হানাহানি, খুন-খারাবির উন্মত্ততায় গোটা সমাজ ছিল টালমাটাল, পৃথিবীর সেই করুণ অবস্থা নিরসনের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে সিরাজুম মুনিরা বা প্রদীপ্ত চেরাগরূপে প্রেরণ করলেন।

আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, “হে নবী! নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি; আর আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁরই দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং প্রদীপ্ত চেরাগরূপে।” (সূরা আহজাব, আয়াত ৪৫-৪৬)

রাসুল (সাঃ)-এর মন ছিল আকাশের মতো উদার, সত্যের প্রতি অবিচল। জীবনে কোনো দিন কোন প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি। কোন মিথ্যা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি, দানে-ধ্যানে জ্ঞানে, বিচারে-সহানুভবতায় তিনিই ছিলেন অনুপম দৃষ্টান্ত। তার পরিকল্পনা শক্তি ছিল অসাধারণ, তার সংকল্পও ছিল তেমনি সুন্দর। যে কোন ন্যায়, সত্য পরিকল্পনাকে কার্যকরী করে মহান আল্লাহর হুকুম কায়েম করাই ছিল রাসুল (সাঃ)-এর একমাত্র লক্ষ্য।

বিশ্বের সব মানুষের কাছে দ্বীনে মুহাম্মদীর প্রকৃত দিকনির্দেশনা পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া ও কার্যক্রমই মহানবী (সাঃ)-এর জীবনের মূল শিক্ষা। তাই বর্তমান মুসলিম উম্মাহর এই সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণ ও ইসলামের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রধান উপায় হচ্ছে প্রিয় নবীকে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা।

যেহেতু রাসুলের প্রতি ভালোবাসাকে আল্লাহ তাঁর প্রতি ভালোবাসার মাপকাঠি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, সেহেতু রাসুলপ্রেমই আল্লাহপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত! যার ভেতর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা নেই, সে মুমিন হতে পারে না। শুধু বাহ্যিক সুন্নাত পালন রাসুলপ্রেম নয়। বাহ্যিক সুন্নাহর সঙ্গে আন্তরিক ও আত্মিক সম্পর্ক থাকতে হবে এবং এ আত্মিক সম্পর্কের ফলে প্রেমিকের দৃষ্টিতে শুধু প্রেমাস্পদই বিরাজ করে।

যেহেতু প্রিয় নবীর শুভাগমন জগদ্বাসীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে বিভ্রান্ত মানবজাতি আলোর পথের সন্ধান পেয়েছেন, গোমরাহীর অতলগহ্বরে নিমজ্জিত দিকভ্রম বনি আদম তাঁরই উছিলায় আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মর্যাদাপ্রাপ্ত। নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, লাঞ্ছিত, মানবগোষ্ঠীকে তিনি চিরকল্যাণকর আদর্শের পথে আহ্বান করেছেন এবং সম্মান ও মর্যাদার উচ্ছাসনে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তাঁর আবির্ভাব উম্মতের জন্য কত বড় রহমত ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সুতরাং সেই মহান রবের নিয়ামত প্রিয় নবীকে স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির পথ ও পাথেয়। তাই মহানবী (সাঃ) এর জীবনের সুমহান আদর্শের ওপর গভীর আলোকপাত করে মানবজীবনে তা বাস্তাবায়ন করার প্রত্যয়দীপ্ত শপথ নিতে হবে আজ। তাহলে তার জীবন দর্শনের সঠিক মূল্যায়ন হবে।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) গোত্রীয় শাসনের স্বৈরাচারে দগ্ধ, মুষ্টিমেয় বিত্তশালীর শোষণে নিঃস্ব, সামাজিক দূরাচারে অতিষ্ঠ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাওহীদের বাণী প্রচারের দায়ে স্বজাতির নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরতে বাধ্য হয়েছিলেন। অতঃপর ঐতিহাসিক মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে ইহুদি, পৌত্তলিক, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের নিয়ে মদিনাতে একটি স্বাধীন-স্বতন্ত্র জাতি ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাসুলের আদর্শিক জাগরণ সমগ্র আরবকে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সুশাসন, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আজ যখন দেশের বিপুল মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করছে, যখন অন্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার অভাব জনজীবনে প্রকট হয়ে উঠছে, যখন মানুষ একে অপরের দ্বারা নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে- তখন তাঁর শুভাগমন থেকে শিক্ষা হোক ও শপথ হোক। রাসুল (সাঃ)-এর ভালোবাসার দাবিতে সংঘাত নয়, চাই রাসুল (সাঃ)-এর আদর্শের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ।

আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে যত বেশি মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, যত বেশি দরুদ ও সালাম পাঠাবো ততোই বাতিল, তাগুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শ সবার জীবনের জন্য হোক মুবারক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : খতীব, রেলওয়ে কাঁচা কলোনী জামে মসজিদ।